আমার বাপের মত্যুতে যারা সময় ও শ্রম দিয়েছেন, দোয়া ও সমবেদনা জানিয়েছেন সকলকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। বাংলাদেশ ও দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাড়া পেয়েছি ফেসবুকের কল্যানে হলেও। মনে হয়েছে, এই দুনিয়াতে আমি একা নই, আছে কাছাকাছি আরো অনেকেই।
শক্তি বা সাহস নেবার মতো অনেককিছুই আছে আমার বাপের জীবন থেকে, তাই ভেঙে পড়িনি। যারা তাঁকে সরাসরি দেখেছেন তারা সহজে বুঝবেন। যারা আমাদের বাড়ীতে একবার হলেও এসেছেন তাঁরা আরো সহজে বুঝবেন। অনেক সহজ সরল ওরকম একটা জীবন আমারও প্রত্যাশা ছিল। দুনিয়ার কোন সম্পদ বা চাকচিক্য তাঁকে আকর্ষণ করেনি। কারো সাথে ধন, মান বা ক্ষমতার কোনো প্রতিযোগিতায় তিনি আসেননি। ব্যবসা বা চাকরী অনেক কিছুই করার চেষ্টা করেছেন, পারেননি শেষমেষ মেনে নিতে। মনের দুঃখে সবশেষ চাকরীটাও ছেড়েছিলেন রিটায়ার্ড করার আগে। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া গ্রামের কয়েক টুকরো জমি আর কোটচাঁদপুরের বাড়ীটা, ঠিক যতোটকু না হলেই নয়। কখনো কোনো সঞ্চয় ছিলনা, জীবনের একমাত্র ঋণ তাও অজ্ঞতাবশতঃ পরিশোধের পর গত তিনযুগে তার কোনো ঋণ ছিল না, ব্যাংকে কোনো একাউন্টও ছিল না। জামা কাপড় কখনো যদি দু’একটা বেশী হতো চুপিচুপি কাউকে দিয়ে আসতেন।
আমাদের বাড়ীটা উপজেলা হাসপাতালের খুব কাছে। অভাবী আর অসহায় মানুষকে তিনি খুঁজেখুঁজে বের করতেন। অসম্ভব বিনয়ী আর কম কথার মানুষ, তবে বাড়ীতে ভিখারী এলে, বা মিস্ত্রী কাজ করতে এলে কথা বলতে বলতে গল্প শুরু করতেন। সেটা দেখে আমরা হাসতাম। আমাদের সাথে গল্পগুলো ছিল মহামনিষীদের জীবনের গল্প। ছোটকালের ছোট ছোট বন্ধু যারা এসে ডাকাডাকি করতো তাদের সাথেও কথা বলতেন আপন করে। দু’একদিন ওরা না এলে খোঁজখবর নিতেন।
পাশের উপজেলা চৌগাছা’র পাতিবিলা গ্রাম থেকে আমরা যে সময়ে কোটচাঁদপুরে এলাম, সেই সময়টা ছিল খুবই বুঁকিপূর্ণ। আমার স্কুলজীবন এখান থেকেই শুরু। বাড়ির কাছেই সিনেমাহল, রকমারী বিজ্ঞাপন, রাতদিন বাজারের কোলাহল, দোকানে দোকানে সাজানো রঙবেরঙের সব জিনিজপত্র। স্কুলমাঠে প্রতিবছর যাত্রা-হাউজি-সার্কাসখেলা, চৈত্র বা বৈশাখীমেলা, চারপাশে বনভোজন কিংবা মেলার মাঠের গানবাজনা, ক্লাবগুলোর নাটক প্রদর্শনী, বড়দের জন্য জুয়ার আড্ডা, মদের দোকান আর নিষিদ্ধপল্লী সবই ছিল ছোট্ট ওইটুকু বাজারে, আর ওগুলো সম্ভবত বৃটিশ আমলের ঐতিহ্য। এতো সবকিছুর মধ্যদিয়ে এতোগুলো ছেলেমেয়েকে বড় করে তোলা সহজ কাজ ছিল না। আর সেটা করার জন্য যখন যেটা করা লেগেছে তখন ঠিক সেটাই করেছেন আমার বাপ।
