আদিকলাতন্ত্র
মেয়েটা মহানন্দার চিকন জলে হাঁটু অব্দি ডুবিয়ে ডাঙায় দাঁড়ানো ছেলেটাকে চিৎকার করে বলল, তুমি কৃষ্ণ আমি রাধা; ছেলেটার কানে মেয়েটার মিহি চিৎকার পৌঁছাল কিন্তু কোন জবাব দিল না। শুধু তার মুখ হাসল, চোখ হাসল আর একটা দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে পড়ল মহানন্দা পাড়ের মুখর বাতাসে।
দু’জনের মাঝখানে এক ফালি দূরত্ব, ঠিক দূরত্বও নয়, এক সমুদ্র হাহাকার এদিক থেকে ওদিক বিছিয়ে আছে। সে হাহাকারের কারণে ছেলেটার চোখের হাসি, মুখের হাসি, দীর্ঘশ্বাসের উজান, পায়ের পাতার দ্বিধা কোনটাই জলে দাঁড়ানো মেয়েটা দেখতে বা শুনতে পেল না। ছেলেটাও হয়ত মেয়েটার সে দেখতে না পাওয়া চোখটা অনুমান করতে পারল না।
মেয়েটা আবার জলে পা ডুবিয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আরো খানিকটা জোরের সাথে বলল, তুমি কৃষ্ণ আমি রাধা।
এবার ছেলেটা জবাব দিল। মেয়েটার মত একইভাবে চিৎকার করে বলল, তুমি রাধা আমি কৃষ্ণ।
সূর্য তখন পোড়া মাটির থালার মত পশ্চিমে ঝুঁকে পড়েছে। যেন মহানন্দার জলে ডুবে যেতে যেতে আবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে পুবের আকাশে। একখণ্ড মেঘ আকাশের গায়ে জমাট বেঁধে তলিয়ে যাওয়া সূর্যের জবা-লাল রশ্মির ওপর একখণ্ড ঘসা কাচের আবরণ তুলে দিচ্ছে। আর সে কাচের ভেতর দিয়ে সূর্যের শেষ আলো এসে পড়ছে মেয়েটার মুখে, ছেলেটার চোখে আর মহানন্দার পাড়ের সবুজ ঘাসে।
মহানন্দার পাড়ে ঘোষ বাবুদের আম বাগানে সারি সারি গাছ। সেই গাছে ঘসা কাচের ভেতর দিয়ে শেষ সূর্যের আলো-ছায়া হুমড়ি খেয়ে পড়েছে জলের গায়ে, পাড়ের খাঁজে, বালুর কনায়। মিশ কালো ছায়া ঘুরপাক খাচ্ছে বাগানের চারপাশে। পাড়ের লম্বা কাশ ফুলের গায়ে মুখে বাতাসের সবুজ মাতলামি যেন থামছেই না; দুলতে দুলতে টলমলো হয়ে যাচ্ছে, তবু দুলে যাচ্ছে কাশের শুভ্র ফুল।
দুর্গা পূজা এল বলে। পূজোর সময় মহানন্দার পাড় ফোটা কাশ ফুলের অবিরাম দুলুনিতে সাদা হয়ে যাবে। বাতাসে দুলবে কাশের ডগা। নদীর মাঝখানটা বেহালার পেটের দিকের মত শুকিয়ে ছোট হয়ে আসবে। শুধু পূজোর কয়দিন এপার-ওপার নৌকো চলে। এপার থেকে হাঁক দিলে ওপারে বসে হুঁক্কা খেতে থাকা মাঝি চোখ তুলে সাড়া দেয়। তারপর লগি ঠেলে এপাড়ে এসে ভেড়ে। যাত্রী নিয়ে চলে যায় ওপাড়ে।
সেই নৌকায় পার হতে হতে মাঝির সাথে যাত্রীরা সুখ দুঃখের টুকরো টুকরো কথা বলে, আর নিজেদের শৈশব কৈশোরের দিনগুলো কত মধুর ছিল, সে নিয়ে আক্ষেপ করে; আগের দুর্গা পুজো কত আনন্দের ছিল অথচ এখন আর সে দিন নেই বলে হা হুতাশ করে। পারাপারের একটা হুলুস্থূল চলে দুর্গাপূজোর ওই ক’টা দিন।
নদীর জলে এখন তারা দু’জন। ওপারে এপারে আর কেউ নেই। এখনো শুকিয়ে যাওয়া মহানন্দার এপার থেকে ওপার খেয়া শুরু হয় নি। এখনো পাড়ের ঘাস মানুষের পায়ের চাপায় পিষ্ট হয় নি।
