প্রথম পর্বঃ
আইন আদালতের ব্যাপারে আমার দৌড় ছিলো নাটক সিনেমায় দেখা পরিপাটি শৃঙ্খলাবদ্ধ বিচারকের কক্ষ, মান্যবর জজ সাহেব, বিজ্ঞ আইনজীবি, বিচার প্রত্যাশী বাদী ও কাঠগড়ায় দাঁড়ানো অপরাধী, স্বাক্ষী, পেশকার, মোক্তার, মামলা তদন্তকারী পুলিশ ইত্যাদির সমন্বয়ে এক পবিত্র ও ভাবগাম্ভীর্য্যপূর্ণ পরিবেশের চিত্র পর্যন্ত। আমার মতো আমজনতার অধিকাংশের জীবনে আদালতের এই পবিত্র ভাবমূর্তির সজ্জিত অবকাঠামোর বাইরে কিছু দেখার সুযোগ না পাওয়াই ভালো! আমরা জানি ‘বাঘে ছুঁলে এক ঘা আর পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা’, কিন্তু কারো আদালতে যাবার প্রয়োজন হলে কতো লক্ষ ঘাত-প্রতিঘাতের কবলে পড়তে হতে পারে তার হিসাব কিন্তু অনির্দিষ্ট। যদিও আমরা চাই না আমাদের সহজ জীবনকে আদালতের আঙ্গিনা পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে কিন্তু অনিশ্চিত এই জীবনের কোন এক ঘটনা-দূর্ঘটনার স্বীকার হয়ে আমাদের বাধ্য হতে হয় কখনো কখনো ন্যায় বিচার পেতে আদলতের দ্বারস্থ হবার।
নিজের জন্য নয়, পুরাতন কর্মস্থলের পক্ষে দায়ের করা একটি অর্থ আত্মসাৎ মামলার বাদী হিসেবে আজ থেকে প্রায় এক দশক পূর্বে আমার জীবনে প্রথমবারের মতো আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে স্বাক্ষ্য দেবার জন্য নীলফামারী জেলা দায়রা জজ আদালতে উপস্থিত হতে হয়েছিলো। আমারই করা সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদনের উপরই মামলাটি দায়ের করা হয়েছিলো বিধায় সাবেক সংস্থার পক্ষ থেকে আমাকে বারবার অনুরোধ করা হয়েছিলো মামলাটি চলমান রেখে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করবার জন্য। অনেকটা বিবেকের তাড়নায় ঢাকা থেকে রাত্রিকালীন বাসযোগে ভ্রমণ করে সকালবেলায় আদালতে হাজিরা দিতে গিয়েছিলাম। স্বভাবতই জীবনে প্রথম আদালতের আঙ্গিনায় পা রেখে আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলাম, যথেষ্ট স্নায়ুবিক চাপ অনুভব করছিলাম কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে! আসামী পক্ষের আইনজীবি আমার নাম পরিচয় জানতে চেয়ে সোজাসুজি বলে দিলেন আপনি আমার মক্কেলকে হয়রানি করার জন্য এই মিথ্যা মামলা দায়ের করেছেন। আমি অপ্রস্তুত ছিলাম এমন অভিযোগের বিষয়ে, কিছুটা সামলে নিয়ে বললাম- আমি সরেজমিন তদন্ত করে যে প্রতিবেদন দাখিল করেছি সেখানেই সবকিছু প্রমাণসহ উল্লেখ করা আছে। আরো কিছু বলতে চাইলে মহামান্য আদালত বললেন- “উনি যে অভিযোগ করেছেন তা সত্য না না মিথ্যা সেটা বলেন”। আমি আদালতে কথা বলার নিয়মকানুন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিলাম বিধায় নিজের আরো কথা বলতে গিয়ে থেমে গিয়েছিলাম, নিজের সব বক্তব্য না দিতে পেরে একটু অস্বস্তি নিয়ে হলেও বললাম- মিথ্যা।
এরপর ২০১৯ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকা বিজ্ঞ চীপ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এর আদালতে উপস্থিত হতে হয় বর্তমান কর্মরত কোম্পানির একটি চেক ডিজঅনার মামলার বাদী হিসেবে। নীলফামারী জেলা দায়রা জজ আদালতে একদিন মাত্র উপস্থিতির অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করেই ঢাকার আদালতে যাবার আগে কিছু প্রস্তুতি নিয়েই গিয়েছিলাম, আয়নার সামনে একটু অনুশীলনও করলাম যাতে এবার বিবাদী পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবি আমাকে আচমকা প্রশ্ন করে ভড়কে না দিতে পারেন। তবে সে সুযোগ পাবার আগে লিফটে ওঠার বিরাট সিরিয়াল দেখে ভড়কে গিয়ে হাজার হাজার মানুষের সাথে পাল্লা দিতে দিতে হন্তদন্ত হয়ে সাত তলা সিড়ি বেয়ে উপরে ওঠার পর আদালত কক্ষে প্রবেশ করে যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হলাম তাতে আমার