স্কুল জীবনে ৬ষ্ঠ বা ৭ম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়েই শরৎ, সমরেশ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাঠের অভ্যাস গড়ে উঠেছিলো গ্রামের স্কুলের ছোট্ট একটি লাইব্রেরির কল্যাণে। পাশাপাশি আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সাথে ঘনিষ্ট আত্মীয়তার সূত্রে বেড়াতে গেলে তাঁর পারিবারিক বইয়ের সংগ্রহশালা থেকেও শেষের কবিতা থেকে কালবেলা, গোরা, মাধুকরী, শ্রীকান্ত, পথের পাঁচালী, গৃহদাহ এসব উপন্যাস পড়ে ফেলায় অল্প বয়সেই কি একটু বেশি পেকে গিয়েছিলাম কিনা? আমি কলেজ জীবনের বন্ধুদের বই পড়ার পরিসংখ্যান থেকে দেখেছি তারা অধিকাংশই মাসুদ রানা, হুমায়ন আহমেদ দিয়ে বই পড়ার সূত্রপাত ঘটিয়েছিলো। তাই খুবই ব্যতিক্রম ছিলাম সাহিত্য আড্ডায়, বন্ধুদের মধ্যে হুমায়ন আহমেদের প্রতি অন্ধ ভক্তি দেখে অবাকই হতাম। ওদের পাল্লায় পড়েই নন্দিত নরকে, শংখনীল কারাগার পড়ে মজা পেয়ে গেলাম, ইমদাদুল হকের পরাধীন পড়েও ভীষণ ভালো লেগেছিলো তবে পাড় ভক্ত কখনো হতে পারিনি হুমায়ন আহমেদ স্যারের। পরবর্তীতে ঢাকায় বইমেলায় স্যারের সাথে দুই একবার দেখা হলেও অটোগ্রাফ নেবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে চেষ্টা করিনি। অন্যদিকে মাসুদ রানার দুই একটা বই পড়ে মজা পেলেও তা থেকে স্থায়ী কোন আনন্দ খুঁজে পাইনি যতটা পেয়েছি রবীন্দ্রনাথ, বিভূতি ভুষণ, মানিক বন্দোপাধ্যায়, তারাশংকর পড়ে। শেষের কবিতা যে কতোবার পড়েছি তার কোন হিসেব নেই, যতোবার পড়ি ততোবারই নতুন মনে হয়, কারন আমি খুবই স্বল্প মেধাসম্পন্ন মানুষ, কোন লেখাই বেশিদিন মনে থাকে না বিশেষ কিছু উদ্ধৃতি ছাড়া। মজার ব্যাপার হলো নিজের লেখা দেখে নিজেই কিছুদিন পর মনে করতে পারি না কার লেখা সেটি!
নাদান বই পাঠক হিসেবে ভাষা ও ভাবের সুক্ষতার কারনে স্কুল জীবনে কাজী নজরুল, মাইকেল মধুসূদন, বঙ্কিম চন্দ্র বাবুদের লেখার গভীরতা আমি বুঝতেই পারতাম না। তাই এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার পর নজরুলের ব্যাথার দান, বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী পড়ে এতো এতো আনন্দ পেয়েছিলাম যে নজরুলকে গুরু মেনে নিলাম। সুনীল, সংকর, প্রথম আলো, পূর্ব-পশ্চিম, ন হন্যেতে, লা নুই বেঙ্গলী এসবেও মজে ছিলাম দীর্ঘদিন আর সর্বশেষ অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে গ্রামে চলে গেলাম বঙ্কিম ও মাইকেল রচনা সমগ্র নিয়ে। গ্রামের নির্জন পরিবেশে দুই দিকপাল সাহিত্যিকের দাঁত ভাঙ্গা শব্দচয়নের অর্থ বুঝে বুঝে একই বাক্য ২-৩ বার পড়ে পড়ে বুঝতে চেষ্টা করেছি। খুলনায় থাকাকালীন উমেশচন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরি ও বয়রায় অবস্থিত সরকারি গণ-গ্রন্থাগারে নিয়মিত যাতায়াত ছিলো। তখনকার দিনে বই পড়াটাকেই মনে হতো জীবনের শ্রেষ্ঠতম আনন্দ, বইয়ের যান্ত্রিক লেখায় বুদ হয়ে আমিই হয়ে যেতাম সেই গল্প বা উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা। একেকটা বই পড়া, সেটা নিয়ে বন্ধুদের সাথে সাহিত্য আড্ডা, আলোচনা, সমালোচনা, হাসি, কৌতু্ক, রাগ-বিরাগ বিনিময় করেই কতো অলস সময় পার হয়েছে জীবনে তার কোন হিসাব রাখা হয়নি। বই পড়ে পড়ে আবার ভালো লেগে যাওয়া উদ্ধৃতিগুলো ডায়েরিতে টুকে রাখা, সেগুলো মাঝে মাঝে দেখা ও অপরিমেয় স্বর্গীয় আনন্দ অনুভব করার দিনগুলো কিভাবে যেনো ফুড়ুৎ করে উড়াল দিলো ১৯৯৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে কর্ম জীবনে প্রবেশের পর।
