আমি কিন্তু মোটেও অবাক হইনা খুব সামান্য বিষয় নিয়ে আমাদের দেশের মানুষের অতিরঞ্জিত প্রতিক্রিয়া দেখে! কারন বড় কোন বিষয়ে আমাদের যে প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত সেটা কখনোই আমরা দেখাই না, আমাদের স্নায়ু তখন ইস্পাত কঠিন শক্ত থাকে। আপনারা আমাদের দেশে দায়িত্বশীল পদ থেকে সুস্পষ্ট ব্যর্থতার দায় নিয়ে নিজ থেকে কোনদিন কাউকে পদত্যাগ করতে দেখেছেন? না। নিতান্তই সর্বোচ্চ ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের নির্দেশনা ব্যতীত আমি জ্ঞানত আমার জীবনে বাংলাদেশের কোন মন্ত্রী, আমলা বা দায়িত্বশীল পদের কাউকে পদ থেকে স্বেচ্ছায় সরে যেতে দেখিনি। লঞ্চ ডুবিতে হাজারো মৃত্যু, বড় ধরনের অগ্নিকান্ড থেকে শুরু করে রানা প্লাজা ধ্বসে পড়া বলি আমাদের বিবেক এক ফোঁটাও নড়েচড়ে বসেনি। আমরা পরষ্পরকে দোষারোপ করতে দারুন মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়ে থাকি। দেখা যায় বড় ধরনের ব্যর্থতার জন্য এক মন্ত্রণালয় অন্য মন্ত্রণালয়কে দায় দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব সুন্দর করে এড়িয়ে যাচ্ছে।
তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কখনো কখনো অতীব সামান্য ঘটনা নিয়ে যে পরিমাণ কাদা ছুড়াছুড়ি এবং নোংরা ভাষার ব্যবহার চোখে পড়ে তা অবলোকন করে আমি শুধু মুচকি হাসি। এই তো সেদিন একটা খবর দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় দেখে মুচকি হাসছিলাম, যদিও তা মোটেও হাসির বিষয় নয়। একটু দেখি খবরটাঃ
“অটিস্টিক ছেলেকে নিয়ে হাঁটতে গেছেন মা। পার্কেই হাঁটেন। হাঁটতে হয়। কারণ, ছেলের ডায়াবেটিস। ছেলেটি হাঁটতে হাঁটতে এক মেয়ের হাত ধরেছে। কিছুই বোঝে না ছেলেটি। হাত ধরতেই মেয়েটি লোকজন ডেকেছে। পার্কের কর্তৃপক্ষ এসেছে। ছেলের মা’কে বলেছে আর কখনও এই পার্কে ঢুকতে পারবে না। মা বুঝাচ্ছেন তার ছেলে অটিস্টিক। ছেলে অসুস্থ। হাঁটতে আসতেই হবে। কিন্তু কেউ মানবে না। পুলিশ ডাকবে। ছেলেকে বাথরুমে আটকে রাখবে। অসহায় মা তাদের বললেন, আমার ছেলেকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিন। শেষ পর্যন্ত মুচলেকা দিয়ে বাসায় ফিরেছেন সেই মা।“
এই হলো আমাদের অবস্থা। উপরের খবরটি পড়ে ফেসবুকে একজনের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখে ভালো লাগলেও আমি মুচকি হাসলাম। একটু প্রতিক্রিয়াটি দেখি-
“একটা জাতির অধিকাংশ মানুষ আইন প্রণেতা হিসেবে আইন না জানা গণ্ডমূর্খকে নিয়ে নির্বাচন করে, লাফায়, জীবন বাজী রাখে। জিনিসপত্রের দাম বাড়লে তার পেছনে ঠিক ঠিক ঠিক বলে যুক্তি চাপায়, ট্রাফিক আইন মানে না, ফুটপাতে বাইক তুলে দেয়, স্কুল আর হাসপাতালের সামনেও তীব্র হর্ন বাজায়, অন্যের হক মেরে খায়, বাবা মা’কে সম্মান করে না, ধর্ম না বুঝে ধর্ম পরিচালনা করে, লুটপাটে সমর্থন করে কিংবা চুপ থাকে, নারীর অসম্মানে উল্লাস করে, ফাঁস হওয়া প্রশ্ন নিয়ে ডাক্তারি পড়ে, খাবারে ভেজাল মেশায়। অথচ?
তারা অটিস্টিককে চিনতে পারে না। নিজেদের অসুখ দূর করতে না পেরে এরা প্রকৃত অসুস্থের সাথে কী অসভ্য আচরণ করে! হায় রে!”
