২০১৯ এর ডিসেম্বরে চীনের Wuhan শহরে সর্বপ্রথম আত্মপ্রকাশ করেন এ শতাব্দীর ভয়ঙ্করতম মহামারি কোভিড-১৯ ওরফে স্যার করোনা। আমরা একটি নতুন ভাইরাসের নাম শুনতে পাই Severe Acute Respiratory Syndrome Coronavirus 2 (SARS-CoV-2)। মূহুর্তেই সে গুজব, ঠাট্টা, আলোচনা, সংবাদ, আড্ডার প্রধান বস্তুতে পরিণত হয় সারা বিশ্বে। অসংখ্য নতুন নতুন শব্দ আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে প্রবেশ করে, কোয়ারেন্টাইন, শাট ডাউন, লক ডাউন, ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধোয়া, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক ব্যবহার সহ নিত্য নতুন স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ের সাথে আমরা পরিচিত হই। ফেসবুক, ইউটিউব সহ সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একমাত্র আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয় স্যার করোনা। সরকারি স্বাস্থ্য বিভাগ, মহামারি বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য কর্মীদের পুনঃপুন সচেতনতামূলক প্রচারণায় কেউবা আতঙ্কিত কেউবা পুলকিত অনুভব করে করোনা নিয়ে রস রসিকতায় মেতে উঠি আমরা। আন্তর্জাতিক ও আভ্যন্তরীণ বিমান চলাচলও সীমিত বা বন্ধ করে দেয়া হয় দেশে দেশে। চীনের সীমানা ছাড়িয়ে করোনা জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি জুড়ে হানা দেয় ইউরোপে, ইতালিতে শুরু হয় মৃত্যুর মিছিল। আমরা তবুও ভাবতে থাকি এটা শীতপ্রধান দেশের মহামারি, আমাদের কিছুই হবে না, করোনা স্বপ্নও দেখায় আলেম ওলামাগণকে, এদেশে আসবেন না তিনি। মূলতঃ ইহুদী-নাসারাদের ধ্বংসের মিশনে তিনি পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন, মুমিনদের কোন ক্ষতি করবেন না। যদিও এদেশে আসেন তবুও তিনি বড় ধরনের আক্রমণ শানাবেন না, শুধু কিছু মানুষকে শিক্ষা দিতে আসবেন। কিছুদিন তেমনটাই মনে হচ্ছিলো করোনার ভাবগতিক, ইউরোপ থেকে লম্বা লাফ দিয়ে আফ্রিকায় না গিয়ে আমেরিকা আক্রমণ করে বসলো।
করোনা ও মৃত্যু ভয়ে ইতালি ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে বিশেষ বিমানযোগে দেশের নিরাপদ নীড়ে ফিরে আসতে থাকলেন হাজার হাজার প্রবাসী। বিমনবন্দরে কোয়ারেন্টাইন মানবেন না, সাতদিন ক্যাম্পে থাকবেন না এসব দাবি নিয়ে সোচ্চার হয়ে ছড়িয়ে পড়লেন দেশের আনাচে কানাচে। নিজেদের অজান্তেই বহন করে আনলেন করোনা ভাইরাস এবং ছড়িয়ে দিলেন এ দেশের নির্মল বাতাসে। আমরা ৬ ফুট দূরত্ব মেনে সংক্ষিপ্ত অফিস সময়ে অভ্যস্ত হতে হতেই ঢাকার বাইরে প্রথম ৩ জনের করোনা সনাক্ত হয় ৮ মার্চ ২০২০ সালে। তখন হোম অফিস, জুম মিটিং, হোম ডেলিভারি ইত্যাদি বিষয়ের সাথে আমাদের সম্পৃক্ততা বাড়তে থাকে। আমাদের ভূ-খন্ডে ১৮ মার্চ ২০২০ করোনায় প্রথম মৃত্যুর খবরটিও প্রচারিত হয়! চারিদিকে তখন আতঙ্ক, যারা হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠেছিলো তারাও সতর্কতা অবলম্বন করতে বাধ্য হলো স্যার করোনার করুনা পাবার জন্য। ব্যবসা-বানিজ্য স্থবির হয়ে পড়লো, রাস্তাঘাটে মানুষ চলাচল বন্ধ হয়ে গেলো, দিনমজুর বেকার হয়ে পড়লো, বহু মানুষ কাজ ও ব্যবসা হারালো। শুরু হলো সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে খাদ্য সহায়তা, স্বাস্থ্য সামগ্রী বিতরণ, গণসচেতনতা তৈরি। প্রথম প্রথম অপরিচিতদের আক্রান্ত হবার ও মৃত্যুর খবর দেখে নিজেদের নিরাপদ ভাবার একটা মনোভাব তৈরি হলো। যেনো সবাই আক্রান্ত হলেও আমার কিছু হবে না, সবাই মরে গেলেও আমি বুঝি বেঁচে যাবো!
