কোটা বিরোধী আন্দোলন সম্পুর্নভাবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য অবজ্ঞা
সম্ভবত এই আন্দোলন অরাজনৈতিক হওয়ায় প্রথম দিকে সরকার খুব একটা আমলে নিয়েছিলেন বলে মনে হয়নি। সাধারণ একটা মুভমেন্ট ভেবে নেওয়া হয়েছিল। তাদের কাছে গিয়ে তাদের কথা শোনার প্রয়োজনীয়তা বোধটুকু জাগেনি। উপরন্তু প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকভাবে তাদের বিরত করার চেষ্টা চালানো হয়েছে।
অনেকে মনে করেন, সরকার ছাত্রলীগের মাধ্যমে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের রাস্তা থেকে হঠিয়ে দিতে চেয়েছিল। এর মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরা দেখাতে চেয়েছিল যে রাস্তায় যে কোনো আন্দোলনকে মোকাবেলা করার ‘রাজনৈতিক সক্ষমতা’ তাদের রয়েছে। এই আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছিল রবিবার ১৪ ই জুলাই ২০২৪ রাতে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “কোটা সুবিধা মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিরা পাবে নাতো রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?” অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আর এক কাঠি সরেস হয়ে বলেছিলেন, “কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে কতিপয় নেতারা যে সব বক্তব্য রেখেছে, আত্মস্বীকৃত রাজাকার, যারা নিজেদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ মানসিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছে; তার জবাব দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট।” এরপর থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নেমে আসে। তাদের দাবি হচ্ছে, ‘রাজাকারের’ সাথে তুলনা করে প্রধানমন্ত্রী তাদের সম্মানে ‘আঘাত’ করেছেন। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক হলের শিক্ষার্থীরা সোচ্চার হয়েছে দেখে অন্যরাও তাদের নিজ নিজ অবস্থানে প্রতিবাদে মুখর হয়। মুহূর্তের মধ্যেই নতুন নতুন স্লোগান সৃজিত হয় এবং সবচেয়ে জোরালো আওয়াজ ওঠে, ‘চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, সেখানে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিচ্ছেন – “তুমি কে, আমি কে? রাজাকার, রাজাকার।” এদেশের তারুণ্যের সবচেয়ে বড় গৌরবের বিষয় হচ্ছে যে তরুণরা দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছে। ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধে অসম সাহসিকতায় লড়াই করে তারা একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। পৃথিবীর খুব কম দেশই আছে যে দেশের তরুণরা এই গৌরব করতে পারে। এই তরুণ সমাজের আত্মত্যাগের কারণে দেশ স্বাধীন হলো, ২০০৮ সালে তার দল সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেল, সেই তরুণ সমাজেকেই তিনি কটাক্ষ করলেন, ভৎসনা করলেন। অথচ খুব সহজেই তিনি এই সমস্যার সমাধান করতে পারতেন। দেশের রাস্ট্রপতি প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর। তিনি খুব সহজেই দেশের রাস্ট্রপতিকে কাজে লাগাতে পারতেন। আগের রাস্ট্রপতিকে তো মাঝে মাঝে দেখা যেত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, উদ্বোধনে ফিতা কাটাকাটি করতে, পরিশেষে শ্রোতাদের সাথে চটুল কিছু কথাবার্তা