সকল প্রস্তুতি ভেস্তে গেলো! সমস্ত আদালত কক্ষে তিল ধারণের ঠায় নেই, বসার জায়গা যৎসামান্য, উপস্থিত অধিকাংশ মানুষজনই দাঁড়িয়ে আছেন! এখানে সেখানে অবিন্যস্তভাবে ছড়ানো ছিটানো মামলা সংক্রান্ত নথির স্তুপ, গরমে ত্রাহিত্রাহি অবস্থা। এরই মধ্যে মহামান্য আদালতে বিচারক উঠলেন এবং বিচারকি প্রক্রিয়া অনুযায়ী কার্যক্রম আরম্ভ হলো। মামলার নাম্বার ধরে ধরে আইনজীবি, বাদী ও বিবাদী পক্ষের শুনানি চলছে, দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে পরবর্তী মামলার কার্যক্রম শুরু হচ্ছে।
আমার নাটক সিনেমায় দেখা পরিপাটি আদালতের কল্পনার চিত্রটি ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেলো। এভাবেই ৩ বছর ধরে আমাদের মামলার কার্যক্রম চলতে থাকলো, বিজ্ঞ চীপ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এর আদালত থেকে মামলা ঢাকা জেলা দায়রা জজ আদালতে স্থানান্তর করা হলো। নিয়মমতো হাজিরা, বিজ্ঞ আদালতের আদেশ অনুযায়ী মামলার কার্যক্রম চলছে। আসলে মামলার গতি প্রকৃতি যে কোথা থেকে কিভাবে চলছিলো সেসব ছিলো আমার জ্ঞানের বাইরে। একেকবার মামলার তারিখ পড়তো কমপক্ষে তিনমাস থেকে সর্বোচ্চ সাত মাস পরপর, এরমাঝে করোনাকালীন আদালতের বিচার কার্যক্রমে বাঁধা পড়ে, এছাড়া ডিসেম্বরে আদালতের ছুটির বিশেষ কারনও যুক্ত হয়েছিলো।
দীর্ঘ মামলা কার্যক্রমে ন্যায় বিচার পাবার আশায় আমার কোম্পানির পক্ষ হতে তিনবার আইনজীবি পরিবর্তন করলাম, সিনিয়র আইনজীবি ও নামকরা আইন সংস্থার স্মরনাপন্ন হলাম। এই ক্লান্তিকর যাত্রায় হতাশা এসে গেলেও ন্যায় বিচারের আশায় মামলার তারিখ পড়লেই সব গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে আদালতে হাজির হতাম। একদিন বিবাদীর অনুপস্থিতি নিয়ে তাঁর পক্ষের আইনজীবির পেশ করা অন্যায্য যুক্তির উপর নাখোশ হয়ে মহামান্য আদালত পরবর্তী তারিখে মামলার স্বাক্ষ্য গ্রহণের আদেশ দিলেন এবং আমাকে বললেন- আপনি ভাগ্যবান, নাহলে এই আদেশ পেতে কমপক্ষে আরো ছয় মাস এক বছর লেগে যেতো!
একদিন অন্য একটি মামলার শুনানি চলাকালীন মহামান্য আদালত দুঃখ করে বলছিলেন এই কোর্টে ২০১৫ সালের চেক ডিজঅনার মামলার এখনো নিষ্পত্তি হয়নি আর আপনি কিনা ২০২০ এ করা মামলার নিষ্পত্তি করতে এতো তাড়াহুড়ো করছেন? শুনে আমি প্রমাদ গুনলাম! ভাবতে থাকলাম প্রতিদিন আমার মতো শত শত বিচার প্রার্থী এভাবেই আদালতের দারস্থ হন, এভাবেই দিনের পর দিন বছরের পর বছর তাঁদের পাওনা টাকা উদ্ধারের আশায় অপেক্ষা করতে হয়! ব্যাংক চেকের মতো জ্বলজ্বলে প্রমাণ হাতে থাকার পরেও নিজেদের পক্ষে রায় পেতে যদি এতোটা সময় ক্ষেপন হয়ে থাকে, না জানি অন্যান্য ক্রিমিনাল মামলাগুলোর ক্ষেত্রে কি ঘটে থাকে?
সম্প্রতি জাতীয় সংসদে আইনমন্ত্রীর দেয়া তথ্য মতে সারা দেশে নাকি চল্লিশ লক্ষের বেশী মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় প্রহর গুনছে! ব্যাংক চেক ডিজঅনার মামলা এতো দীর্ঘ সময় চলার কারনে অনেক মামলার বাদী কোম্পানির চাকুরি হতেই অব্যাহতি নেন, কেউ বা বদলী হয়ে যান অনেক দূরের কোন শাখা অফিসে। কখনো বাদী, কখনোবা বিবাদী কোর্টে হাজির না হয়ে নিয়োগকৃত আইনজীবির মাধ্যমে মামলার শুনানি পরবর্তী তারিখের জন্য সময় আবেদন বা টাইম পিটিশন করে সময়ক্ষেপন করার কৌশল নেন। এভাবেই ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে মামলাটিকে পোক্ত বা ম্যাচিউরড করার একটা প্রথা আছে আদালতের বিচারকি ব্যবস্থায়। দ্রুত বিচারের কারনে ভুলবশত অন্যায্য বিচার হবার সম্ভাবনা থাকতে পারে, এজন্যই আইনের ছত্রছায়াতেই সময় ক্ষেপনের বিষটিকে গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়।
(চলবে)
পল্লব খন্দকার, ০৩ আগস্ট ২০২৩
mazhabkh93@gmail.com
Leave a Reply