একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কাছে পথপ্রদর্শক। বিশেষ করে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকগণের প্রতিটি কথা, আচরণ, চলাফেরা, আদেশ, নির্দেশ, আদর্শ একজন শিক্ষার্থীর সমস্ত জীবন ব্যাপি প্রভাব ফেলতে পারে। পরিবারের মানুষের চেয়ে অনেক সময় শিক্ষকের কথার গুরুত্ব বেশী হয়ে পড়ে অনেকের কাছে। তাই একজন শিক্ষকের মধ্যে আমরা আদর্শ মানুষ খুঁজে থাকি, দোষে গুণে মানুষ কথাটি ঠিক থাকলেও আমরা মসজিদের ইমাম, মন্দিরের পুরোহিত, গীর্জার ফাদারের কাছে যেমন সৎ ও আদর্শ আচরণ আশা করি তেমনটাই শিক্ষকদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা থাকে। অকারনেই শিক্ষকগণকে মানুষ গড়ার কারিগর বলা হয় না, তাঁরা অবশ্যই সমাজের আর দশটি সাধারণ মানুষের চেয়ে ভিন্ন ভাবনার ও আচরণের হবেন। তাঁদের দেখেই শিখবে পরবর্তী প্রজন্ম, তাঁদের আদর্শ ধারণ করে দেশের সেবা করবে অগণিত আগামী দিনের সুনাগরিক।
আশির দশকেও আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত মানুষেরা শিক্ষকসুলভই ছিলেন। তাঁদের ধ্যান, জ্ঞান, নেশা ছিলো নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সঠিক দিক নির্দেশনা প্রদান ও লেখাপড়ায় ভালো করতে সহযোগিতা করা। সে সময়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শুধু শিক্ষার্থীদের কাছেই নয় একটি এলাকার সর্বস্তরের মানুষের কাছেই একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হতেন। দুঃখজনক হলেও বাস্তব এই যে, সেই সময়ের সাথে যদি তুলনা করা হয় বর্তমান সময়ের একজন সাধারণ শিক্ষক বা প্রধান শিক্ষকদের ভাবমূর্তির সেই পার্থক্য এখন আকাশ পাতালের সমান! আচরণে, জ্ঞানে, পাঠদানে কোনদিকেই আজকালকার শিক্ষকদের মাঝে আদর্শ মান খুঁজে পাবেন হাতে গোনা গুটি কয়েকজনের ভিতর।
শিক্ষক হিসেবে এই ব্যাপক নিম্নগতির কারন খুবই স্পষ্ট, অন্যান্য সব সেক্টরে কর্মরত জনবলের সাথে গুলিয়ে ফেলে শিক্ষকগণ আর স্বল্প বেতনে বেশী সেবা দিতে ইচ্ছুক নন। অনেকটা নয়টা পাঁচটা অফিস করা কর্মকর্তা বা কেরানির মতোই এখন শিক্ষকদের মানসিকতা। নিজেকে উন্নয়নের জন্য লাইব্রেরীতে সময় দেয়া, দূর্বল শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার প্রতি মনযোগী করে তুলতে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া ইত্যাদি কাজের কোনটিই তাঁরা করতে আগ্রহ পান না। অর্থাৎ শিক্ষক হিসেবে যে আদর্শ ও ত্যাগের জায়গাটি একসময় খুব শক্তিশালী ছিলো তা আজ অন্য পেশার সুযোগ সুবিধা ক্ষমতা ইত্যাদির সাথে তুলনা করতে গিয়ে তলানীতে পড়ে গেছে শিক্ষকদের মহান মর্যাদার স্থানটি। অন্যদিকে শিক্ষকতা পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে মেধাবীদের মধ্যে অনীহাও অন্যতম কারন বিদ্যালয়গুলোতে আদর্শ শিক্ষকের দেখা না পাওয়ার। কারন মেধাহীনদের দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উদ্ভাবনীমূলক কোন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। তারা কোনমতে নিজেকে চাকুরীতে টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করবে সে অন্যায় করে হলেও, মারপিট করতে হলেও পিছপা হবে না।