বলে হাসির রসদ উগড়ে দিতে। কিন্তু বর্তমান রাস্ট্রপতি কিছুই করেন না। ওনার একটা সুযোগ ছিল । উনি কোটা আন্দোলনের প্রারম্ভেই যদি আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে গিয়ে গায়ে মাথায় হাত দিয়ে বলতেন, কি হয়েছে বাবারা, কি হয়েছে মায়েরা আমাকে বলো তো! আমি নিজে তোমাদের প্রধানমন্ট্রীর কাছে নিয়ে যাব। তোমাদের হয়ে আমি তোমাদের আর্জি তাকে শোনাব। আন্দোলন তো ওখানেই শেষ হয়ে যেত। মরতে হতো না আবু সাঈদকে, মরতে হতো না কয়েকশত শিক্ষার্থী আর সাধারন জনতাকে। ধ্বংস হতো না দেশের বিপুল সম্পদ, পড়তো না দেশ এমন অরাজকতার কবলে।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকে কেউই কখনও দমাতে পারেনি, ইতিহাস তাই স্বাক্ষী দেয়। শেখ হাসিনাও পারেনি। শেখ হাসিনার দেশত্যাগের সংবাদ প্রকাশ হলে দেশের সিংহভাগ মানুষকে যেভাবে দলে দলে রাস্তায় নেমে এসে উল্লাস করতে দেখা গেছে তা অভাবনীয়। শেখ হাসিনার এই পতন দেশের মানুষের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। বিনা ভোটে বার বার নির্বাচিত হয়ে দেশের সকল ক্ষমতার নিরঙ্কুশ মালিক বনে যাওয়ার অহংবোধ ও দাম্ভিকতা সরকার প্রধান শেখ হাসিনাকে এমন এক জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল যে, নিজের ইচ্ছার বাইরে আর কোনো কথাকেই গুরুত্ব দেয়ার পর্যায়ে তিনি ছিলেন না। তার এই অহঙ্কার আর দাম্ভিকতা তার পতনের কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতে দিল।
এদেশ তোমাদের, তোমরাই সব।
বাংলাদেশের বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো যা পারেনি এতদিন, ছাত্ররা তা পেরে দেখিয়ে দিল। রাস্তায় অবস্থান করে নিরস্ত্র থেকে একটি দেশের পরিবর্তন এনে দিল এবং তাদের দাবি ও শপথ, বাংলাদেশকে বৈষম্যহীনভাবে গড়ে তোলা। দেশের মানুষকে দীর্ঘদিনের স্বৈরাচারী পরিবেশ থেকে মুক্ত করেছ, তোমরা তরুণেরা । তোমাদের বুকে অনেক ক্ষোভ অনেক হতাশা জমেছিল। তোমাদের কষ্টে আমাদের হৃদয়েও রক্তক্ষরণ হয়েছে! তোমরা ভালো না থাকলে আমরা ভালো থাকি কি করে?
এদেশের শিক্ষার্থী-তরুন সমাজ একটি স্বাধীন দেশের জন্যে সেই ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে নিজেদের জীবন দিয়ে বাঙালি জাতির জন্যে ত্যাগ স্বীকার করে আসছে। ১৯৬২ সালে শিক্ষার অধিকার দাবিতে রক্ত দিয়েছে এই তরুন তরুণীর দল। ১৯৬৯ সালে ১১ দফা দাবি প্রতিষ্ঠার জন্যে রক্ত দিয়েছে, সবার আগে তারাই ঝাপিয়ে পড়েছে দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার জন্যে। এদেশ স্বাধীন হয়েছে সেই ৭১ সালে। এই দেশ স্বাধীন করতে ৩০ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছে, ২ লক্ষ নারী ধর্ষিত হয়েছে। কোটি কোটি মানুষের জীবনে অমানিশার অন্ধকার নেমে এসেছিল। আমরা নিজে সেই দুঃসময়ের ভূক্তভোগী। কত কোটি মানুষ যে প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল দেশ ও জাতি কোনোদিন তার হিসাব করেনি। সেই স্বাধীনতাকে কখনই কটাক্ষ কোরো না, কটাক্ষকারীকে প্রশ্রয়ও দিও না। দেশ মাতৃকার জন্যে নিঃস্বার্থভাবে শহীদ হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সন্মান দেখাতে ভুল কোরো না। দেশকে স্বাধীন মর্যাদায় এনে দিতে যারা নেতৃত্ব দিয়েছে তাদের প্রতি কোনো অসন্মান আচরন দেখিও না, অসন্মান আচরণ করতেও দিও