শেষ পর্বঃ
আমাদের সংবিধানের ২৭, ৩১ ও ৩৫ অনুচ্ছেদে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের আইনের আশ্রয় গ্রহণ, ন্যায় বিচার চাওয়া ও পাওয়ার অধিকার দিয়েছে। সেই উদ্দেশ্যে সকলের জন্য আইনের সমান সুযোগ গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের জন্য জেলা পর্যায়ে নিম্ন আদালত এবং রাজধানীতে উচ্চ আদালত স্থাপন করেছে সরকার। যদিও ছোট্ট একটি দেশে বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য স্থাপিত আদালত, বিচারক সংখ্যা, আইনজীবী ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো ও জনবল যথেষ্ট কিনা তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। সকল নাগরিকের সমান অধিকার বাস্তবায়নের এ সকল সহযোগী প্রতিষ্টান যে অপ্রতুল তা খুব সহজেই অনুমান করা যায়। সে কারনেই আমরা যানজট, জলজট এর মতো মামলা জট শব্দটি আবিষ্কার করেছি।
একটি মামলা নিষ্পত্তি হতে দীর্ঘ সময় চলে যায় বিধায় সাধারণত অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন ব্যতীত সহজে কেউ আদালতমুখী হতে চান না। যদিও কিছু মানুষের স্বভাব আছে কারন অকারনে আদালতে ছুটে গিয়ে সত্যি মিথ্যা মিলিয়ে মামলা ঠুকে দেয়া। এরা অত্যন্ত কুটিল প্রকৃতির হয়ে থাকে, তাদের নিয়োজিত আইনজীবি নিজের আইন পেশার প্রসারের স্বার্থে মামলাগুলোর গুনাগুণ বিচার না করেই বছরের পর বছর মামলা চালিয়ে যেতে উৎসাহ দিয়ে যান। কথিত আছে নিজের মক্কেলের পক্ষে আইনী লড়াইয়ের সময় পেশ করা যুক্তি মিথ্যা জেনেও করা যায় আইন পেশায়। এই কারনে আমাদের স্কুলের প্রাক্তন এক শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষক আইন পাশ করেও আদালতে গিয়ে মক্কেলকে বাঁচাতে মিথ্যা বলা লাগতে পারে দেখে আইন পেশা ত্যাগ করে শিক্ষকতায় নিযুক্ত হয়েছিলেন।
আমাদের সমাজের নির্মম বাস্তবতা হলো আইনজীবী, আদালত, বিচার ইত্যাদি বিষয় থেকে মানুষ একটু দূরে দূরেই থাকতে চান। যদিও অধিকাংশ উকিল মক্কেলের পক্ষে ন্যায় বিচার পাবার জন্য আদালতে যুক্তিতর্ক পেশ করেন। তবে আইন আদালত নিয়ে এদেশের বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠী অজ্ঞ হওয়ায় অনেক উকিল সাহেবরা মক্কেলকে হয়রানি করতেও ছাড়েন না। আর নিম্ন বা উচ্চ আদালতের বিচারকদের নিয়েও ইদানীং মানুষের ধারনা খুব উঁচুমানের নয়। পবিত্র আদলত প্রাঙ্গনে উকিলদের প্রাকশ্যে দলবাজি, মারামারির দৃশ্য দেখে বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থার সংকট আসতেই পারে। এর পাশাপাশি একেকটি মামলার বিচার সম্পন্ন হতে যে অনির্দিষ্টকাল সময়ক্ষেপণ হয় তাঁতে অনেকাংশেই ন্যায়বিচারের অপমৃত্যু ঘটে থাকে। ইংরেজিতে তো কথাই আছে “Justice Delayed, Justice Denied”.
তবুও আমি ন্যায় বিচার পাবার আশায় নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিতাম, অপেক্ষায় থাকতাম যে এবার বুঝি টাকাগুলো ফেরত পাওয়া যাবে। কিন্তু স্বাক্ষ্য গ্রহণের দিন আসামী পক্ষের আইজীবি আমাকে জেরা করার সময় বললেন- “আমার মক্কেল আপনাদের পাওনা সম্পূর্ণ পরিশোধ করেছেন, আপনারা আমার মক্কেলকে হয়রানি করার জন্য এই মামলা করেছেন।“ এই বানোয়াট কথা শুনে আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে পড়েছিলাম, আমি যুক্তি দিয়ে বলতে চেষ্টা করলাম উনি টাকা দিলে তার প্রমাণ দেখাক। তখন বিচারক বললেন- আপনি শুধু বলেন এই অভিযোগ সত্যি না মিথ্যা? আমি জোর গলায় বললাম- অবশ্যই মিথ্যা। সেদিনের মতো আমার স্বাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হলো এবং পরবর্তী তারিখ দেয়া হলো সাত মাস পরে আসামীর স্বাক্ষ্য গ্রহণের! মামলাজটের এমন মহা ঘুর্ণীবতে এভাবেই কি ন্যায় বিচার খাবি খেতে থাকে। দশ কুড়ি লক্ষ টাকা উদ্ধারে যদি এভাবে সময় ক্ষেপণ হয় কতোদিন মানুষের ধৈর্য্য থাকতে পারে? এক সময় হতাশা আসে, নিজের করা মামলাটিকেই তখন হয়রানীমূলক মনে হয়। অনেকটা ছেড়ে দে মা কেঁদে বাচি’র মতো অবস্থা।
অত্যন্ত ব্যথিত হৃদয়ে এই কলামে লিখতে হচ্ছে যে, আমাদের চেক ডিজঅনার মামলার আসামী নিজের পরবর্তী স্বাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ আসার পূর্বেই আকস্মিক স্ট্রোক করে মৃত্যুবরণ করেন! এক্ষেত্রে যা হবার তাই হয়েছে, আমরা আমাদের আইনজীবিকে মামলাটি প্রত্যাহার বা তামাদি করার অনুরোধ করেছিলাম। কারন মৃত ব্যাক্তির সাথে তো আর আইনি লড়াই করা যায় না? এভাবেই সময়ক্ষেপণ চলতে চলতে আমাদের মামলার মতো ভাগ্যবরণ করতে হয় অসংখ্য মামলার। কখনো কখনো মনে হয় সৃষ্টিকর্তা আমাদের উপর করুণা করে নিজ হাতেই কিছু মামলা এভাবেই খতম করে দেন! তিনিই তো সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক।
পল্লব খন্দকার, ০৩ আগস্ট ২০২৩
mazhabkh93@gmail.com
Leave a Reply