আখতার হোছাইন অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্লোরে নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড মেন্টাল হেলথ ইনস্টিটিউটের ইনসুলিন পেপটাইডস ল্যাবের প্রধান। লেখার শুরুতে উল্লেখ করা বাক্যটি যতো সহজে লেখা সম্ভব হলো, আসলে তার বিপরীতেই ছিলো কঠিন এই অর্জনের পিছনের গল্পটি। কারন আমরা জানি এই বাংলার একটি কৃষক পরিবারের সন্তানের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার সংগ্রাম কতোটা অমসৃণ এবং পদে পদে হারিয়ে যাবার সম্ভাবনায় কতোটা শঙ্কিত থাকতে হয় সর্বদা। অদম্য মেধাবী এই দামাল ছেলের দল যখন সব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে বিশ্ব জয় করেন তখন আনন্দশ্রুতে দু-চোখ ভেসে যায়, বুকের মাঝে বেজে ওঠে- "আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি--------"।
আজ জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর অনলাইন ভার্সনে একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা সাফল্যের খবর এসেছে, মানব চিকিৎসায় যুগান্তকারী সেই গবেষণার বিস্তারিত পড়তে গিয়ে যখন দেখলাম একজন বাংলাদেশি সেই গবেষণা দলের নেতা তখন বুকে একটি অনাবিল আনন্দের শিহরণ বয়ে গেলো। খবরটি একটু জেনে নিই- "মানবদেহে থাকা প্রোটিনের পেপটাইডভিত্তিক ওষুধ তৈরির নতুন এক রাসায়নিক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্লোরে নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড মেন্টাল হেলথ ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। প্রোটিনের গঠনের সঙ্গে আকৃতিতে মিলে যায়, গবেষণাগারে এমন কৃত্রিম পেপটাইড তৈরির নতুন রাসায়নিক পদ্ধতি তাঁরা উদ্ভাবন করেছেন। এই পদ্ধতির নাম ‘নন-কোভ্যালেন্ট পেপটাইড স্ট্যাপলিং’। এই পদ্ধতিতে স্বল্প সময়ে ও স্বল্প খরচে কৃত্রিম পেপটাইড তৈরি করা যাবে, যা প্রোটিনের মতো কার্যকর। এই পেপটাইড স্নায়ুরোগসহ মস্তিষ্কের বিভিন্ন রোগের ওষুধ তৈরিতে কাজে লাগানো যাবে। এই গবেষণা দলের নেতৃত্বে আছেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ আখতার হোছাইন। তিনি ফ্লোরে ল্যাবের দি ইনসুলিন পেপটাইডস গ্রুপের প্রধান এবং এই গবেষণা দলের নেতা।"
এরপর বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ আখতার হোছাইনকে নিয়ে প্রকাশিত আরো খবর পড়ে ভীষণ চমৎকৃত হলাম! সাধারণ থেকে অনন্যসাধারণ হয়ে ওঠা একজন মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠলো মন। যেটুকু জানলাম ১৯৭৪ সালের ১ মার্চ কুমিল্লা সদর উপজেলার অলিপুর গ্রামে এক কৃষক পরিবারে জন্ম আখতারের। বাবা আবদুর রহমান ও মা ফাতিমা রহমান, বয়স যখন দুই বছর, তখন মাকে হারান। আখতার জানান, ‘দাদির কোলে বড় হয়েছি আমি। দাদা, দাদি ও বাবার ইচ্ছায় মাদ্রাসায় পড়ি।’ ধনুয়াখলা মাদ্রাসা থেকে অষ্টম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষায় কুমিল্লা জেলায় প্রথম হন আখতার। এই ফল দেখে তাঁর প্রকৌশলী চাচা খলিলুর রহমান অনেকটা জোর করে কুমিল্লা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেন আখতারকে। কেননা ধনুয়াখোলা মাদ্রাসায় বিজ্ঞান বিভাগ ছিল না। কুমিল্লায় অন্যের বাড়িতে লজিং থেকে পড়াশোনা চালান। এরপর দাখিল পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করেন আখতার হোছাইন। এরপর খলিলুর রহমান তাঁর লেখাপড়ার সব দায়িত্ব নেন। আলিম পরীক্ষায় রেকর্ড নম্বর (৯০১) নিয়ে মেধাতালিকায় আবারও প্রথম স্থান অর্জন করেন আখতার। পরের ইতিহাস শুধুই এগিয়ে চলার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণরসায়ন বিভাগে ভর্তি হন তিনি। