১ম ব্যক্তিঃ আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন?
২য় ব্যক্তিঃ ওয়ালাইকুম আসসলাম, আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি।
২য় ব্যক্তিঃ আপনি কেমন আছেন?
১ম ব্যক্তিঃ আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি।
দুজন পূর্ব পরিচিত মানুষের সংক্ষিপ্ত এই সম্বোধন পর্বের পরবর্তী আলাপ যদি করার সুযোগ থাকে তাহলে প্রথমে বলা আলহামদুলিল্লাহ’র অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে। কারন তার পরের আলাপে ঢুকে পড়ে- “আর বলবেন না, বাজারে জিনিসপত্রের যে দাম, সংসার আর চালাতে পারছিনা, খুব বিপদে আছি রে ভাই!” এই কথায় অপরজন কিন্তু অবাক না হয়েই বলে ফেলেন “ঠিকই বলেছেন ভাই, আমার হার্টের অবস্থাও ভালো নয়, যেকোন সময় ওপেন হার্ট করা লাগবে মনে হয়!”
তারমানে আসলে দুজনেই বিভিন্ন কারনে মানসিক ও শারীরিকভাবে ভালো নেই অথচ প্রথম দেখায় দুজনেই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে নিজেদের ভালো থাকার কথাই বলেছেন। পরের আলাপগুলো কি তবে মিথ্যা বা বানিয়ে বলেছেন? আসলে তা নয়, পরের আলাপগুলোই সত্য। প্রথম দেখায় করা কূশল বিনিময়টি নিতান্তই সৌজন্য প্রকাশ। কিন্তু আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে একটু পরেই ভালো না থাকার গল্পগুলো কি আমাদের করা উচিত? ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এটি গুরুতর অন্যায়, আলহামদুলিল্লাহ বলার অর্থ হলো আপনি কোন কারনে ভালো না থাকলেও আপনার উপর আসা সকল বিপদ মুক্তির জন্য নিজেকে আল্লাহর নিকট সোপর্দ করেছেন। তাই সেই বিপদের কথা বলে হতাশা প্রকাশ করার অর্থ আল্লাহর উপর আপনার যথেষ্ট ভরসা নেই।
আমাদের তাই সত্যের মুখোমুখি হবার সৎ সাহস থাকা প্রয়োজন। আলহামদুলিল্লাহ যদি বলেই ফেলি তাহলে তা শতভাগ বিশ্বাস থেকেই বলবো। আর বিপদের মধ্যে থাকলে তা থেকে মুক্তি পাবার জন্য অন্যের কাছে দোয়া চাইবো, আল্লাহর কাছে আর্জি জানাবো বিপদ মুক্তির জন্য। এই ভালো আছি বলাটা আসলে অভিনয়, কারন ভালো নেই বললেই অনেকগুলো প্রশ্ন চলে আসবে। কেনো ভালো নেই তার একশোটা কারন দেখাতে হবে, সেই ঝামেলা এড়াতেই মানুষ ভালো না থেকেও তোতা পাখির মত বলে ফেলে ভালো আছি। এই ভালো থাকার অভিনয়, এই বেশ ভালো আছির মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা আসলে এক ধরণের মানসিক রোগ।
আমাদের সমাজে এই মেকীত্ব ব্যাপারটা খুব প্রচলিত। আমি যা নই তা থেকে হাজারগুণ বাড়িয়ে বলাটা আমাদের মজ্জাগত স্বভাব। অনেকে বলে থাকেন নিজের ঢোল নিজেই না পেটালে নাকি আর কেউ আপনাকে ভালো বলবে না! এই কথাটি ডাহা মিথ্যে, অবশ্যই আপনি প্রকৃত ভালো মানুষ বা গুনী মানুষ হলে অপরজন তা প্রকাশ করবে দশজনের কাছে। বরং আপনি নিজের ঢোল পিটিয়ে নিজের গুণকীর্তন করতে থাকলে একসময় ফাঁকি ধরা পড়ে যাবেই। আপনাকে তখন কেউ সহজে বিশ্বাস করতে চাইবে না। কারন কবি বলেছেন ‘নিজে যারে বড় বলে বড় সে নয়।‘ যদিও নিজের ঢোল পেটানো মানুষদের এসব উপদেশ বাক্যে কিছু যায় আসে না, তারা জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত বিরক্তিকরভাবে সেটি চালিয়েই যায়।
মানুষ হিসেবে আমাদের বড় দায়িত্ব হলো নিজেদের মানুষ হিসেবে প্রমাণ করা। মিথ্যা অহংকার আর অযাচিত বা ফাও আলাপ থেকে কোন ইতিবাচক ফলাফল আশা করা যায় না। এগুলো করে দিনশেষে অন্যদের কাছে চাপাবাজ ও গুরুত্বহীন মানুষে পরিণত হতে হয়। এরচেয়ে লজ্জাজনক আর কি আছে যে অন্য কেউ আমাকে ফালতু হিসেবে ভাবছে, আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে, নেতিবাচক মন্তব্য করছে। রসিকতা করা এক জিনিস আর চাপাবাজি অন্য জিনিস, অনেকেই এই দুটো ভিন্ন ব্যাপারকে গুলিয়ে ফেলেন। মিথ্যা বলে অন্যকে বিভ্রান্ত করার পর যখন অযাচিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় তখন বলে ফেলে- রসিকতা করেছি। তখন আরেকজনের মিথ্যায় ক্ষতিগ্রস্থ কেউ হয়তো রাগের মাথায় বলেই ফেলে- “রসিকতা করেন কেনো, আমি কি আপনার দুলাভাই লাগি?”
