আমরা জানি কেউ অপরাধী হয়ে জন্ম নেয় না। জীনগত কারনে উত্তরাধিকার সূত্রে কিছু অপরাধ প্রবণতা মানুষের মধ্যে যে একেবারে থাকে না তা নয়। তবে কেউই একবারে বিরাট কোন অপরাধ দিয়ে ইনিংস শুরু করতে পারে না। বিশ্লেষণ করার সুযোগ থাকলে দেখা যায় একজন জীবনে ছোট ছোট অনেকগুলো অপরাধ পার করে এসেছে। যেমন কেউ যদি অনবরত মিথ্যা বলে আমরা কিন্তু সেই অপরাধে তাকে বড়জোর তিরস্কার করি, জরিমানা করি না বা পুলিশে দিই না। এভাবেই মিথ্যা বলার প্রতি তার অভ্যস্থতা তৈরি হয় যা একসময় দাগী অপরাধী হয়ে উঠতে ভূমিকা রাখে।
অপরাধের সংজ্ঞা কি?
অপরাধ (ইংরেজি: Crime, Misdemeanor, Felony) হচ্ছে কোন ব্যক্তি কর্তৃক আইনবিরুদ্ধ কাজ। দেশ বা অঞ্চলের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে প্রণীত আইনের পরিপন্থী কার্যকলাপই অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। অপরাধ গুরুতর কিংবা লঘু – উভয় ধরনেরই হতে পারে।
যেকোন অপরাধ যখন শুরু হয় অর্থাৎ প্রাথমিক অবস্থায় খুবই সরল প্রকৃতির থাকে, অনেকটা আত্মকেন্দ্রিক। অপরাধ করে অনেকটাই দ্বিধা-দ্বন্দের ভিতরে থাকে একজন অপরাধী। অপরাধ করার ক্ষেত্রে এই সময় অপরাধীর বিশ্বাসের অভাব থাকে, অনেক সতর্ক হয়ে অপরাধ করে। ঠিক এই সময়েই যদি অপরাধ করার ক্ষেত্রে বাধা না দেওয়া হয়, প্রতিহত না করা হয়, অপরাধীর আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি হলেই অপরাধের আকার আরও বিস্তার লাভ করে। এই সময় অপরাধী ধীরে ধীরে চেষ্টা করে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভগুলোকে যুক্ত করে নিতে। সর্বপ্রথম সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের উৎসাহ যুক্ত হতে থাকে, অপরাধীরাও দেখে ইতিমধ্যে চলতে থাকা তার অপরাধগুলো অনেক লাভজনক হিসেবে দেখা দিচ্ছে ও বিপদের সম্ভাবনাও আগের থেকে কমে গেছে। ধীরে ধীরে সে সমাজের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকেও নিজের অপরাধের সাথে যুক্ত করার সুযোগ পায়।
এই বৃহৎ হয়ে ওঠা অপরাধের একটা অচেনা দিক হলো অপরাধের সাথে জড়িয়ে থাকে কিছু ইন্দ্রিয়ঘটিত ব্যাপার স্যাপার যেমন প্রেম, শারীরিক সম্পর্ক, অবৈধ ভালোবাসা। এগুলো অপরাধীকে আরও বেশী করে উৎসাহ দেয় অবাধে অপরাধের কাজে সময় দিতে। এমনকি একই ধরনের অপরাধে যুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী অপরাধীদের মধ্য পারষ্পারিক আধিপত্যের লড়াই শুরু হয়, যা অপরাধীদের আরও মারাত্মক ধরণের অপরাধে জড়িয়ে ফেলে।
এরপর ওই অপরাধ যেমন আর ক্ষুদ্র থাকে না, বিশালাকার হয়ে ওঠে, তেমনই অপরাধ ওই অপরাধীর একার থাকে না, সমাজের ভেতরে প্রতিটি অংশকে ছুঁয়ে ফেলে, সবাইকে জড়িয়ে ফেলে। এই অপরাধ অনেক জটিল, অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসে ভরা। খুন খারাবি, ধর্ষন, প্রতিহিংসা, প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে হানাহানি কোন অপরাধ করতেই অপরাধীর মধ্যে আর রাখঢাক থাকে না। নিজেকে নিয়ে তার মধ্যে কোন সংশয় থাকে না যে সেইই শ্রেষ্ঠ্য, মৃত্যুভয় বলে কিছু অবশিষ্ট থাকে না। অপরাধী নিজেকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে কল্পনা করতে ভালোবাসে, ধরাকে সরা জ্ঞান করা যাকে বলে!