একসময় পরিচিতদের আক্রান্ত হবার খবর এলো, সমস্ত হাসপাতালগুলোর করিডর আক্রান্তদের আহাজারিতে বিভীষিকা ছড়াতে লাগলো। অক্সিজেনের অভাবে পিতার কোলে সন্তান বা সন্তানের কোলে পিতা-মাতা ঢলে পড়তে লাগলেন, আইসিউতে বেড ফাঁকা হয় না। একজন আক্রান্ত বেডের জন্য অন্যজন আক্রান্তের মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গোনেন! হাসপাতালে মৃত্যুর করুন চিত্র দেখে অনেকেই আক্রান্ত হয়েও প্রকাশ করলেন না, নিজ গৃহে বন্দী হয়ে কেউ বা সেরে উঠলেন কেউ বা করলেন মৃত্যুবরণ। গুজব ছড়াতে থাকলো সরকারি হিসেবের বাইরে লাখো লাখো মানুষ মারা যাচ্ছেন চিকিৎসা ও অক্সিজেনের অভাবে। ফেসবুক জুড়ে হৃদয়বিদারক ভিডিও আর আহাজারি, পার্শবর্তী দেশের মহামারি পরিস্থিতি আরো ভয়ঙ্কর, আতঙ্ক আর ভয়ের এক অবাক পৃথিবীতে আমরা মৃত্যুর তাড়া খেয়ে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করতে থাকি। এমনই সেই গৃহবন্দী অবস্থা যে ধর্মীয় উপাশনালয়গুলোও বন্ধ হয়ে যায়, কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না, স্ত্রীও করোনা আক্রান্ত প্রবাস ফেরত স্বামীকে ছেড়ে পালিয়ে যাবার খবর বের হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আক্রান্তদের প্রত্যেকেই নিজেকে মৃত্যুর হাতে সপে দেন, আশা হারিয়ে ফেলেন মৃত্যুর মিছিল দেখে। দেশের সর্বোচ্চ ধনী ব্যবসায়ীও করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যবরণ করেন, হাজার কোটি টাকা পড়ে থাকে ব্যাংকে, দেশের বাইরে যাবারও সুযোগ পান না তারা।
এভাবেই ২০২০ পেরিয়ে স্যার করোনা নানান ভেরিয়েন্ট এ রূপান্তরিত হয়ে সর্বাধিক দ্রুততম সময়ে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের কবলে পড়ে কিছুটা ভাটার দিকে মোড় নেন। আমরাও সাহসী হই ভ্যাকসিন গ্রহণ করি, তবুও আক্রান্ত হই কিন্তু হাসপাতালে আর যাবার প্রয়োজন পড়ে না, বাসায় বসেই গরম পানির ভাপ, কোয়ারেন্টাইন আর পুষ্টিকর খাবার খেয়ে করোনামুক্ত হই। ২০২১ সালেও চলতে থাকে বসের ওঠানামা, অনেক দেশে অব্যাহত লকডাউন শাটডাউনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়, মানুষ আর ঘরে বন্দী থাকতে চায় না, এভাবে কি বাঁচা যায়? বিশেষ করে দিনমজুর, বন্ধ কলকারখানার শ্রমিক-কর্মচারীরা পরিবার নিয়ে চরম অসহায় অবস্থায় পতিত হন। আয়ের সব রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়াতে অনেকেই পরিবার গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেন, অসংখ্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা পথে বসে যান। শুধু সবজি বিক্রেতা আর ঔষধ বিক্রেতাদের