আমি কেনো খবরটি পড়েও মুচকি হাসলাম আবার একজনের যৌক্তিক ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখেও কেনো মুচকি হেসেছি? কারন এই দুটি ঘটনাই অতিরঞ্জিত প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রকাশ মাত্র, এখানে সমাধানের কোন সূত্র নেই। দুটো ব্যাপারই এখানেই শেষ। এসব নিয়ে আর কারো কোন মাথা ব্যাথা থাকবে না, এরকম একটি স্পর্শকাতর হৃদয়হীন ঘটনা আবারও ঘটবে অন্য কোথাও। আমাদের প্রতিক্রিয়াও ঐ ফেসবুক পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে, সমাজের এমন হাজারো অসামঞ্জস্যতায় আমাদের কিচ্ছু আসে যায় না যতক্ষণ না কোন দূর্ঘটনার সরাসরি শিকার আমি বা আপনি না হচ্ছেন। মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনা? চলতে থাকুক। মাদকের ভয়াবহ থাবা? চলতে থাকুক। আমাদের টনক নড়ার ব্যাপারটা ঐ পর্যন্তই, তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েই সমাপ্তি। এরপর নতুন কোন ঘটনা নিয়ে তর্কে বিতর্কে জড়িয়ে নিজেদের জাহির করার সংষ্কৃতি আমাদের মজ্জাগত। আমাদের দৌড় ফেসবুক যোদ্ধা হওয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ, এখন বুঝতে পারি পশ্চিম পাকিস্থানীদের অত্যাচার কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিলো ষাট সত্তুরের দশকে। অন্যথায় এ জাতির ঘুম ভাঙ্গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মত সাংঘাতিক ইতিহাস রচিত হতে আরো দুইশত বছর বুঝি পার হয়ে যেত।
বুড়িগঙ্গার পানিতে বিষ। দূর্গন্ধে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। এমনটা কতদিন ধরে চলছে আমরা কি জানি না বা দেখি না? হাজার হাজার লঞ্চ যাত্রী বরিশাল, চাঁদপুর পটুয়াখালী, ভোলায় নিয়মিত চলাচল করেন সদরঘাট হয়ে। বুড়িগঙ্গার কালো কুচকুচে দূর্গন্ধযুক্ত পানি দেখতে দেখতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি, আমাদের কোন প্রতিক্রিয়াই অবশিষ্ট নেই। ক্ষমতায় যাওয়ার আন্দোলন আছে, নদী বাঁচানোর আন্দোলন নেই। অথচ সত্যিকার সংবেদনশীলতা থাকলে এতোদিনে সচেতনতার পাশাপাশি সমাধানের জন্য সবাই একাট্টা হয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। গাজীপুরের কিছু শিল্প এলাকায় কারখানা থেকে চব্বিশ ঘন্টা এমন কালো ধোঁয়া বের হয় যে চারপাশের এলাকায় দিনের বেলায়ও মনে হবে সন্ধ্যা হয়ে আছে, নিঃশ্বাস নিতে গেলেও বাতাস ভারী মনে হবে। পেপার পত্রিকায় প্রতিবেদনও বের হচ্ছে, এলাকার মানুষ ফুসফুসের বিভিন্ন ব্যাধিতে ভুগছেন, টিভি ক্যামেরার সামনে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। কিন্তু সেই একই ঘটনা চলতেই থাকবে, এর বিরুদ্ধে নেই কোন সংগবদ্ধ প্রতিবাদ অথবা সমাধানের কোন উদ্যোগ।