হঠাৎ করেই যেনো জীবনের অগ্রাধিকার পরিবর্তিত হয়ে বই না পড়ার অভ্যাসের দিকে ধাবমান হয়ে পড়লো, অবশ্য লেখালেখির অভ্যাস তখনো থেকে গেলো। কর্মজীবনে তাই বই পড়ার চেয়ে চিঠি লেখা, কাব্য চর্চা, ডায়েরি লেখার দিকে অধিক ঝুঁকে পড়লাম, মাঝে মাঝে হাতের কাছে পাওয়া বই পড়ে ফেলতাম বটে কিন্তু বই পড়ার সেই যে নেশাটা ছিলো তার অবসান ঘটলো কোন পূর্বাভাস ছাড়াই। আরো গুরুতর হয়ে গেলো ২০০৪ সালে বিবাহিত জীবনে প্রবেশের পর হতে, হাইওয়েতে চলমান গাড়ির গতি ব্রেক কষলে যেভাবে ১০০ থেকে শূন্যতে নেমে আসে সেভাবেই আমার বই পড়ার গতিতে ব্রেক পড়লো। লেখালেখিও উচ্ছন্নে গেলো বিবাহিত জীবনের নতুন দায়িত্ব সামাল দিতে গিয়ে, বইয়ের স্থলে বৌকে পড়ার তাল বেতালে আমার সাহিত্য জীবনের আপাত পরিসমাপ্তি ঘটে গেলো।
এরপর পেপার পত্রিকায় ফেসবুক, ইউটিউব নামক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে বেশ লেখালেখি চলতে থাকলো, স্মার্ট ফোন ব্যবহারকারী পরিচিত কয়েকজন দেখলাম ফেসবুকে একাউন্ট খুলেও ফেলেছেন। তখনো স্মার্ট ফোন ব্যবহার আরম্ভ করিনি, একদিন পরিচিত জনৈক টেলিভিশন শিল্পীর লাইভ অনুষ্ঠান দেখে ও তার মুখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ফেসবুকের গুনাগুন ও বন্ধু খুঁজে পেতে সহায়তাকারী জনপ্রিয় একটি টুল হিসেবে জানতে পেরে সাইবার ক্যাফেতে মেইল চেক করতে গিয়ে ফেসবুক সার্চ দিলাম। ২৩ মার্চ ২০০৯ সালে একখানা নিজের ফেসবুক একাউন্ট খুলে ফেলে শিক্ষানবীশ হিসেবে মাঝে মাঝেই সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে ফেসবুক চালাতে শিখলাম। ধীরে ধীরে বন্ধু সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলো, বেশ মজা পেতে থাকলাম বিভিন্ন পোষ্ট পড়ে ও মন্তব্য দেখে বা লিখে। নিজেও কিছু কিছু পোষ্ট দেয়া শুরু করলাম। অফিসের কম্পিউটারে বসে ফেসবুকে সময় অপচয় আরম্ভ হলো, কারো একখানা ল্যাপটপ পেলেই লগ ইন করে ফেসবুক চালাতে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। তারও বেশ কয়েক বছর পর ২০১১ সালের দিকে আন্তর্জাতিক একটি প্রতিষ্ঠানে কাজের সূত্রে অফিসিয়ালি একখানা স্মার্ট ফোন পাওয়া গেলো। এরপর বাকিটা ইতিহাস, স্মার্ট ফোন আর ফেসবুকই হয়ে উঠলো জীবনের অবিচ্ছেদ্দ্য অংশ যেনো! দেখতে দেখতে ফেসবুক বন্ধু সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়ে ১০০০ ছাড়িয়ে এখন ৫০০০ এর কোটায় গিয়ে থেমে গেছে। স্মার্ট ফোনের আসক্তি আর ফেসবুকের দাপটে আমরা হয়ে গেছি ডিজিটাল দুনিয়ার দাস, পঞ্চাশে পড়া একজন বাংলাদেশীর এর ডিজিটালাইজেশন সত্যিই অবাক করার মতো এক রূপান্তর! বই, সংবাদপত্রের এনালগ আসক্তি এখন যাদুঘরে পাঠানোর অবস্থায় পড়েছে, আমি এখন আর প্রিন্টেড সংবাদপত্র পড়ি না, স্মার্ট ফোন বা ল্যাপটপে অনলাইন ভার্সন পড়তে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
তাই আশীর্বাদ বলি আর অভিশাপ বলি স্মার্ট ফোন আর ফেসবুক আমাকে নতুনরূপে পড়া ও লেখালেখির জগতে ফিরিয়ে এনেছে। আমি এখন ফেসবুকেই কবিতা লিখে পোষ্ট দিই, লেখালেখির জন্য একটি আলাদা ফেসবুক আইডিই নতুন করে খুলে ফেলেছি। নিজের এই পরিবর্তন থেকে আমার এই বোধ জন্মেছে যে আমাদের পুরনো প্রজন্ম তো ডিজিটাল দুনিয়ার সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছেই আর নতুন ও আগামী প্রজন্মের সবাই আজ পুরোপুরি স্মার্ট দুনিয়ায় সম্পূর্ণভাবে নিমজ্জিত। এই বোধ থেকেই অনলাইন পত্রিকা পরিচালনার বাসনা তৈরি হয়, নিজের লেখার মান নিয়েও কিঞ্চিৎ আত্মবিশ্বাস তৈরি হওয়াতে সাহস করে উন্মোচিত করলাম লেখালেখির নতুন দিগন্তে প্রবেশের বাসনায়। ফলাফল 'দৈনিক আলোকবর্তিকা' অনলাইন পত্রিকা।
পল্লব খন্দকার
১৫ জুন, ২০২৩।