আমার খুব আফসোস হয় এখন। কেনো পেশা হিসেবে শিক্ষকতা আমার পছন্দের তালিকায় প্রথম সারিতে থাকেনি? গুরুজনেরা মাথার ভিতর ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার পেশার পাশাপাশি শিক্ষকতাকে কেনো ঢুকিয়ে দেননি সেই ভাবনায় আশ্চর্য বোধ করি। এক সময় তো সমাজে শিক্ষকতাকে সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পেশা হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা ছিলো। তাহলে কেনো আমরা শুধু ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবার পিছনে মরণ নেশায় ছুটেছি? তারচেয়ে শিক্ষক হবার স্বপ্ন নিয়ে বড় হলে নিশ্চয়ই শিক্ষক সমাজের সাথে মিলেমিশে অন্তত একটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মৌলিক বিষয়গুলো ধরে রাখতে পারতাম। অন্তত এখনকার দিনের কিছু শিক্ষকদের মতো মাথা বিক্রি করে দিতাম না, শিক্ষক হিসেবে সর্বোচ্চ ব্যক্তিত্ব অর্জন করে শিক্ষার্থীদের পাঠদান এবং নৈতিকতার শিক্ষাগুলো দিতে পারতাম! আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বকে একজন শিক্ষক হিসেবে পাবার পরও বিচিত্র কারণে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নেয়ার ইচ্ছে কখনো হয়নি।
এখানেই আসলে গলদ! দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভবিষ্যতে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়ার স্বপ্ন দেখেন না। খুব মেধাবী যারা, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন অথবা ভালো ফলাফল করেন তাঁরা শিক্ষক হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তে আগ্রহী হন। কিন্তু সাধারণ্যে তথাকথিত ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবার স্বপ্ন যতটা দেখা হয় তার পাঁচ ভাগও শিক্ষক হবার স্বপ্ন দেখে না। বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে যারা শিক্ষা ক্যাডারে নির্বাচিত হন অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাবে তাঁর প্রাথমিক পছন্দের তালিকায় প্রশাসন, ট্যাক্স, পুলিশ এসব ক্যাডার ছিলো। মেধানুসারে উপরের ক্যাডারে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে না থাকতে পেরে শিক্ষা ক্যাডার পেয়ে অনেকেই হতাশা প্রকাশ করেন। কেউ কেউ বয়স যতোদিন থাকে ততোদিন ধরে ক্যাডার পরিবর্তনের চেষ্টা চালিয়ে যান ও কেউ কেউ সফল হন। তাই সহজেই অনুমান করা যায় আমাদের সমাজে চাকুরীর বাজারে শিক্ষকতা পেশা হিসেবে আকর্ষনীয় নয়। শিক্ষকদের প্রশাসনিক ক্ষমতা সীমিত, আয় রোজগার অন্যান্য পেশার তুলনায় খুবই কম এইরকম কিছু গুপ্ত কারনেই শিক্ষক হিসেবে তুলনামূলক কম মেধাবীরা নিয়োগ পেয়ে যান। এই সুযোগে নিয়োগ কমিটির সদস্যরা নিলামে উঠিয়ে অধিক মুনাফা নিশ্চিত করে উপযুক্ত শিক্ষক হিসেবে প্রকৃত যোগ্যতার বিচার ছাড়াই নিয়োগ দেয়ার সুযোগ গ্রহণ করে। দেখা যায় কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির কোন কোন সদস্য একদম লেখাপড়াই জানেন না বা স্বল্প শিক্ষিত। অথচ নিয়োগ কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে তিনি হয়তো স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাশ একজন প্রার্থীর ভাইভা নিচ্ছেন!