এখন কেবল চারদিকে ঝিম ধরা নীরবতা। জনশূন্য। কোলাহলশূন্য।
দূরে শুধু চোরাই বালু তোলার শ্যালো নৌকার ভটভট শব্দ। শব্দটা একটানা নয়, থেমে থেমে। যেন বাতাসের যখন ইচ্ছে, তখন সে ভাসিয়ে আনছে শব্দ, আর যখন অনিচ্ছা তখন অবহেলায় শব্দের ঘাড় ধরে ডুবিয়ে দিচ্ছে মহানন্দার চিকন জলে। জলের ওপর শুধু ভেসে উঠছে শব্দের বুজকুরি।
এমন নিরব, জনশূন্য জায়গার খোঁজেই তো বাড়ি ছেড়েছে তারা দু’জন। মুখোমুখি দাঁড়াবে, কথা বলবে অথচ কেউ তাদেরকে টেনে হিঁচড়ে ঘরে নিয়ে শিকল তুলে দেবে না। সালিশীও বসাবে না। অথবা পুরো গ্রামের উৎসুক মানুষের উপচে পড়া ভিড়ের সামনে তাদেরকে জুতা পেটা করবে না। সে আঘাতে গালে পিঠে কাঁধে বুকে ছোপ ছোপ দাগ হয়ে গেলে, বা ব্যথায়, অপমানে, লজ্জায়, অসহায়ত্বে তারস্বরে চিৎকার করলেও কেউ এগিয়ে আসবে না বাঁচাতে।
মেয়েটা হাতের ইশারায় ডাকল ছেলেটাকে। সঙ্গে সেই মিহি গলায় আবদার, নেমে এস, নেমে এস।
ছেলেটা জলে নেমে এল। জলে ভিজল তার পা, হাঁটু অব্দি বেয়ে উঠল জল। স্রোতহীন সুস্থির জল। অপাপবিদ্ধ জল। পাপস্খালনের জল। কোথায় এ জলের শুরু, কোথায়ই বা শেষ? কে জানে। কত পাড়, কত গ্রাম, কত উপকূলের স্মৃতি, গল্প, জড়িয়ে আছে এ জলের অন্তরে সে খবর ছেলেটা বা মেয়েটা জানে না। তারা শুধু জানে মহানন্দার এ জল তাদেরকে দিয়েছে চোখের তারায় ডুবে যাবার সান্নিধ্য। তারা শুধু জানে তাদের জীবনের গল্পও আজ জমা হবে মহানন্দার পাড়ের অসংখ্য মানুষের অসংখ্য গল্পের সাথে।
ছেলেটার পায়ের তালুতে নরম মাটি-কাদার শিরশিরে অনুভূতি। একটা দুটো বুদবুদ পায়ের তালুতে সুড়সুড়ি দিল। তবুও ছেলেটা শক্ত হয়ে দাঁড়াল মেয়েটার মুখোমুখি। খুব সুস্থির গলায় বলল, না, রাধা-কৃষ্ণ না। আমি মজনু, তুমি লাইলি। মজনু কেমন পাগল হয়ে বনে বনে ঘুরতো। আমার মজনু হতেই ভাল লাগে।
ছেলেটার কথা শুনে মেয়েটার তামাটে কালো মুখ ঝিলিক দিয়ে উঠল। ঠোঁটের কোনায় সামান্য হাসিও দেখা দিল। সে হাসিতে শুভ্র দাঁতের রেখা দেখা গেল। সে হাসিতে মহানন্দার জলও মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল।
মেয়েটা একটু দম নিল। বার কয়েক পলক ফেলল। তারপর মুখোমুখি দাঁড়ানো ছেলেটার হাত নিজের মুঠোর ভেতর দৃঢ় করে ধরে বলল, ওই একই কথা। রাধা-কৃষ্ণই বল আর লাইলি-মজনুই বল, আমি আর তুমি ও রকমই। শুধু ভুল করে আমাদের সেকালে জন্ম না হয়ে একালে হয়েছে। এ কালের দোষ, আমাদের না।
ছেলেটা এবার মেয়েটার চোখের দিকে তাকাল। সরাসরি। গভীর করে। বিদ্ধ করে। কিছু একটা খুব নিশ্চিতভাবে সে দেখতে চায়। বুঝতে চায়। সে বুঝটা এখনই দরকার। এই মুহূর্তেই। দেরি হলে, বড্ড দেরি হয়ে যাবে। মনোবেদনায় পুড়বে।
ছেলেটা আকুল হয়ে জানতে চাইল, কোন দ্বিধা কি আছে তোমার মনে? সামান্য? এক সরিষা পরিমাণ?