ব্যবসা ফুলে ফেঁপে ওঠে। কিছু অসাধু চক্র স্বাস্থ্য খাত থেকে তুলে নেন লক্ষ কোটি টাকার কড়কড়ে মুনাফা। লক্ষ মানুষ বেকার হয়ে পড়েন, পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হন কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক, হয়ে যান ডাব বা সবজি বিক্রেতা। প্রাইভেট কোম্পানির টাই পরা সেলস এক্সিকিউটিভ সংসার সামলাতে বনে যান পাঠাও মোটর সাইকেল চালক।
২০২৩ সালের মাঝামাঝি এখন। স্যার করোনা এখনো আছেন আমাদের সাথে তবে ভ্যাকসিন আর গণ-ইমউনিটির কবলে পড়ে হত্যার লাইসেন্স প্রায় হারিয়েই ফেলেছেন। আমরা এখন মৌসুমী সর্দি-কাশির মতো করোনাকে আত্তীকরণ করে নিয়েছি আপনজনের মতোই। আমরা করোনার ভয়ংকর ছোবল হতে লক্ষ কোটি প্রাণের বিনিময়ে রক্ষা পেয়েছি এবং আশ্চর্যজনকভাবে মাত্রই অতীত হয়ে যাওয়া সেইসব ভয়ঙ্কর স্মৃতিকে বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দিয়ে মেতে উঠেছি আমাদের চিরন্তন সেই আদিম খেলায়। এতো যে নিকট থেকে নিকটজনের মৃত্যু, বাঁচানোর সংগ্রাম করে করে কঠিনতম অধ্যায় পেরিয়ে এলাম তবুও কি সেখান থেকে আদৌ আমরা কোন শিক্ষা গ্রহণ করতে পেরেছি?
সেই ঘৃণ্য আর উদ্ধত অহংকার, হিংসার উল্লাস, বিভেদের অনাচার, অত্যাচার, নিপীড়ন, খুন-খারাবি, চক্রান্ত, অবৈধ দখলদারিত্ব, নোংরামি, দলাদলি, হিংস্রতা, মিথ্যাচার, ঘুষ লেনদেন, টাকা পাচার সবই কিন্তু চলছে পূর্নদ্দোমে……………। এখনো পৃথিবী জুড়ে বাজছে যুদ্ধের দামামা, এখনো ক্ষত শুকায়নি, কতো পরিচিতজন ফিরে পায়নি করোনা পূর্ব আয়ের নিয়মিত উৎস্য। হতাশায় অথবা তীব্র মানসিক চাপের কাছে অসহায় আত্মসমর্পন করে ছেড়েছে পৃথিবীর ঠিকানা।
আমার পরিচিতজন কিছু মানুষ আছেন যাদের শারীরিক অসুস্থতাকালীন নিয়ম করে ঔষধ গ্রহণ করেন, চিকিৎসকের সব পরামর্শও মেনে চলেন। তারা এতোই বুদ্ধিমান বা বুদ্ধিমতি বা অতি চালাক যেই না তাদের কিছুটা সুস্থতা ফিরে আসতে শুরু করে অমনি নিয়ম মতো ঔষধ সেবন ছেড়ে দেন, এমনকি কখনো কখনো এন্টিবায়োটিকের ডোজও তারা শেষ করেন না। আমি তখন অনিচ্ছা স্বত্বেও মনে মনে বলতে বাধ্য হই ঔষধের কোর্স শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেনো তাদের অসুস্থতা বহাল তবিয়তে রয়ে যায়! আমার কাছে তাই স্যার করোনাকে এক আশ্চর্যজনক মানবতাপ্রেমি ঔষধের ডোজ হিসেবে মনে হয়! সে এসেছিলো বলেই মনুষ্য সৃষ্ট অনাচারের সব সিস্টেম উল্টে পাল্টে পুরো পৃথিবীটাকে কল্যাণের ধারায় সুস্থ করতে চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু আমরা বেশিদিন করোনার করুনা ভিক্ষা নিতে পারলাম কোথায়?
পল্লব খন্দকার
১৯ জুন ২০২৩।
Leave a Reply