কূখ্যাত অপরাধী যখন নিজেকে অপ্রতিরোধ্য হিসেবে ভেবে নেয় ঠিক তখুনি আসে অপরাধ ধরা পড়ার সময়। কারণ কোন অপরাধই চিরকালীন না। তাই, অপরাধ যতই জটিল হোক, ধরা পরার পর, অপরাধের থেকেও বেশি জটিল হয় এই ধরণের অপরাধের তদন্ত করা। এই ধরণের দাগী অপরাধীর ব্যাপারে তদন্তে নেমে তদন্তকারী কর্মকর্তা অপরাধের প্রক্রিয়াটি নিরপেক্ষভাবে বুঝে ওঠার আগেই প্রাশাসন বা সমাজের উচ্চ পর্যায় থেকে চাপ আসতে থাকে। কিছু অপরাধী এতো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়। এমনকি তদন্তের প্রকৃত প্রতিবেদন ধামাচাপা দেয়া হয়, ফলে মানুষের কাছে অপরাধ ও বিচার সংক্রান্ত বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলো ধাক্কা খায়। সামগ্রিকভাবে, সমাজের ক্ষতি করে দেয় এই ধরণের অপরাধ সমূহ।
ভাবতে অবাক লাগে, মানুষ কিংবা প্রতিষ্ঠান কোন না কোন অপরাধে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে এভাবেই। এমনকি মারাত্মক ধরণের অপরাধের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হবার পরও সমাজের ক্ষতি হতে পারে, তদন্ত প্রতিবেদন থেকে উঠতি বাঁ নতুন অপরাধীরা কুটিল অপরাধের ধারনা পেয়ে যায়। তাই উভয়দিকেই সংকট। তদন্ত সঠিক ভাবে করলে যে ফল বেরিয়ে আসে তাতে অপরাধীর পাশাপাশি অপরাধের সাথে যুক্ত সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের বিশ্বাস কমিয়ে দেয়। যেমন যখন কোন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় যে অমুক নেতার প্রশ্রয়ে অমুক দূর্ধর্ষ অপরাধ সংগঠিত হয়েছে, তখন উক্ত বিশিষ্ট ব্যক্তির প্রতি সকলের শ্রদ্ধাবোধ নষ্ট হয়ে যায়। মানুষ পরষ্পরের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে, এটা সমাজে দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলে থাকে। অন্যদিকে সঠিক তদন্ত না করলে অপরাধী ছাড়া পেয়ে যায় ও বহাল তবিয়তে দাপিয়ে বেড়ায় যা গোটা বিচার পদ্ধতির প্রতি মানুষের অনাস্থা তৈরি করে।
এভাবে চলতে চলতে ব্যক্তি পর্যায়েও অপরাধ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইদানীং কালের যে সকল পারিবারিক খুন খারাবির খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তা কিন্তু একজন বা দুজন মিলে পরিকল্পনা করে ঘটায়। এমনকি ইতিপূর্বে অপরাধের কোন ইতিহাস তার থাকে না, তবুও দেখা যায় সম্পত্তির লোভে বা প্রতিহিংসা মেটাতে অথবা পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে পড়ে খুনের মতো ভয়াবহ ঘটনায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলে কেউ কেউ। এছাড়া সমাজে এক ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয় লোকচক্ষুর অন্তরালে, অত্যন্ত প্রচ্ছন্নভাবে। এসব অপরাধ করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরাধী শাস্তি এড়িয়ে যেতে পারে। এটি মূলত দুর্নীতি বা ভদ্রবেশী অপরাধ (White-collar crime) কর ফাঁকি দেওয়া, ঘুষ নেয়া, তহবিল তছরূপ করা ইত্যাদি এ শ্রেণির অপরাধ।
দুঃখজনক হলেও সত্য দাগী অপরাধীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গড ফাদার বা কোন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর আশ্রয় প্রশ্রয় পেয়ে থাকে। দেখা যায় একজনের পেশা খুন করা, এই পেশায় তাকে নামায় সমাজের চোখে ক্লিন ইমেজের বা টাকাওয়ালা মানুষগুলোই। তাদের স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয় একজন পেশাদার খুনিকে, খুনের পর তাই খুনী পালিয়ে আশ্রয় পায় প্রভাবশালীদের বলয়ে থাকা নিরাপদ স্থানে। যখন সে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে তখন থলের বেড়াল বের হয়ে আসে। আবার অনেক সময় গড ফাদারদের ক্ষমতা ও টাকার জোরে অপরাধীকে মুক্ত করা কিম্বা বিদেশে পালিয়ে যেতে সহায়তা করতেও দেখা যায়। এভাবেই অপরাধের আগ্রাসী ভাইরাস সমগ্র সমাজ ও রাষ্ট্রকে একসময় গ্রাস করে নেয়।
বনানী ঘোষ, খুলনা থেকে।
Excellent write-up. Best wishes for writer. Waiting for more articles in the next.