ছেলেটার গলার আকুলতা জলের বুকে, নিঃশ্বাসের বাতাসে, বিকালের হলদে রোদের গায়ে জড়িয়ে রইল বকুলে গায়ে জড়ানো অদৃশ্য ঘ্রাণের মত।
মেয়েটা হাসল। সেই আলো ঝলকানো এক গালে হাসি। তারপর এক ঠোঁটে খানিকটা কাঁপন তুলে বলল, আমার দ্বিধা তো সেদিনই হারিয়ে গেছে, যেদিন থেকে তোমায় ভালবাসতে শুরু করেছি।
কবে থেকে? ছেলেটার প্রশ্ন।
মেয়েটা খুব যত্ন করে মৃদু কিন্তু দৃঢ় স্বরে বলল, যেদিন থেকে তোমার চোখ আকাশ না দেখে আমাকে দেখতে শুরু করেছে। যেদিন তোমার চোখ ভোরের আলোতে না জেগে আমার ভাবনায় জাগতে শুরু করেছে, সেদিন থেকেই আমি তোমাকে ভালবাসি।
ছেলেটা কোন কথা বলল না। আসলে কথা খুঁজেই পেল না। এ কথার কী উত্তর হয় তার জানা নেই। বলতেও ইচ্ছে করল না কিছু। শুধু নিষ্পলক তাকিয়ে রইল মেয়েটার দিকে মুখের দিকে। একবার ফুঁ দিয়ে মেয়েটার কপালের ওপর ঝুলে থাকা চুল সরিয়ে দিতে চেষ্টা করল। পারল না। শেষে ডান হাতের তর্জনি দিয়ে সেটা সরিয়ে দিল।
ছেলেটার গভীর চোখের টানে মেয়েটার দিশেহারা নেশা লাগল। ঠিক নেশাও নয়, এক মোহন মাদকতা। দূর কালের কোন এক দিশেহারা নেশা। করতলে রেখে ডলে ডলে কেউ যেন বাতাসে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে এক অমোচনীয় নেশা। সে দিশেহারা নেশার থেকে কোন মুক্তি নেই এদের।
মেয়েটা ভাবল, আজ কোন সঙ্কোচ রাখবে না সে, কোনই সঙ্কোচ তাকে দূরে রাখতে পারবে না। বাড়ি থেকে বেরুনোর সময়ই নিজেকে বুঝিয়েছিল সে। তবুও কেন যে লজ্জা হচ্ছে! এই মুহূর্তেই লজ্জাটা কেন হাজির হচ্ছে? হুড়মুড় করে ভেঙে পড়া লজ্জা। লজ্জাটা আবার ভালও লাগছে। ঠিক এই মুহূর্তে কোনটা যে ভালবাসা আর কোনটা যে লজ্জার অনুভূতি, সে পার্থক্যই হারিয়ে ফেলল মেয়েটি। নাকি ভালবাসার আনন্দ আর লজ্জায় কোন পার্থক্য নেই। গলায় শুধু একটা ভাল লাগা মিশিয়ে বলল, কি দেখছো?
তোমাকে।
আগে দেখোনি বুঝি?
দেখেছি, তবে এমন করে দেখিনি। আগে দেখা হলে সবটা দেখতেও ইচ্ছে করতো না। মনে হত, খানিকটা বাকি রাখি। পরের বার দেখব। এখন মনে হচ্ছে সবটা তো কোনদিনই আর দেখতে পাবো না। আজই তো শেষ। আজকের পর তো আমাদেরকেও কেউ পাবে না। তোমার মা তোমাকে মারবে না। তোমার বাবা তোমাকে ঘরে আটকে রাখবে না। আমার বাবা ভরা সালিসীতে আমাকে জুতা পেটা করবে না।
ছাড়ো ওসব কথা। আমি তোমাকে আমার ভেতরে রাখবো। দেখতে পাব। ভালবাসবো। জানো, আজ যখন বাড়ি থেকে বের হয়েছি, তখন কৃষ্ণ ঠাকুরকে প্রণাম করে এসেছি। মহানন্দার জলে দাঁড়িয়ে তাঁকে ভরসা করেই তো সাঙ্গ করছি ভবলীলা। আমরা তো রাধা-কৃষ্ণের যুগল। আমাদেরকে আলাদা করে এমন সাধ্যি কার, বলো? আটকে রাখতে পেরেছে তোমার বাড়ির লোকেরা, নাকি পারল আমার বাড়ির লোকেরা? ঘর থেকে বেরিয়ে তো এলাম। বল, এলাম না?