তাঁর চির প্রস্থানে এই প্রবাসে বসেও আমি শোকে পাথর হইনি, কারণ আমি বাপের জীবন থেকে অনেকগুলো শিক্ষা আর আদর্শ পেয়েছি। যেমন, ধৈর্য্য আর বিশ্বাস হলো সবচেয়ে বড় শক্তি। সম্পদ ও ক্ষমতার লোভ মানুষকে নষ্ট করে। অর্থবিত্ত যার যতো কম, শান্তি তার বেশী। বাজার মানুষকে টানবেই, সেটা যেন পাগল না করে। সবচেয়ে বড় আনন্দ আর বিনোদন হচ্ছে মানুষের সাথে কথা বলা আর তার প্রয়োজনে এগিয়ে যাওয়া। দুনিয়ার জীবন তেমন কিছু না, আসল জীবন হলো মৃত্যুর পরে অনন্ত জীবন। শারিরীক পরিশ্রমই সুস্থ থাকার সবচেয়ে বড় উপায়। অলস আর অবিশ্বাসী মানুষ বেশী ভয় পায়। অস্থিরতা বড় অসুখ। সৎপথে উপার্জন করলে অল্প আয়েই চলা সম্ভব। বড় হবার জন্য কখনো মিথ্যার আশ্রয় নিতে নেই। পড়ে থাকা অর্থ বা সম্পদে হাত দিতে নেই। কেউ অপকার বা ক্ষতি করলে প্রতিশোধ নিতে নেই। আজকের দিনটা যদি মোটামুটি চলে যায় আগামীকালের জন্য চিন্তা করতে নেই। কাউকে উপকার করে পরক্ষণে প্রতিদানের আশা করতে নেই। একান্ত প্রয়োজন না হলে কোনোকিছু কিনতে নেই। বেশীদিন সুস্থ্য থাকতে চাইলে বেশী খেতে নেই। কারো কাছে কষ্ট পেলে আস্তে করে সরে পড়, বিবাদে জড়াতে নেই। মুখ বুজে সয়ে যাও, গালাগালি করতে নেই। ইত্যাদি ইত্যাদি।
এতোকিছুর পরেও তিনি কিন্তু মোটেও ভিতু ছিলেন না, বরং অনেক সাহসী ছিলেন অন্যায়ের প্রতিবাদে বা প্রতিরোধে। পাশের বাড়ীতে যখন ডাকাতি হচ্ছে তখন তিনি ছুটে গেছেন একাই। বাড়ীর ছাদে রাত দুপুরে যখন চোর হাঁটাহাঁটি করছে এগিয়ে গেছেন ধরতে। প্রতিবেশীর বাড়ীতে যখন নির্যাতন হচ্ছে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ঠেকাতে। যতো অন্ধকার রাতই হোক প্রয়োজনে একা পথ চলেছেন। প্রচন্ড ঝড়, বজ্র আর বিদ্যুতে আজান দিয়েছেন। মাত্র ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া এই আমাকে একা ট্রেনে উঠিয়ে দিয়েছেন। আমি কখনো কুষ্টিয়া, কখনো যশোরে গিয়ে চাচা কিংবা একমাত্র ফুফুর বাড়ীতে দু’একটা জিনিস পৌঁছে দিয়ে দু’একদিন পর আবার ফিরে এসেছি বাড়ীতে।
কোনো ফোন ছিলনা, যোগাযোগ ছিল না, অন্তরের দৃষ্টিটা ছিল প্রখর। সেটা দিয়েই তিনি দেখতে পেতেন সবসময় সবকিছু।
একজন মানুষের এ জাতীয় গুণাবলী তখনই বেশী স্বীকৃতি পায় যখন সে মারা যায়, বেঁচে থাকতে যেগুলোর অনেকটাই রীতিমতো যন্ত্রণা আশপাশের মানুষগুলোর জন্য। বড় অদ্ভুত! মনে করুন, একজন মানুষ সারা জীবন একটা বাইসাইকেল চালিয়েই কাটিয়ে দিচ্ছে, দু’একটা জামাকাপড় পরে সমসময় ঘুরাঘুরি করছে, নতুন কিছু কেনাকাটার সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সময় নিচ্ছে, মাস বা সপ্তাহের বাজার একবারে না করে প্রতিদিন বাজারে যাচ্ছে। যে কাজ পয়সা খরচ করে লোকজন দিয়ে করানো লাগে সে কাজ নিজ হাতেই করছে; নিজের খেয়ে পরের বাড়ীর রাস্তা মেরামত করছে। যে মুহূর্তগুলোতে হা-হুতাশ করে অস্থির হওয়া লাগে সে সময়গুলোতেও সে একেবারে চুপচাপ ধীরস্থির নির্লিপ্ত। পাশের মানুষগুলো তাকে নিয়ে হতাশ হয়ে ভাবতে থাকে, সে এক নিতান্ত অলস, কিংবা প্রচন্ড কৃপন, এক্কেবারে বেরসিক, অক্ষম, অসামাজিক, রাগী কিংবা, বদমেজাজী!