আমাদের দেশের সব চায়ের আড্ডাগুলো হল নিজের জ্ঞানগরিমা জাহির করার উর্বর স্থান। এখানে বসেই বিস্তর বাঘ হাতি ঘোড়া শিকার চলতে থাকে এবং এক শ্রেণীর শ্রোতা সেগুলো আগ্রহভরে শুনে নানান মন্তব্যে আড্ডাও জমিয়ে দেন। গ্রামের দরিদ্রতম ব্যক্তিটি থেকে রাজা উজির কারো ব্যাপারে মন্তব্য এখানে থেমে থাকে না, ভাবখানা এমন এখানেই নির্ধারিত হয় দেশের ভাগ্য, এরাই পৃথিবীর হর্তাকর্তা, এদের কথাতেই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড পরিচালিত হয়। এখান থেকেই কোন দেশের সরকার পড়ে যায় অথবা নতুন সরকার গঠিত হয়, গ্রামের পাড়ার মেম্বর সাহেব থেকে প্রেসিডেন্ট পুতিন ও বাইডেনের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করে বিরাট অর্জনের গর্বে আড্ডার মধ্যমনি হবার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় অনেকের মাঝে। আমার জানা নেই পৃথিবীর অন্য কোন দেশে এমন আজগুবী অনুৎপাদনশীল আড্ডার প্রচলণ কতো টা আছে?
অলস সময় কাটানোর জন্য আড্ডা খুবই ভালো একটি সমাধান, সেই আড্ডার কোন নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু থাকে না। সাধারণত সমসাময়িক ঘটনা দূর্ঘটনা, রাজনীতি, অন্যের বদনাম, নায়ক নায়িকাদের নিয়ে রটনা, জল্পনা কল্পনা এসবই প্রধান উপজীব্য। এসব আড্ডায় সাহিত্য ও শিল্প নিয়ে আলোচনাকারী বা শ্রোতা কোনদিনই মিলবে না, সেই চেষ্টা না করাই ভালো। তবে লাগামহীন চাপাবাজি শুধুই মানুষের আত্মার ক্ষয় ঘটায়, মানুষের তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের সঠিক পরিচর্যার অভাবে অপসংস্কৃতির বিস্তার ঘটে। আড্ডাগুলোতে তাই প্রতিনিয়ত মিথ্যাচার ও ব্যক্তি সমালোচনা বা ধর্মীয় ভাষায় গীবত করা হলে একই সাথে পাপ এবং মানুষের আত্মবনমন ঘটে। আমরা নিজেদের খুব সচেতনভাবে এমন অযাচিত মিথ্যার রাজ্য থেকে সরিয়ে রাখতে অবসরে বই পড়া, গান শোনা, ইবাদত করা অথবা কোন খেলাধুলার আশ্রয় সহজেই নিতে পারি। আর আড্ডাটা দেয়ার অভ্যাস হয়েই গেলে একটু লাগাম টেনে ধরাই উচিত, মিথ্যা বলে, নিজেকে যা নয় তা হিসেবে জাহির করে পাপ কামাই করার চেয়ে মসজিদে বা মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনায় সময় কাটানোই ঢের ভালো।
পল্লব খন্দকার, ২৪ আগস্ট ২০২৩
mazhabkh93@gmail.com
Leave a Reply