৯ ডিসেম্বর ২০২৩ দিনটি দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিবস হিসেবে পালিত হয়েছে বাংলাদেশে। আপাত দৃষ্টিতে কিছু নির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয় ও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে পালন করা বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস আমজনতার জন্য খুব বেশি উপকারী হয় বলে প্রমানিত নয়। বিশেষ করে ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী দিবস উদযাপনকে আমার কাছে খুবই চিত্তাকর্ষক মনে হয়! আপনি মানুন আর না মানুন দুর্নীতি আমাদের অস্থিমজ্জার সাথে একাকার হয়ে মিশে গেছে এ কথাটি নিশ্চিন্তেই বলতে পারেন। উদাহরণ হিসেবে অন্যের কথা নয়, নিজের কথাই বলতে পারি। সৌভাগ্যবশত সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রাইভেট কোম্পানিতে যথেষ্ট সময় কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে যদি আমাকে সঠিক বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় আমি নিশ্চিত দুর্নীতির সহযোগী হিসেবে প্রমাণিত হবো।
৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী দিবস উদযাপন:
আমাদের দেশের সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আপনি দুর্নীতির আখড়া হিসেবে নির্ভাবনায় আখ্যা দিতে পারেন। ঘুষ, মিথ্যা উপস্থাপন, প্রতারণা, হয়রানি, নির্যাতন, দলীয় বা গোষ্ঠীগত আচরণ, পুকুর চুরি, অপেশাদারিত্ব ইত্যাদি নিত্যাকার দুর্নীতির উপসর্গসমূহ আমাদের দেশের শাসন ব্যবস্থার প্রধানতম হাতিয়ার। টাকা বা পেশী শক্তির জোরে ক্ষমতাবানদের দ্বারা এদেশে কোন কাজ করাই অসম্ভব নয়। একারনে প্রচলিত কথা আছে সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশ! ধরুন আপনি যেকোন ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক সরকারি উচ্চপদস্থ আমলা, ব্যবসায়ী অথবা নেতা তাহলে আপনার জন্য এদেশে দুর্নীতির সকল দ্বার পুরোপুরি উন্মুক্ত। সত্যকে মিথ্যা বা মিথ্যাকে সত্য বলা আপনার জন্য ডালভাত ব্যাপার মাত্র! মজার ব্যাপার হলো আপনি যখুনি ক্ষমতাসীন দলের বাইরের সমর্থক গোষ্ঠী তখন বর্তমান সুবিধাপ্রাপ্তদের যে যে কাজগুলো অন্যায় বা দুর্নীতি মনে করছেন আপনাকে ক্ষমতাসীন দলে সুযোগ দিলেই সেই একই কর্মকান্ডগুলো আপনার কাছে জায়েজ মনে হবে।
এদেশে সৎ মানুষের মত বেকুব আর অসহায় কেউ নেই। সৎ সরকারি কর্মকর্তা হয়েছেন তো আপনাকে বদলি, বিভাগীয় হয়রানি, উর্ধবতন কতৃপক্ষের চোখ রাঙ্গানির সাথে সমগ্র চাকুরী জীবনে সংগ্রাম করতে হবে। আপনি উচিত কথার মানুষ হয়েছেন তো আপনাকে নিজের কাছের মানুষজনই এড়িয়ে চলবে অথবা বেশি বাড়াবাড়ি করলে জেল হাজত থেকে শুরু করে হামলা মামলা বা খুনের শিকার পর্যন্ত হতে পারেন। এদেশের মানুষের সাধারণ জীনগত বৈশিষ্ট্য এখন “জী হুজুর” জীনের সাথে মিউটেশন ঘটিয়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। সমাজে প্রতিবাদী মানুষদের এখন আর কেউ পছন্দ করে না, সবাই টু পাইস দিয়ে বা কামিয়ে কৌশলে কার্যোদ্ধারকে বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ বা স্মার্টনেস মনে করে।
৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী দিবস উদযাপন একটি পোশাকি রিহার্সেল মাত্র, এর কোন প্রভাব আমাদের সমাজে পড়বে তো না-ই বরং দুর্নীতির নতুন মাত্রা যুক্ত হবে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আমরা যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭৫ সালের বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমীর প্রথম ক্যাডেটদের অভিষেক অনুষ্ঠানে দেয়া একটি ঐতিহাসিক ভাষণের রেকর্ড শুনে থাকি তাহলেই বুঝতে পারবো আজ পঞ্চাশ বছর পেরিয়েও দুর্নীতিবাজদের অবস্থানের কোন পরিবর্তন তো হয়ইনি বরং এটি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভাইরাসের মতো বিস্তার ঘটিয়েছে। এক সময় দুর্নীতি ছিলো বড় মানুষদের ব্যাপার এখন দুর্নীতির বিস্তার গ্রামে গ্রামে পাড়ায় পাড়ায় পরিবারে পরিবারে শিকড়ে শিকড়ে। আমি তাই নিশ্চিতভাবে বলছি আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী দিবস উদযাপন এদেশে দুর্নীতিকে নতুনভাবে উৎসাহিত করবে। কারন রাষ্ট্রীয়ভাবে যতোদিন দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়া বন্ধ না হবে, দুর্নীতিবাজদের যতোদিন পুরষ্কৃত করা হবে ততোদিন এর বিস্তার ঘটতেই থাকবে বাংলাদেশের শিরায় উপশিরায়।
৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া দিবস উদযাপন:
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কয়েকটি ঘটনা আমাকে যাযাপরনাই বিস্মিত করে তার একটি ১৯৭১ সালের দেশের স্বাধীনতার জন্য সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধ আর একটি বাংলার নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার অবিশ্বাস্য ইতিহাস! আশির দশকের একজন বাংলাদেশি বা বাঙ্গালী হিসেবে কোনভাবেই এই দুইটি অতিকীর্তির ব্যাখ্যা আমি খুঁজে পাই না। পাকিস্থানী সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হতে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত কারাবন্দী করে রাখার পরও এদেশের মানুষ একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা কিভাবে অর্জন করছে তা অতিপ্রাকৃত ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়!