এভাবেই নিয়োগ সিন্ডিকেটের পকেট ভরিয়ে একটা বড় সংখ্যক পেশাজীবি শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত আছেন দেশের বেসরকারি কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে। যে কজন হাতে গোনা মেধাবী মানুষ শিক্ষকতা পেশায় ভালোবেসে যুক্ত হয়েছিলেন, শিক্ষকতার মহান আদর্শ ধারণ করেন ও শিক্ষক হিসেবে শতভাগ দেবার মতো যোগ্যতা আছে তাঁরা এই কম মেধাবীদের দাপটে কোনঠাসা হয়ে পড়েছেন। কারন একটু কম মেধাবী বা দূর্বল ব্যক্তিত্বের অধিকারী শিক্ষকগণ নিজেদের সুযোগ সুবিধা অব্যাহত রাখতে মেধাবী শিক্ষকদের ছলে বলে কলাকৌশলে একঘরে করে ফেলেন। ম্যানেজিং কমিটির ধান্দাবাজ সদস্যরাও অমন ব্যক্তিত্বহীন কম মেধাবীদের নয় ছয় বুঝিয়ে অবৈধ আয়ের পথ সহজলভ্য করতে ওদেরই অগ্রাধিকার দেন, মেধবীদের সবসময় চাপের উপর রেখে শিক্ষার মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করতে থাকে।
শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই যার পক্ষে মন্ত্রী বা প্রভাবশালী কারো সুপারিশ থাকে এবং যে নিলামে সবচেয়ে বেশী দর দিতে সম্মত হন তাকেই চূড়ান্তভাবে নিয়োগ প্রদান করা হয়। তাকে আগেভাগেই লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার প্রশ্ন সরবরাহ করা হয় এবং যথারীতি সে সকল পরীক্ষায় প্রথম হয়। রেজুলেশন লিখে সহজেই তাকে নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্তে একমত হয়ে পড়েন নিয়োগ কমিটির তথাকথিত শিক্ষাবন্ধুগণ! এটা ওপেন সিক্রেট, নিয়োগ নির্দিষ্ট ব্যক্তিকেই দেয়া হবে তা পূর্বেই নির্ধারিত। সেখানে আরো ভালো বা মেধাবী প্রার্থী অংশগ্রহণ করলেও তাঁর ভাগ্যে শিকে ছিড়বে না যদি সুপারিশ ও টাকার অংকে নির্দিষ্ট চাকুরী প্রার্থিকে পরাজিত করতে না পারেন। তাই ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে যেকোন নিয়োগ এখন চোখে ধুলো দেয়ার অপর নাম, আজকাল আমরা যেমন টেন্ডার সিন্ডিকেটের কথা শুনে থাকি, এটাও তেমন নিয়োগ সিন্ডিকেট!
এমন নির্লজ্জ কাজগুলো কিন্তু সমাজে মোটেই কোন প্রভাব ফেলে না। সবাই ধরেই নেন যার টাকার জোর আর খুঁটির জোর বেশী সে যতোই অযোগ্য হোক সেই নিয়োগ পাবার যোগ্য। এ যুগে মেধা ধুয়ে কি পানি পান করবে? শুধুমাত্র হতাশ হয়ে যান সেই প্রার্থী যিনি সত্যিকারের মেধাবী বা যোগ্য ছিলেন শিক্ষক হিসেবে। তখন তাঁর মাধ্যমেই জানা যায় চূড়ান্তভাবে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক কত টাকার বিনিময়ে এই পদটি বাগিয়ে নিতে পারলেন। আমার খুবই দুঃখ লাগে আমার শৈশবের মেধাবী বন্ধু, ক্লাসে যার রোল নাম্বার এক ছিলো, যে আমাদের ক্লাসের অন্যান্য দূর্বল বন্ধুদের অংক বুঝিয়ে দিতো সেইই একজন অযোগ্য প্রার্থীর টাকার জোরের কাছে পরাজিত হয়ে আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার সুযোগ পায়নি! এমনভাবে নিয়োগের সিন্ডিকেট আমার শৈশবের মাধ্যমিক বিদ্যালয়টির কোমর পুরোপুরি ভেংগে দিতে সমর্থ হয়েছে। এখন আমাদের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এমনই একজন চরম ব্যক্তিত্বহীন ব্যক্তি যার আসলে শিক্ষক হবারই কোন যোগ্যতা নেই। শিক্ষক হিসেবে নূন্যতম আদর্শ তার মাঝে অবশিষ্ট নেই। অথচ ম্যানেজিং কমিটির কাছে তিনি খুবই করিৎকর্মা শিক্ষক হিসেবে স্বীকৃত! কারন নিয়োগগুলোর সময় তার মাধ্যমে দর কষাকষিটা বেশ ভালোভাবেই করা যায়!
চলবে ………………………………
পল্লব খন্দকার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩
mazhabkh93@gmail.com
Leave a Reply