আমি কি দরিদ্র?
প্রচলিত অর্থে আমার নিজের কোন সম্পদ নাই, অর্থাৎ ফ্লাট, প্লট, বাড়ি, গাড়ি, জমি, ব্যাংক ব্যালান্স কিছুই করে উঠতে পারিনি পঞ্চাশের কোঁটায় দাঁড়িয়েও। দিন এনে দিন খাওয়া না হলেও আমাকে মাস এনে মাস খাওয়া মানুষ অনায়াসেই বলা যেতে পারে, আমার মতো এমন অসংখ্য মানুষ আছে আমাদের চারপাশে। মাসোহারা না পেলে আমাদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা কতোটা জটিল হতে পারে তা ভুক্তভোগী ছাড়া অনুমান করতে পারবে না। সাধারণতঃ যারা অল্প-বিস্তর বা অগাধ সম্পদের মালিক হন তারা অধিকাংশই চল্লিশ বছর বয়সের মধ্যে অর্জন করে ফেলেন। সম্পদ অর্জনের গাণিতিক হিসেব পঁচিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে অর্থাৎ পনেরো বছরের একটা জীবন চক্রের সার্বিক কর্মকাণ্ডের ফলাফলস্বরূপ মানুষের জাগতিক সম্পদের স্থিতি নির্ধারিত হয়ে থাকে। সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মানো মানুষদের কথা ভিন্ন, কিন্তু অতিদরিদ্র, নিন্মবিত্ত, নিন্ম-মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া মানুষদের সম্পদ অর্জনের গ্রাফ মোটামুটি জীবনের ১৫-২০ বছরের মধ্যে ওঠানামা করে। এই সময়ের মধ্যে মেধা, শ্রম, বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে কেউবা সৎ পথে কেউবা অসৎ পথে কেউবা সৎ-অসৎ পথের সংমিশ্রণে সম্পদ অর্জন করতে পারেন।
সকল পরিস্থিতি অনুকূলে থাকা স্বত্বেও আমি কেনো জাগতিক সম্পদ কেনো অর্জন করতে পারিনি সেই প্রশ্ন নিয়ে তেমন মাথা ব্যাথা আমার কোনদিন হয়নি বলেই আমি পারিনি। আমার মায়ের দিকের পরিবারের অনেককেই জ্ঞান হবার পর থেকেই সম্পদ, গাড়ি, বাড়ি, খ্যাতি, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদীয় কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর বড় কর্তা হিসেবে দেখে দেখে বড় হয়েছি। যখন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম তখনো অনেকের উপদেশ পেয়েছি জীবনে সফল হবার পথ ও পদ্ধতি বিষয়ে। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেই বলতে চাই আমি আসলে সেসব উপদেশ কোনদিন গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করতে পারিনি। আমার চিন্তার বিস্তার ও স্বপ্নগুলো সবসময় খুবই ছোট ছোট ছিলো, এই যেমনঃ বাইসাইকেল চালানো শেখা ও একটা সাইকেলের মালিক হওয়া। সেটা যখন অর্জিত হলো তখন একটু মোটর সাইকেল চালানোর ইচ্ছে জন্মালো, সেটাও যখন পূরণ হলো তখন মাঝে মাঝে চার চাকাওয়ালা গাড়িতে চাপার শখ হয়েছে কিন্ত তা কখনো প্রবল আকার ধারণ করেনি।
আমার এই না চাওয়ার অভ্যাস কেনো কিভাবে হলো তার কোন ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই, সোজা কথায় বলা যায় সম্পদ অর্জনের মোহ আমাকে কোনদিনই টানেনি। বিরাট কিছু হতে হবে বা অমুক মামার মতো হতে হবে এমন কোন ভাবনাই তেমন করে আমাকে তাড়িত করেনি। এই বেশ ভালো আছি মনোভাব নিয়ে সকল পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিয়ে হাসিমুখ ধরে রাখাটাই আমার চিরকালীন চরিত্র। শৈশবের প্রারম্ভে দেখেছি আমার বাবা ব্যাংক কর্মকর্তা ছিলেন এবং আমরা পরিবারের ব্যবহারের জন্য অফিসিয়ালি একটা গাড়ি পেয়েছিলাম। হয়তো সেই সময় থেকেই আমার ভিতর উচ্চাভিলাষ জন্মানো স্বাভাবিক ছিলো, গাড়ি-বাড়ি-সম্পদের জন্য কামনা-বাসনার সৃষ্টি হতেই পারতো। কেনো হয়নি তা আমার বোধগম্য নয়, বরং ঢাকায় গাড়ি-বাড়ি যৌতুক পাবার সহজ সুযোগও জেনেবুঝে হাতছাড়া করেছি কোন একদিন। মর্যাদাসম্পন্ন সরকারী চাকুরীও ছেড়েছি অনায়াসে কিন্তু সেসব নিয়ে কখনো আফসোস করারও চেষ্টা করিনি। বরং এই যে যেমন আছি, এমনটাই বেশ আরামদায়ক অনুভব করি এবং চারপাশে সম্পদশালীদের অযাচিত যন্ত্রণাগুলো দেখে আরো বেশি নিজের না চাওয়ার অভ্যাসের প্রতি কৃতজ্ঞ হই।
শুধু একটাই জিনিস জোরালোভাবে আমি চাই সেটা হলো শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্য। আমি আমার চারপাশে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থদের সীমাহীন যন্ত্রণাগুলো প্রত্যক্ষ করে খুবই বিমর্ষ বোধ করি। তখন আমার না চাওয়া না পাওয়ার চিরায়ত মনোভাবকেই আশীর্বাদ মনে হয়। সৃষ্টিকর্তাকে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই আমার হৃদয়ে কোন মোহ সৃষ্টি না করার জন্য, আমাকে একজন দরিদ্র মানুষ কিন্তু সুখী হিসেবে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।
পল্লব খন্দকার
১৭ জুন, ২০২৩।