আমার সাথে সর্বশেষ দেখায়, একটু ভয়ই পেয়েছিলাম, পথেঘাটে কাউকে কাউকে যেন তিনি অকারণে ধমকাচ্ছেন। বুঝলাম, এ তাঁর নতুন অসুস্থতা। লোকজনও বুঝতে পারছে, তাই কিছু বলছে না। আমি বললাম, আপনি যে লোকজনকে এভাবে ধমকাচ্ছেন, ওরা যদি মনে করে যে, এই লোকের ছেলেরাতো সমসময় এখানে থাকে না ওকে একটু দেখে নিব। তাহলে তো আপনার সমস্যা হয়ে যাবে। বললেন, অতো সোজা না, ”আসুক তো দেখি, কার এতো সাহস আছে”!
সব অভাব অভিযোগে সর্ব শক্তিমান এক অদৃশ্য শক্তির কাছেই ছিল তাঁর বিনীত প্রার্থনা। এ জীবন শেষে এক অনন্ত জীবনের সুখই ছিল তার একমাত্র চাওয়া! হে আমাদের প্রভু, দয়াময়। এই দুনিয়াতে তিনি কোনো শাসক বা প্রশাসক ছিলেন না যে জুলুম করবেন, বিচারক ছিলেন না যে অবিচার করবেন। তবে সাক্ষ্য দিচ্ছি, তিনি ছিলেন একজন আদর্শ অভিভাবক, নিরব প্রতিভাবান আর স্রোতের বিপরীতে ছুটে চলা একজন অসাধারণ অতি সাধারণ মানুষ। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমার এই সংক্ষিপ্ত কর্মজীবনে, কোটি কোটি টাকার কাগজে স্বাক্ষর করেছি, কখনো একটা টাকাও নিজে ভক্ষণ করিনি; একটা পথ পাবার জন্য কোন অবৈধ পথের সন্ধান করিনি; দুনিয়ার স্বার্থ, অর্থ, বিত্তকে সবচেয়ে বড় করে দেখিনি; জীবনের কোনো অসহায় মুহূর্তে ধৈর্য্য আর বিশ্বাস হারাইনি। তাঁর দেখানো আদর্শ ধরে থাকতে চাই বলেই আমি ভাবতে চাইনে তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই, বরং তিনি আছেন যেমনটি ছিলেন ক’দিন আগেও। চোখের আড়ালে বছরের পর বছর যেমনটি ছিলেন ঠিক তেমনই আছেন আজো, থাকবেন সবসময় সবখানে ছায়া হয়ে। কেউ জানুক আর না জানুক, থাকবেন আমার অন্তরের গভীরে।
হে আমাদের মালিক, সব বিচারকের শ্রেষ্ঠ্য বিচারক! মানুষ হিসাবে জানি তাঁরও অনেক ভুলত্রুটি ছিল। নিজগুনে ক্ষমা করে দিয়ে তাঁকে তুমি উত্তম প্রতিদান দাও। দাও এক উচ্চতম সম্মানিত স্থান!
সংগ্রহ: ইকবাল আহমেদ এর ফেসবুক পেজ থেকে। উল্লেখ্য, তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি এন্ড উট টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং কানাডা প্রবাসী।
সংকলন: দৈনিক আলোকবর্তিকা।