না। দেশের বিজয়, জাতির বিজয় স্বাধীনতা, এগুলো পরমকরুণাময়ের নেয়ামত। সেই নেয়ামতকে অস্বীকার কোরো না। আমাদের স্বাধীনতাকে কটাক্ষ করা কোনো আচরণ, স্বাধীনতাকে অবমাননাকর কোনো মন্তব্য, হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধ আর দেশ স্বাধীনতার চেতনাধারী কোনো বাঙালি সহ্য করবে না। বায়ো-অ্যাকুমুলেশন আর বায়ো-ম্যাগনিফিকেশনের মতো প্রভাব প্রতিটি মানুষের ভিতরেই কাজ করে। আমরা আবেগপ্রবণ জাতি, আরও বেশি করে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষা করা তোমাদেরই দায়িত্ব। এগুলো ধ্বংস হয়ে গেলে কি দেখাবে তোমরা তোমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের? কি জবাব দেবে তাদের কাছে? বরেণ্য ব্যক্তিকে যোগ্য সন্মান না দেখালে কি হয় তা আমরা শেখ হাসিনাকে দিয়েই দেখলাম। যে পরিমান অসন্মান, অপমান, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য সে বিশ্বে প্রসংশিত বরেণ্য নোবেল লরিয়েট প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুস কে দেখিয়েছে তার প্রতিদান সে পেয়ে গেছে। এমন জঘন্যভাবে একজন রাস্ট্র প্রধানের পালানো পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। হিটলারও তার দেশ ছেড়ে পালায়নি। হিটলার আত্মহত্যা করেছিল।
তোমরা আজ দেশ মেরামতের কাজে লেগে গেছ। ট্রাফিক কন্ট্রোল করছো, দুস্থদের কাছে গিয়ে দাড়াচ্ছ, সন্তানহারা বাবা-মায়ের পাশে গিয়ে সান্তনা দিচ্ছ। রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছ, আবর্জনা পরিস্কার করার কাজে লেগে গেছ। তোমাদের কাজে-কর্মে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। কি চমৎকার দৃশ্য! এভাবেই দেশ থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করো সমস্ত জঞ্জাল, অপশক্তি, অপসংস্কৃতি, রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতি। তোমরা কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড় না, তোমাদের কোনো রাজনৈতিক দল নেই। তোমাদের একটাই দল “চির তরুণের দল”, দেশের ১৮ কোটি মানুষ তোমাদের দলের কর্মী। আর এই ২০২৪-এ তোমাদের অবদান ইতিহাসের মধ্যে ইতিহাস হয়ে থাকবে বাংলার বুকে। আমরা, এই আধমরাদের দল, যেন পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার কালে দেখে যেতে পারি, পৃথিবীর বুকে অনাবিল এক শান্তির দেশ, বাংলাদেশ, যার কারিগর তোমরাই, আমাদের নবীনেরা। মনে রেখো এ দেশ তোমাদের, তোমরাই সব।
(সমাপ্ত)
লেখা: জনাব সাদিকুল আওয়াল (https://web.facebook.com/sadiq.awal.39)
সংকলন: দৈনিক আলোকবর্তিকা।
পূনশ্চ: জনাব সাদিকুল আওয়াল অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী, তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিসারিজ এন্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের প্রাক্তন শিক্ষক এবং প্রথম ডিসিপ্লিন প্রধান ছিলেন।
দ্বিতীয় পর্বের লিংক https://dainikalokbortika.com/%e0%a6%86%e0%a6%93%e0%a7%9f%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a7%80-%e0%a6%b2%e0%a7%80%e0%a6%97%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%b2%e0%a6%9c%e0%a7%8d%e0%a6%9c%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a6%a8%e0%a6%95-%e0%a6%93-%e0%a6%b6-2/
Leave a Reply