ছেলেটার চোখে জল, মেয়েটার চোখেও জল। অথচ কেউ মুছল না। কপোল গড়িয়ে নেমে এল। সে জল টুপটুপ করে ঝরে পড়ল মহানন্দার সুস্থির জলে, ভোরের শিশিরে যেমন ঝরে শিউলিতে।
এবার ছেলেটা মেয়েটাকে আরও কাছে টেনে নিয়ে বলল, মেম্বার চেয়ারম্যানরা যে তোমার মা-বাবাকে অতো লোকের সামনে অপমান করল, সেটা? নিচুজাতের লোক বলে কত গালাগাল করল।
তারা তাদের কাজ করেছে। তারা তো জানে না, কৃষ্ণ ঠাকুর সারাক্ষণ আমার কানে কানে ফিসফিসিয়ে কী বলে। তারা তো জানে না নিচুজাতের হলেও কৃষ্ণ ঠাকুর আমার ডাকে সাড়া দেন। তারা তো জানে না, আমার মা-বাবা তোমার পেছনে আমাকে লেলিয়ে দেয়নি। আমিই তোমাকে ভালবেসেছি। তুমিও আমাকে ভালবেসেছো।
তোমার কৃষ্ণ ঠাকুরকে বলোনি, আমাদের কষ্ট কমিয়ে দিতে?
বলেছি তো। আর কৃষ্ণ ঠাকুরই তো আমাকে বলেছেন, তোমাকে কায়-মনে ভালবাসতে। কৃষ্ণ ঠাকুরই আমাকে বলেছিলেন, রাধাগোবিন্দপুরের মেয়েদের স্কুল ছেড়ে মাদ্রাসায় গিয়ে ভর্তি হতে। আমরা নিচু জাতের বলে, স্কুলে আমার সঙ্গে কেউ বসতো না। মাদ্রাসার মেয়েরা অন্তত কাছে বসত, এক সঙ্গে ভাগাভাগি করে খাবার খেতো। এটা আমার যে কত বড় পাওয়া সে তুমি বুঝবে না।
ছেলেটা মেয়েটার মুখের দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকে কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। চোখের জলে সব আবছা হয়ে গেল। শুধু হাত বাড়িয়ে মেয়েটাকে বুকের কাছে টেনে নিল। মেয়েটাও বাধা দিল না। অন্য দিন হলে দিত।
খানিক বাদে বুক থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়ে মেয়েটা বলল, আমার একটা অনুরোধ রাখবে?
কেন রাখব না? বল কি অনুরোধ?
মেয়েটা একটু সময় নিল। পায়ের কাছে মহানন্দার জল আরো খানিকটা গড়িয়ে গেল। খানিকটা সময়ও সেই জলের সঙ্গে গড়িয়ে গেল অনন্তের দিকে। তারপর, যেন শত বর্ষের ওপার থেকে ভেসে আসা এক যাদুকরী সুরের মত করে বলল, আমার মাথায় সিঁদুর পরিয়ে দেবে?
ছেলেটা অবাক হয়ে বলল, সিঁদুর এনেছো?
না, আনিনি। মা মহানন্দার জলই আমার সিঁদুর। এই পানিতেই আমার পূর্বপুরুষেরা মাছ ধরেছে। পাড়ে ঘর বেঁধেছে। ডুবে মরেছে। ভয় উপেক্ষা করে আবারও মাছ ধরতে বেরিয়েছে। তাদেরকে সাক্ষী রেখেই তুমি আমাকে মহানন্দার জল দিয়েই সিঁদুর পরিয়ে দাও। জলের সিঁদুরই জ্বলজ্বল করুক আমার সিঁথিতে।
এবার ছেলেটা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। ডুকরে কেঁদে উঠল।
মেয়েটা একটুও নড়ল না। স্থির তাকিয়ে রইল কান্নারত ছেলেটার দিকে।
ঘোষেদের আম বাগানের ছায়া গভীর হয়ে পড়েছে তার মুখে। তার গায়ের সাদা রঙটা আমের ছায়ায় তামাটে মনে হচ্ছে, এই তামাটে ছেলেটাকে নতুন করে ভাল লাগল মেয়েটার। কি যে মায়া তার মুখে চোখে। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে মেয়েটা ভাবল, এই ছেলেটি কি জানে, ওর বাবার অর্থ দেখে আমি ওকে ভালবাসিনি। এই ছেলেটি কি জানে আমার মা বাবাও ওর পেছেন আমাকে লেলিয়ে দেয়নি। শুধু ঐ মায়াময় মুখ, আর দিগন্তের দিকে তাকান দুটো গভীর চোখ। ঐ মুখ আর চোখের দিকে তাকালে কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে বুকের ভেতর। সে মোচড় এড়ানোর সাধ্য নেই আমার। কোন দিন ছিলও না। আজও নেই।