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর—দুই পরীক্ষাতেই অর্জন করেন প্রথম শ্রেণি। জাপান সরকারের মনবোসু বৃত্তি নিয়ে পিএইচডি করতে যান টোকিওর ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে। তাঁর অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল ‘পেপটাইড ড্রাগ সিন্থেসিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’। এরপর পোস্ট ডক্টরেট গবেষণা করেন ফ্রান্সের জোসেফ ফুরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০৫ সালে আখতার চলে আসেন অস্ট্রেলিয়ায়। যোগ দেন মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এখানেই শেষ নয় বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ আখতার হোছাইনের সাফল্যের সত্যিকারের গল্প, পাঁচ বছর আগে আখতার হোছাইন নতুন এক ধরনের ইনসুলিন আবিষ্কার করেছিলেন। সেই ইনসুলিন ফ্রিজ ছাড়াও সংরক্ষণ করা যাবে। আখতার হোছাইনের আরেকটি আবিষ্কার হচ্ছে গবেষণাগারে ‘ইনসুলিন পেপটাইড-৫’ নামের কৃত্রিম হরমোন, যা ক্ষুধা নিরাময়ে ভূমিকা রাখবে। হাঁপানির মতো ফুসফুসঘটিত নানা রোগের নিরাময়ে সম্ভাব্য ওষুধও বানিয়েছেন আখতার হোছাইন। যেকোনো রসায়নবিদের জন্য ‘জার্নাল অব দ্য আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি’ একটি স্বপ্নের প্রকাশনা। এবার এই গবেষণাপত্রসহ এই জার্নালে আখতার হোছাইনের প্রকাশিত এটি পঞ্চম গবেষণাপত্র। তাঁর নেতৃত্বে তৈরি হয়েছে ফাইব্রোসিসের সম্ভাব্য ওষুধ। ফুসফুসের ক্ষত সারাতে এ ওষুধ কাজে দেবে। হাঁপানির মতো রোগের নিরাময়ও হতে পারে। আবার ফাইব্রোসিসজনিত হৃদরোগেও কাজে দেবে এই ওষুধ। এ ছাড়া গত পাঁচ বছরে তিনি তৈরি করেছেন ডায়াবেটিসের ওষুধও। এসবের জন্য অস্ট্রেলিয়া সরকারের গবেষণা অনুদানও পেয়েছেন আখতার হোছাইন। এ বছর ফাইব্রোসিসের ওষুধ তৈরির জন্য অস্ট্রেলিয়া সরকার আখতার হোছাইনকে ৮ লাখ ডলার অনুদান দিয়েছে। পাঁচটি আবিষ্কারের প্যাটেন্ট রয়েছে আখতারের নামে।
এ দেশের মাটিতে বেড়ে ওঠা এমন হাজারো অদম্য মেধাবীরা ছড়িয়ে আছেন আনাচে-কানাচে, শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা আর উপযুক্ত অবকাঠামোর অভাবজনিত কারনে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ও মূল্যায়ন না পেয়ে তাঁরা দেশ ছেড়ে উন্নত বিশ্বের নাগরিক হিসেবে পাড়ি জমান। মাত্র দুই বছর বয়সে ড. মোহাম্মদ আখতার হোছাইন তাঁর মাকে হারান, অসম্ভব মেধাবী মানুষটি উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছেন। এরপরও তিনি একজন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী হতে পেরেছেন অসম্ভব মনের জোরে, সমস্ত প্রতিকূলতাকে তিনি সম্ভাবনায় পরিণত করতে পেরেছেন নিজের জীবনে! এ যেনো এক বিশ্বজয়ী যোদ্ধা, আমরা তাঁকে মূল্যায়ন করতে পারিনি কিন্তু ঠিকই লুফে নিয়েছে জ্ঞানপিপাসু পৃথিবীর মানুষেরা, সেই সুযোগে নিজের জ্ঞানের আলোয় তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে নিয়ে এসেছেন যুগান্তকারী সব উদ্ভাবন সমূহ। তাঁর অন্তর্গত আলোয় আজ সারা বিশ্বকে করছেন আলোকিত, তিনি এভাবেই বিশ্বমানব হিসেবে এই বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করুন আজীবন।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো অনলাইন ভার্সন (১৭ জুলাই, ২০২৩)
সংকলনঃ দৈনিক আলোকবর্তিকা ডেস্ক।