বর্তমান বাসাটা পরিবর্তন করবো বলে গতকাল বাসা দেখতে বেরিয়েছি। একটা বাসা পছন্দ হল। বাড়িওয়ালা আংকেল বেশ বয়স্ক। আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন। কি করি? এখন কোথায় থাকি? কেন বাসা পরিবর্তন করতে চাই এসব টুকিটাকি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন। সবশেষ আমি জিজ্ঞেস করলাম আংকেল আপনি কি করতেন?
তিনি বললেন, আমার জীবন অনেক বৈচিত্র্যময়। অনেক ঘটনাবহুল। তার চুল কাটার স্টাইল সেনাবাহিনীর মত দেখে আমি বললাম, আপনি আর্মিতে ছিলেন নাকি? উনি বললেন, ৭২ সালে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে আর্মিতে ছিলাম কিছুদিন। তুমি আসো বাবা, বাসা পছন্দ হলে আসো তখন গল্প করা যাবে।
বাসা থেকে বেরিয়ে পাশেই মোড়ে চায়ের দোকানে আসলাম। একজন আপা চা বিক্রেতা। দুটো লাল চা চাইলাম। আমার সাথে আমার একজন কলিগ ছিল। চা হাতে নিয়ে বললাম, আপা আশেপাশে কম টাকায় ভাল কোনো বাসা ভাড়া পাওয়া যাবে?
আপা বলল, সামনে হলুদ বিল্ডিং এর পরে গেইটে জাতীয় পতাকা আঁকা একটা বিল্ডিংয়ের নিচতলা খালি আছে। বাসা বেশ ভাল হবে। আমি বললাম, ওই বাসা তো মাত্র দেখে আসলাম। আপনি তো ভালোই খবর রাখেন, তা বাড়িওয়ালা মুরুব্বি কি করতেন আগে?
চা বিক্রেতা আপা বললেন, উনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন শুনেছি। কিছু করতো কিনা জানি না, আমি কয়েকবছর এখানে চায়ের দোকান দিয়েছি। ওনার একটা ছেলে ম্যাজিস্ট্রেট, আরেকজন ব্যাংকার, মেয়ে আছে একটা সে ও পরিবার পরিকল্পনায় চাকরি করে।
আমি এক মুহূর্ত ভাবলাম, মুরুব্বি আমাকে কেন ওনার পরিচয়টা আমাকে পরিষ্কার করেননি? একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। শুধু গত ১৭ বছরে না আমার জন্মের পর থেকে যতটুকু দেখতে পেরেছি গত ৩০-৩২ বছরে মুক্তিযোদ্ধারা গর্ব করে বলেছে আমি মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। অথচ আওয়ামীলীগ এই গর্বিত পরিচয়টাকে এতটাই অপব্যবহার করেছে এবং এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে, একজন মুক্তিযোদ্ধা তার পরিচয় দিতে ইতস্তত বোধ করছেন! আওয়ামীলীগ মুক্তিযুদ্ধের মত গৌরবময় উপ্যাখ্যনকে রীতিমত ধর্ষণ করে ছেড়েছে। মুক্তিযোদ্ধা বললেই প্রথমে মনে আসে, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা না তো! তারপর মনে হয়, ব্যাটা আওয়ামী লীগের মত চোর/লুটেরা নাকি! তারপর মনে হয় ভোট ডাকাতের সহচর নাকি!
আমার এলাকায় আমি দেখেছি আওয়ামীলীগ করা মুক্তিযোদ্ধারা ১৪, ১৮, ২৩ নিশিরাতের ভোট/আমি ডামির ভোটের আগের দিন মুজিব কোট পিন্দে, কোটের ওপর সোনালী কালারের নৌকার ব্যাজ লাগিয়ে রাস্তার মাঝখান দিয়ে দল বেঁধে হেঁটে বেড়াত। তারা ভোট চাইতে কারো বাড়িতে ঢুকিনি (ভোটের তো দরকারই ছিল না ) ভোট কেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য কাউকে হুমকি দেয়নি কিন্তু, নৌকার ব্যাজ পরে, মুজিব কোট পরে দলবেঁধে বের হওয়ার মাধ্যমে বিরোধী মতের সমর্থকদের বুঝিয়ে দিয়েছে- তোদের নেতারা আজ ঘরছাড়া, আওয়ামী লীগের গুন্ডবাহিনী যারা তোদের বাড়ি গিয়ে ভোট কেন্দ্রে যেতে নিষেধ করেছে, যারা তোদের নেতাদের ধরিয়ে দিয়েছে আমরা তাদেরই লোক, আমরা তাদের দলে আছি, অতএব সাবধান!
অথচ একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রেক্ষাপটই ছিল ভোটের মাধ্যমে আমাদের নির্বাচিত নেতার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার যে টালবাহানা সেটারই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। এই মুক্তিযোদ্ধারা এই কথাটি যেন বেমালুম ভুলে গিয়েছিল।
যাহোক, আবার ঘটনায় ফিরে আসি। মুরুব্বির ছেলে ম্যাজিস্ট্রেট এটাও আমাদেরকে বলেননি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোনো পিতার ছেলে ম্যাজিস্ট্রেট আর সেই পিতা ১০ টা কথার মধ্যে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে নিজের ছেলে ম্যাজিস্ট্রেট এই কথা বলে না বা বলতে চায় না এটা বিরল ঘটনা। তবে এমন মানুষ থাকতেও পারে। তবে আমি অনুমান করি ওনার তিন সন্তানই সরকারি চাকরিজীবী হয়েছেন নিঃসন্দেহে মুক্তিযোদ্ধা কোটার জোরে। এটিতে আমার দুঃখবোধ বা পরশ্রীকাতরতা নেই বরং আফসোস হচ্ছে যে, এখন নিজের পরিচয় দিতে লজ্জা পাওয়ার অবস্থায় চলে গিয়েছেন লোকটি।
বিশ্বাস করেন ভাইলোক! আমি চায়ের কাপ বেঞ্চের ওপর রেখে আমার কলিগের সামনে দু হাত তুলে হাসতে হাসতে দোয়া করলাম- আল্লাহ, এরকম নির্মম, উদ্ধত্যপূর্ণ, চরমপন্থী রাজনৈতিক বয়ানের যেন আবির্ভাব না হয় যার ফলে - আমাদের ২৪ এর বীর সন্তানদেরকে নিজেদের পরিচয় লুকাতে হয় বা বলতে লজ্জা পেতে হয়!
লেখা: মোঃ রবিউল ইসলাম এর ফেসবুক থেকে নেয়া।
সংকলন: দৈনিক আলোকবর্তিকা।