ছেলেটা মেয়েটার হাত ছেড়ে পানিতে ঝুঁকে বাম তালুতে তুলে নিল মহানন্দার স্ফটিক জল। তারপর ঋজুভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ডান হাতের তর্জনি ভিজিয়ে মেয়েটার সিঁথিতে জল-সিঁদুর পরিয়ে দিল। সিঁদুর দান শেষে মেয়েটার দুই কাঁধে হাত রেখে এক দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
ছেলেটার বুকের সঙ্গে সেঁটে মেয়েটা সিঁথিতে জলভেজা অনুভূতি নিয়ে চোখ বন্ধ করে রইল। কি যে ভাবল কে জানে। শুধু কান্না, হাসি, সুখ ও দুঃখ মেশানো অনুভূতির একটা পিণ্ড তার গলার কাছে আটকে তার শ্বাস বন্ধ করে দিল প্রায়।
সময় কেটে গেল ভাটির টানের মত। তাদের দু’জনের পা ছুঁয়ে ছুঁয়ে মহানন্দার জল গড়িয়ে গেল কোন অদৃশ্যে।
কতক্ষণ কাটল কে জানে। এক সময় ছেলেটার বুকের ভেতর থেকে মুখ না সরিয়ে মেয়েটা বলল, অসম্মান নিয়ে এক একটা দিন কি করে বাঁচতে হয়, নিচু জাতের মেয়ে আমি, আমার চেয়ে বেশি কেউ জানে না। তুমি আমাকে সে অসম্মান থেকে বাঁচালে আজ।
চারদিকে তখন অন্ধকার হয়ে এসেছে। ঘোষেদের আম বাগানে জমাট বাঁধা অন্ধকার মহানন্দার চিকন জলকে অসিতবরণ করে তুলেছে। আজ আকাশে চাঁদ উঠবে না। আজ আকাশে কেবল দূরের তারা জলজ চোখে কাঁদবে।
জল থেকে উঠে আসতে আসতে মেয়েটা ফিসফিস করে বলল, তুমি কি শুনতে পাচ্ছো, চারদিকে শাঁখ বাজছে, উলু উঠছে? কৃষ্ণ ঠাকুর গোপিনীদের পাঠিয়েছেন। চল, আমাদের ডাক এসেছে, যেতে হবে। ওরা তো আমাদেরকে বরণ করে নিয়ে যাবে ব্রজধামে। চল। পা চালিয়ে চল।
যে গাছটার নিচে এসে তারা দাঁড়াল সেখান থেকে নদীর পাড়টা আর দেখা গেল না। মহানন্দার পানি হারিয়ে গেল চোখের আড়ালে। অথবা তাদের দু’জনের চোখেই এসে ভর করল মহানন্দার জলের ধারা। কে জানে।
গাছের নিচে দাঁড়িয়ে শেষবারের মত মেয়েটা ছেলেটাকে বলল, দাঁড়াও আমি তোমাকে একটু জড়িয়ে থাকি। এই আমগাছের গায়ে জমে থাকা শ্যাওলার মত। তোমার ধর্ম, আমার ধর্ম, মেম্বার-চেয়ারম্যান, সালিশীর মজলিশ, মা-বাবার অসম্মান, পিঠের ওপর সেঁটে থাকা কঞ্চি আর বেতের দাগ, কিছুই যেন আমাকে আর আলাদা করতে না পারে। পরজন্মে যেন তোমায় আমি পাই। কৃষ্ণ ঠাকুর আমাদের তুমি দেখো।
পরদিন দুপুরে শিবগঞ্জ রাইচরণ উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র শফিউল ইসলাম আর জান্নাতুল কোবরা মহিলা মাদ্রাসার দশম শ্রেণীর ছাত্রী পুষ্পরানি মালোর মৃতদেহ ঘোষবাবুদের আম গাছ থেকে নামিয়ে পুলিশ যখন রিকসা ভ্যানে তুললো, তখন গ্রামবাসী বা পুলিশ কেউই জানলো না, ডালে ঝুলে পড়ার আগে এই বালক-বালিকা মহানন্দার জলে, ঘোষ বাবুদের শতবর্ষী আম বাগানের মাটিতে নুয়ে পড়া শ্যাওলা জমা শাখার নিচে দাঁড়িয়ে একজন আরেকজনকে কি কথা বলেছিল!
আমীনুর রহমান
ইউএসএ