সভ্য কোন দেশে যানবহনের হর্ণ বাজানোর প্রচলন নেই, আমাদের দেশে অকারনে হর্ণ বাজানো মানুষের জীনগত বৈশিষ্ট্যের মতো। শব্দ দূষণে যতোই ক্ষতি হোক আমাদের কোন হেলদোল নেই, ট্রাফিক সপ্তাহে লোক দেখানো অভিযানে কিছু জরিমানা হবে এরপর আবার যাহা বাহান্ন তাহা তিপ্পান্ন! সামান্য মশার উপদ্রব থেকে দেশবাসীকে মুক্তি দিতে পারেন না আমাদের মহামান্য মেয়র বাহদুরগণ, মশার কামড়ে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর মিছিল আমরা অসহায়ের মতো তাকিয়ে দেখতে থাকি। প্রতিক্রিয়া সেই ফেসবুক নির্ভর, মেয়রের কার্যালয় ঘেরাও করতে যাবার মত সময় আমাদের নেই। ঝোপ বুঝে কোপ মারার ওস্তাদ এই দেশের আমজনতা, মাথায় টুপি, টাইটেলে হাজি পদবী ধারণ করেও আমরা ষাট টাকার স্যালাইন নির্লজ্জের মতো এক হাজার টাকায় বিক্রি করি! এটাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়, তুমুল প্রতিবাদ হয় কিন্তু সম্মিলিত প্রতিরোধের জন্য কেউ এগিয়ে আসি না। সিন্ডিকেটের মন্ত্র জপতে জপতে আমাদের মন্ত্রী মহোদয়গণও ঘুম পাড়ানি গান শুনিয়ে চলেন জাতিকে, তাতেই আমরা বেঘোরে ঘুমিয়ে স্বপ্নে আমেরিকা, ইউরোপ, কানাডা, সিঙ্গাপুর সফর সম্পন্ন করি।
আমরা কিন্তু বিদ্যমান প্রতিটি সমস্যার কথাই আদ্যপান্ত জানি। কি কারনে সমস্যা, কিভাবে সমাধান করা যাবে সেসব নিয়ে বিস্তর গবেষণাও কিন্তু আছে। এই যেমন পলিথিন ব্যবহার করা, পরিবেশের উপর পলিথিন বা প্লাস্টিক দূষণের চরম ক্ষতিকারক দিক সমূহ কি কি? আমাদের রক্তের নমুনায় পর্যন্ত মাইক্রো প্লাস্টিক পাওয়া যাচ্ছে! অবশ্য আমরা নির্বিকার, এসব দূষণের দীর্ঘমেয়াদী কি কি ক্ষতিকর দিক আছে সেসব জানা থাকা সত্ত্বেও আমাদের কোন উশবিশ নেই। আমাদের প্রতিক্রিয়া শুধুমাত্র ফেসবুক নির্ভর, মাইকের সামনে আর বাসের হেল্পার ড্রাইভারদের সাথে। লোকাল বাসে ভাড়া নিয়ে বসচার মাঝে হঠাৎ করেই কাউকে অপ্রাসঙ্গিক কোন প্রসঙ্গ নিয়ে তীব্র উত্তেজিত হয়ে পড়তে দেখেছি। প্রসঙ্গ অতিরিক্ত ভাড়া আদায় থেকে দেখা গেলো নিজ পারিবারিক অশান্তির প্রভাব প্রকাশ করতে! তখন আমি হাসি, কারন লোকাল বাসে শিশু, বৃদ্ধ মহিলা অসুস্থ ব্যক্তি সবাই থাকেন, সেই পরিবেশেই কোন ভ্রুক্ষেপ ছাড়াই উচ্চস্বরে গালিগালাজ পর্যন্ত করে ফেলেন অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখানো আমাদের আম জনতা। পাশ থেকে কেউ টিপ্পনি কাটেন- বাড়িতে মনে হয় আজ বৌয়ের সাথে ঝগড়ায় হেরে এসেছেন তথাকথিত ভদ্রলোক!
আমাদের সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি। রাজনৈতিক বক্তৃতার মঞ্চে উঠে বক্তারা যে ভাষায় প্রতিপক্ষকে ধোলাই দেন তা রীতিমত অসভ্যতার পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এমন উচ্চস্বরে তীব্র মেজাজে তাঁরা বক্তৃতা করেন যে মনে হবে এখুনি তাঁর প্রতিপক্ষকে সামনে পেয়ে গেলে আস্ত গিলে খাবেন। এগুলো পুরোপুরিই লোক দেখানো আমরা যারা সভায় উপস্থিত থাকি তাঁরাও জানি, তবুও সেসব অযৌক্তিক জ্বালাময়ী বক্তব্য না শুনলে আমাদের মন ভরে না। আমরা অসভ্যতার সাথে দারুনভাবে মানিয়ে নিয়েছি, বরং অফিসের বস যদি নরম স্বভাবের হন আমরা আড়ালে তাঁকে নিয়ে ট্রল করি। রাগী বস, যিনি সকাল বিকাল গালিগালাজ করেন তাঁর সামনে আমরা বিগলিত হয়ে জি বস জি হুজুর করে গলা শুকিয়ে ফেলি। সকল অসঙ্গতির সাথে মানিয়ে নেয়া দারুন এক প্রজাতির মানুষেরা বসবাস করি আশ্চর্য এই ব-দ্বীপে, আমাদের মুক্তি কি তবে একমাত্র মৃত্যুতে, শোকে, আহাজারি আর হতাশার নিমজ্জিত অন্ধকারে?
পল্লব খন্দকার, ০১ অক্টোবর ২০২৩
mazhabkh93@gmail.com