বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে ২০০৮ সালে। সেই সময়ে দলটি যে নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছিল তা মুগ্ধ করেছিল দেশের সকল মানুষকে। বিশেষ করে সেই নির্বাচনী ইশতেহার আকৃষ্ট করেছিল দেশের তরুণ সমাজকে। সেই নির্বাচনী ইশতেহারের মাধ্যমে তরুণ সমাজ নতুন করে স্বপ্ন দেখার সুযোগ পেয়েছিল। সেই তরুণ সমাজ হঠাৎ করেই বিগড়ে গেল কেন? এ বছর মধ্য জুলাই থেকে কোটা সংস্কারের দাবিতে টানা বেশ কয়েক দিন ধরে দেশের তরুন তরুণী শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছে, আন্দোলন করেছে। গুলির সামনে বুক পেতে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের আগ পর্যন্ত কত যে শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে, সাধারন মানুষের প্রাণহানি হয়েছে, তার সঠিক সংখ্যা দেশবাসী কখনই জানতে পারবে কিনা তাতে সন্দেহ আছে। জীবন যাদের এখনও শুরুই হয়নি, তাদের অনেকেরই নির্মমতার শিকার হয়ে পৃথিবী থেকেই বিদায় নিতে হয়েছে। অবশেষে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট ২০২৪ দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে যেতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। তিনি ক্ষমতাচ্যুত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সভাপতিও ছিলেন। তার অনুপস্থিতিতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে দলটির নেতা-কর্মীরা। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে দলটির নেতা-কর্মীদের ওপর এবং তাদের বসত-বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেই চলেছে। হামলায় হতাহতও হয়েছেন অগনিত নেতা-কর্মী, এখনও হচ্ছে। দেশের ন্যাশনাল হেরিটেজ সমতুল্য টিভি ভবন, ধানমন্ডি ৩২ নম্বর, স্বাধীনতার মিউজিয়াম, মুজিবনগরের স্মৃতিচিহ্ন ভষ্ম করে দেয়া হয়েছে। গনভবন, সংসদ ভবনে চালানো হয়েছে লুটের তান্ডবলীলা। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের বহু কার্যালয়, এগুলো এখনও থেমে যায়নি। হামলার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকেই। ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে নিজের প্রাণ নিয়ে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন। কিন্তু নিজ দলের লাখ লাখ নেতাকর্মীকে চরম অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছেন। এ অবস্থায় ১৯৭১ সালে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া দলটির অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে।
যারা দেশের রাজনীতির অতোটা খোঁজ খবর রাখেননি তাদের অনেকেই বিষ্ময় প্রকাশ করে বলেছে, তরুণ সমাজ হঠাৎ বিগড়ে গেল কেন? এরা হঠাৎ বিগড়ে যায় নি। তরুণ সমাজ, সেই সাথে সাধারন জনতার পুঞ্জীভুত ক্ষোভ হঠাৎই জ্বলে উঠেছে। তার অসংখ্য কারণ রয়েছে।
তার আগে প্রকৃতিতে বা ইকোলজিতে দুটি শব্দের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দিই। একটা “বায়ো-অ্যাকুমুলেশন” আরেকটা “বায়োম্যাগনিফিকেশন”। বেশ কিছু বিষাক্ত কেমিকেল যেমন মারকারি (পারদ), ডিডিটি পাওডার, পিসিবি, এরকম আরও অনেক উপাদান খাদ্যদ্রব্যের সাথে বা অন্য কোনো ভাবে শরীরে ঢুকলে আর বের হয় না। শরীরে বিন্দু বিন্দু করে জমতে থাকে। আমাদের শরীরের ফ্যাট সেলের অরগান যেমন লিভার, ব্রেন এগুলোতে জমতে থাকে। মনে করেন একদিন এমন একটা মাছ খেলেন সেই মাছের শরীরে মারকারি ছিল। এই মাছ খাওয়ার সাথে মাছের শরীরে জমাকৃত মারকারি আপনার শরীরে স্থানান্তর হলো এবং ওখানেই রয়ে গেল। আরেক দিন একটা আরেকটা মারকারি কন্টামিনেটেড সব্জি খেলেন সেই মারকারিও আপনার শরীরে চলে যাবে এবং শরীরে আগে থেকে যে মারকারি ছিল সেই মারকারির সাথে একই জায়গায় যেয়ে জমা হবে। আপনার শরীরে মারকারির পরিমান বেড়ে গেল। এমনি করে কোনো খাবারের সাথে বা কোনো কিছুর সাথে যখনই কোনো মারকারি আপনার শরীরে যাবে তখনই আপনার শরীরে মারকারির পরিমান বেড়ে যাবে। আপনার শরীরে গেলেই তারা এক জায়গাতে পুঞ্জীভূত হবে। এই অল্প অল্প করে পুঞ্জীভূত হওয়ার পদ্ধতিটাই বায়ো-অ্যাকুমুলেশন আর ছোট বিন্দু থেকে জমতে জমতে যে বড় আকার হয়ে গেল, এটাই বায়ো-ম্যাগনিফিকেশন। মারকারি কিন্তু শরীরের এক জায়গাতে বসে থাকে না। মারকারি শরীরের ফ্যাট সেলে জমা হতে থাকে, এবং এক পর্যায়ে নার্ভাস সিস্টেমের ভিতর দিয়ে ব্রেনে যেয়ে আশ্রয় নেয়। শুরু হতে পারে ব্রেনের ম্যালফাংশন। মস্তিস্ক বিকৃতি থেকে এপিলেপ্সি, সিজার সবই হতে পারে। অবশেষে মৃত্যু। এরকম বহু উপাদান প্রকৃতিতে আছে যা বায়ো-অ্যাকুমুলেশন ও বায়ো-ম্যাগনিফিকেশনের কারণ ঘটায়।
বাংলাদেশে সদ্য যা ঘটে গেল তা বায়ো-অ্যাকুমুলেশন ও বায়ো-ম্যাগনিফিকেশনের মতো ছাত্র-জনতার ক্ষোভ ধীরে ধীরে পুঞ্জীভূত হয়েছে আর কোটা আন্দোলনে তা জ্বলে উঠেছে। কিসের এত ক্ষোভ, কেন ক্ষোভ! অসংখ্য কারণের, আমার মতামত অনুয়ায়ী, প্রধান কয়েকটার উল্লেখ করছি। আমি আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষন থেকে তুলে ধরছি। এ প্রসংগে উল্লেখ্য বহুদিন দেশে যাওয়া হয় না। এ লেখার বিষয়-বস্তু নিজের দেখা, নিজের শোনা, বিভিন্ন সময়ে মিডিয়াতে, খবরের কাগজে পড়ে তথ্য যাচাই করেই লেখা হয়েছে।
লেখা: জনাব সাদিকুল আওয়াল (https://web.facebook.com/sadiq.awal.39)
সংকলন: দৈনিক আলোকবর্তিকা।
পূনশ্চ: জনাব সাদিকুল আওয়াল অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী, তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিসারিজ এন্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের প্রাক্তন শিক্ষক এবং প্রথম ডিসিপ্লিন প্রধান ছিলেন।
Leave a Reply