এখনো বিস্মিত ঘোর নিয়ে ভাবি শেখ মুজিব মুক্তিপাগল মানুষের শিরায় শিরায় এমন নেশা জাগিয়ে তুলেছিলেন যে তাঁর অনুপস্থিতিতেও মুক্তিযোদ্ধাদের অসম সাহসিকতায় আর মুজিবনগর সরকারের সুদক্ষ প্রবাসী সরকার পরিচালনায় মাত্র নয় মাসে ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, পাকিস্থানী সেনাবাহিনী ও সহযোগী দেশীয় দোসরদের দ্বারা লক্ষ লক্ষ মা-বোনের উপর পৈচাশিক বর্বরতার ও গণহত্যার পরও এই দেশ একটি আলাদা জাতিসত্বা হিসেবে স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এখনকার বাংলাদেশের সুবিধাবাদী চরিত্র, অতি প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ এবং আধিপত্যবাদী শাসকদের দেখে কোনভাবেই মেলাতে পারি না এদেশের অধিকাংশ মানুষ একদিন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেই শুধু দাঁড়িয়েছিলেন তা নয়, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সব প্রতিকূলতা, ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে স্বাধীনতার সূর্যটাকেও ছিনিয়ে এনেছিলেন!
এই ভূখন্ডের জন্য আশ্চর্য হবার বা হিসাব না মেলার আর একটি বিষয় রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বা বেগম রোকেয়া! এক কথায় অসম্ভব, আমার কাছে মনে হয় বেগম রোকেয়ার লেখা সুলতানার স্বপ্ন যেমন কল্পিত নারী রাজ্যের উপর লেখা একটি রচনা ঠিক তাঁর জন্ম ও জীবনব্যাপী নারী জাগরণে করে যাওয়া অসংখ্য কাজগুলোও এক অবাস্তব ইতিহাস! এই ২০২৩ সালেই যেখানে ঘরে ঘরে নারীরা বন্দী, এখনো রাস্তাঘাটে নারীদের নিরাপদে চলাচলের স্বাধীনতা নেই, নারী নির্যাতন, বাল্য বিবাহ, যৌন হয়ারনী, ইভ টিজিং, কঠোর পর্দার বিধান ইত্যাদি নারী প্রগতি বিরোধী কর্মকান্ড প্রচলিত রয়েছে সেই জনপদে কিভাবে সেই ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর তিনি জন্ম নিয়েছিলেন এবং নারী জাগরণে ভয়ঙ্কর সব লেখালেখি করে সমাজে টিকে ছিলেন! খুবই কাকতালীয়ভাবেই ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর এই মহিয়সী নারী মৃত্যুবরণ করেন! তাঁর জন্ম ও মৃত্যু দিবসে তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্ব সহকারে বেগম রোকেয়া দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
উইকিপিডিয়া থেকে সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী বেগম রোকেয়া একজন বাঙালি চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক। তিনি বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত এবং প্রথম বাঙালি নারীবাদী। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে বিবিসি বাংলার ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ জরিপে ষষ্ঠ নির্বাচিত হয়েছিলেন বেগম রোকেয়া। ছোটগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, বিজ্ঞান কল্পকাহিনী ও শ্লেষাত্মক রচনায় রোকেয়ার স্টাইল ছিল স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমন্ডিত।উদ্ভাবনা, যুক্তিবাদিতা এবং কৌতুকপ্রিয়তা তার রচনার সহজাত বৈশিষ্ট্য। তার প্রবন্ধের বিষয় ছিল ব্যাপক ও বিস্তৃত। বিজ্ঞান সম্পর্কেও তার অনুসন্ধিৎসার পরিচয় পাওয়া যায় বিভিন্ন রচনায়। মতিচূর (১৯০৪) প্রবন্ধগ্রন্থে রোকেয়া নারী-পুরুষের সমকক্ষতার যুক্তি দিয়ে নারীদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন করে সম-অধিকার প্রতিষ্ঠায় আহ্বান জানিয়েছেন এবং শিক্ষার অভাবকে নারীপশ্চাৎপদতার কারণ বলেছেন। তার সুলতানার স্বপ্ন (১৯০৫) নারীবাদী ইউটোপিয়ান সাহিত্যের ক্লাসিক নিদর্শন বলে বিবেচিত। পদ্মরাগ (১৯২৪) তার রচিত উপন্যাস। অবরোধবাসিনী রচনায় (১৯৩১) তিনি অবরোধ প্রথাকে বিদ্রূপবাণে জর্জরিত করেছেন।