শিক্ষকদের মধ্যে এই মেধার ঘাটতি মুক্তির জন্য বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও পিএসসি এর মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। যদিও ইদানীং শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা দিয়েই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে হচ্ছে সকলকে। কিন্তু আমার কাছে সেটিও খুব উপযুক্ত পদ্ধতি মনে হয় না, ভালো ছাত্র হলেই ভালো শিক্ষক হবেন এমনটি কোনভাবেই নিশ্চয়তা দেয়া যায় না। তাই মেধা যাচাইয়ের পাশাপাশি শিক্ষক হিসেবে তাঁদের অন্যান্য যোগ্যতা যাচাই বা তাঁদের শিক্ষক হিসেবে গড়ে তুলতে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সরকারী কর্মকর্তাগণ যেমন ছয় মাসের বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন বা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ যেমন এক বছর ব্যাপি পিটিআই তে প্রশিক্ষণ পান এরকম বেশ কয়েকটি ধাপে বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপযুক্ত শিক্ষক হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সরকারী মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরকে উদ্যোগ নিতেই হবে। নিয়োগ পেয়েই যেন কেউ সারাজীবনের জন্য অকর্মা শিক্ষক না হয়ে পড়েন সেটি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য যথাযথ কতৃপক্ষ উদ্যোগ নেবেন। কারন প্রতিজন শিক্ষক জাতির এক একজন আত্মা, সেই আত্মা যদি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে জাতি হিসেবে আমাদের হাজার বছর পিছিয়ে যেতে হবে।
আমার কথা হলো একজন যখন শিক্ষক হিসেবে চূড়ান্তভাবে নিজের পেশা বেছে নেবেন স্বেচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় তাঁকে সারাজীবনের ধ্যান জ্ঞানে শিক্ষকের মর্যাদার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। সমাজের সবকটি শাখায় পচন ধরলেও শিক্ষা সেক্টরকে কলুষমুক্ত রাখতে হবে আমাদের বৃহত্তর স্বার্থেই। অনেক শিক্ষকদের বলতে শুনি আমাদের কি পেট নেই, পরিবার পরিজনের দায়িত্ব পালন করতে হয় না, আদর্শ দিয়ে কি পেটের খাবার মেলে? আমার স্পষ্ট মতামত আপনি পেশা হিসেবে শিক্ষকতা বেঁছে নিয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। হাতে সময় থাকলে পেশা পরিবর্তন করুন অথবা নিজেকে আপদমস্তক শিক্ষক হিসেবে গড়ে তুলুন।
একজন শিক্ষকের লেখাপড়া কোনদিন শেষ হয় না, তিনি জীবনব্যাপীই শুধু শিখবেন ও শেখাবেন এটাই শিক্ষকতার মূল ব্রত। পেটের চিন্তায় বেশী আগ্রহী হলে অধিক টাকা বিনিয়োগ করে পুলিশে যোগ দেন, ওটাই আপনার জন্য উপযুক্ত স্থান। শিক্ষক হিসেবে মহান আদর্শ, আজীবন ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত এবং সর্বোচ্চ সততাই আমাদের কাম্য। আপনার কাছ থেকে শুদ্ধতা শিখতেই অভিভাবকেরা সন্তানদের কষ্ট করে আপনার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে থাকেন। সমাজের নোংরামি, অসততা আর পেটের ধান্ধা শেখার জন্য ঢের সময় পাবে শিক্ষার্থীরা তাদের চারিদিকের অন্যান্য পরিবেশ থেকে। আপনাদের বেতন হালাল করতে হলে আপনাকে অবশ্যই শিক্ষকের সকল সদ্গুণের অধিকারী হতে হবে। অকারণে অভিভাবকদের আস্থা নষ্ট করার অধিকার আপনাকে কেউ দেয়নি, নিজের সন্তানের ভবিষ্যতের ব্যাপারে প্রতিটি অভিভাবকই উদ্বিগ্ন থাকেন সবসময়। এই ব্যাপারটি মাথায় রেখেই শিক্ষকতার মহান দায়িত্ব গ্রহণ ও পালন করতে হয়। তাই আপনাদের কাছে বিনীত অনুরোধ শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেঁছে নিলে একজন প্রকৃত শিক্ষক হয়ে উঠুন অথবা আমাদের সন্তানদের অপশিক্ষার অভিশাপ থেকে মুক্তি দিন।
চলবে ………………………………
পল্লব খন্দকার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩
mazhabkh93@gmail.com