সাফল্যের সাথে মাতৃ মৃত্যুহার কমিয়ে আমাদের গড় আয়ু ইর্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়ে বাহাত্তর বছর পর্যন্ত পৌঁছেছিলো। এমন প্রাকৃতিক দূর্যোগ প্রবণ, সড়ক দূর্ঘটনা আর পশ্চাদপদ চিকিৎসা সেবা পাওয়া মানুষের দেশে যেখানে বেঁচে থাকাই সৌভাগ্যের সেখানে সত্তরোর্ধ জীবন প্রাপ্তি নিশ্চিত পরম সন্তুষ্টির একটি বিষয়। কিন্তু গত ৩০ আগস্ট দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে প্রকাশিত একটি সংবাদ ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ বয়ে এনেছে।
সংবাদটি একটু দেখে নিইঃ
"গত মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট ‘এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স-২০২৩’ শীর্ষক এক বৈশ্বিক গবেষণা প্রতিবেদনে বায়ু দূষণের ভয়ংকর তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেছে। এতে বলা হয়েছে-বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশে পরিণত হয়েছে। এই দূষিত বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়ার কারণে বাংলাদেশিদের গড় আয়ু কমে যাচ্ছে প্রায় ৬ দশমিক ৮ বছর। এলাকা ভেদে এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজীপুর দেশের সবচাইতে দূষিত জেলা। কেবল বায়ু দূষণে এই জেলায় বসবাসরত মানুষের গড় আয়ু কমে যাচ্ছে ৮ দশমিক ৩ বছর। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী বায়ু দূষণ বিশ্ববাসীর জন্য সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে উঠেছে। সামগ্রিকভাবে দূষিত বায়ু মানুষের আয়ু কমিয়ে দিচ্ছে। তবে দূষণ সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে বিশ্বের ছয়টি দেশে। দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, চীন, নাইজেরিয়া ও ইন্দোনেশিয়া।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে,গড় আয়ু বিবেচনায় বায়ু দূষণ বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হৃদরোগের পরেই দ্বিতীয় বড় হুমকি। এর প্রভাব ধূমপানের চেয়ে মারাত্মক। তামাক সেবনের কারণে গড় আয়ু যেখানে কমে যাচ্ছে ২ দশমিক ১ বছর, যখন শিশু এবং মাতৃ অপুষ্টি গড় আয়ু কমিয়ে দিচ্ছে ১ দশমিক ৮ বছর, বায়ু দূষণের প্রভাব দেখা যাচ্ছে এর চাইতে কয়েক গুণ বেশি। এর মধ্যে ধূমপানে মৃত্যুর চেয়ে তিন গুণ, সড়ক দুর্ঘটনার মৃত্যুর তুলনায় ৫ গুণ মানুষ বায়ুদূষণে মারা যাচ্ছে।
বায়ু দূষণের কারণে ক্ষণস্থায়ী সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে:নাক-মুখ জ্বালাপোড়া, মাথা ঝিমঝিম ও ব্যাথা করা, বমি বমি ভাব। অন্য দিকে ফুসফুসে ক্যান্সার, হাঁপানি, ব্রংকাইটিস, যক্ষ্মা, কিডনি রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, জন্মগত ত্রুটি, হার্ট অ্যাটাক, চর্মরোগ ইত্যাদিসহ অনেক রোগের মূল কারণ বায়ু দূষণ। এই দূষণের ফলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে সারাবিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।"
বায়ু দূষণ থেকে রক্ষা পাবার উপায় কি?
এভাবে দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকলে গড় আয়ু নিশ্চিত আরো কমতে কমতে কোথায় পৌঁছাবে তা আমাদের কল্পনার অতীত। অবকাঠামো উন্নয়নের দোহাই দিয়ে আমরা প্রাকৃতিক পরিবেশের নির্বিচার ধবংশযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের কৃত কর্মের ফলাফলস্বরূপ এই ভয়ঙ্কর পরিণতি, এই পরিবেশ বিনাশী দানবীয় চর্চা থেকে এক্ষুনি বের হয়ে আসার কোন বিকল্প আর হাতে নেই। ব্যাপকহারে বনায়ন, জলাধার সংরক্ষণ, কার্বন ও সীসা নির্গমকারী কালো ধোঁয়া সৃষ্টিকারী গাড়িঘোড়া নিষিদ্ধকরণ সহ সব ধরণের উন্নয়নের সাথে পরিবেশ বান্ধব প্রকল্প বাস্তবায়ন অত্যাবশ্যকীয় করতেই হবে। বায়ু দূষণ কমাতে পরিবেশ রক্ষায় সর্বোচ্চ মনোযোগ প্রদান এখন সময়ের এক নম্বর দাবী, কোথাও পরিবেশের নূন্যতম ক্ষতিগ্রস্থ হবার সম্ভাবনা তৈরি হলে শূণ্য সহ্য নীতি বা জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণের আর কোন বিকল্প নেই।
আমরা ইচ্ছে করলেই সকল ধরণের কলকারখানাগুলোকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে পারি তার প্রমাণ শতভাগ গ্রীন গার্মেন্টস তৈরি করে ইতিহাস সৃষ্টি করা হয়েছে। এই ধারা অব্যাহত রেখে ভবিষ্যতের টেকসই পরিবেশ রক্ষায় প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পাঠ্য বইয়ে পরিবেশ রক্ষা ও সচেতনতা তৈরির বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। প্রতিটি জেলায় জেলায় পরিবেশ রক্ষায় শক্তিশালী মনিটরিং কমিটি গঠন ও পরিবেশ বিনষ্টকারীর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় বায়ু দূষণের কবলে পড়ে আমাদের মৃত্যুর মিছিল হবে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুরক্ষায় আমরা নিশ্চই আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।
সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক অনলাইন সংবাদ (৩০ আগস্ট ২০২৩)
মূল লেখাঃ আনোয়ার আলদীন।
সংকলনঃ দৈনিক আলোকবর্তিকা পরিবেশ বিজ্ঞান ডেস্ক।