বেগম রোকেয়া সম্পর্কে উপরের ঐটুকু তথ্যই যথেষ্ট তিনি নারীদের পক্ষে এক অন্ধকার যুগে কিভাবে নিজের মতামত অভাবনীয় সাহসের সাথে প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর লেখা যদি কেউ পড়ে দেখেন এই তথাকথিত আধুনিক যুগেও মনে হবে বেগম রোকেয়ার স্বপ্নের একাংশও আজো পূরণ হয়নি! অনেকেই আমার এই কথাটি পড়ে বিরক্ত হবেন বা উপহাস করতে ছাড়বেন না। কিন্তু আমি যদি বলি একজন নারী রাত দুইটার সময় বোরকা পরিহিতা অবস্থায়ও যদি একান্ত প্রয়োজনে রাস্তায় একাকী বের হন তাঁর নিরাপত্তা কি আমাদের রাষ্ট্র এখনো নিশ্চিত করতে পেরেছে? তখন কিন্তু আপনি উত্তর না দিয়ে নারী শিক্ষার উন্নয়ন, চাকুরী ক্ষেত্রে তাঁদের অবস্থান ইত্যাদি পরিসংখ্যান হাজির করে বিতর্ক করতে চাইবেন। আমি তাহলে বলবো আপনি নারী মুক্তি সম্পর্কে এখনো অজ্ঞতার ভিতর বসবাস করছেন। কেউ কেউ পুরুষ নির্যাতন নিয়েও উচ্চকিত হয়ে রুখে আসবেন কিন্তু আমি বলবো আপনিও থামুন। এমনকি যারা নারীবাদী আন্দোলনের সাথে যুক্ত তাঁরাও আসলে সঠিকভাবে বেগম রোকেয়ার অনুসারী হতে পারেন না। তারা পোশাকের স্বাধীনতা আর আয়ের স্বাধীনতাকে নারী মুক্তি বলে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তোলেন। আমি বলবো আপনারাও থামুন, আরো গভীরে অনুসন্ধান করুন, তাহলেই স্থায়ী মুক্তি মিলবে। এখন ভাবছেন মঞ্চে দাঁড়িয়ে তারস্বরে বক্তৃতা বিবৃতি দিয়েই বিরাট নারীবাদী আন্দোলনের নেত্রী হয়ে গেছেন?
আমি এই সমাজের একজন পুরুষ হিসেবে নারী মুক্তিকে যেভাবে দেখি তা এখন উচ্চারণ করলে নারীরাই হৈ হৈ করে তেড়ে আসবেন। কারন একটি সমাজে সাম্যতা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি সর্বাগ্রে বিবেচনা করতে হবে, এখানে নির্যাতনের শিকার নারী পুরুষের যে কেউ হতে পারেন। সমাজে ন্যায় বিচার ও সাম্যতা প্রতিষ্ঠা না থাকলে আগামী হাজার বছরেও বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। তাই নারীমুক্তি বলুন আর সাম্যতা প্রতিষ্ঠা বলুন নারী-পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অর্জনের পথে হাঁটতে হবে। কেউ কারো প্রতিপক্ষ হয়ে আমরা এতোদিনে কি জঘন্য মুক্তি অর্জন করেছি তা সবাই অনুধাবন করতে পারি। স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াৎ হোসেনের সাহচর্য ও অনুপ্রেরণায় বেগম রোকেয়া যেভাবে নারী মুক্তির অগ্রদূত হিসেবে নিজেকে কিংবদন্তির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন সেভাবেই এই সমাজের সকল নারী-পুরুষের ঐক্যবদ্ধ জাগরণের মাধ্যমেই বেগম রোকেয়ার অধরা স্বপ্নের নারী-পুরুষের যৌথ সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
পল্লব খন্দকার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৩।
সংকলন: দৈনিক আলোকবর্তিকা।
Leave a Reply