একটি রাষ্ট্র যখন সকল নাগরিকের ভালোমন্দ দেখভালের দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং নাগরিকদের জীবন রক্ষা ও জীবিকার সকল নিশ্চয়তা দিতে পারে তখন সেটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে ধরা হয়। এমন রাষ্ট্রে সকল নাগরিকের অধিকার সমান হিসেবে গণ্য করা হয়, সবাইকে যেকোন রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের জন্য একই নিয়ম মানতে হয়। আমরা ইউরোপের কিছু দেশে দেখি দেশের রাষ্ট্র প্রধান সাধারণ নাগরিকদের সাথে একই লাইনে দাঁড়িয়ে নির্দিষ্ট সেবা গ্রহণ করছেন। আমরা কানাডার প্রধানমন্ত্রীকে দেখি সাধারণ নাগরিকদের সাথে রাষ্ট্রীয় প্রটোকলের ব্যবস্থা ছাড়াই ট্রেনে ভ্রমণ করছেন, নাগরিকদের সাথে সাধারণ মানুষের মতোই গল্প করছেন। ইউরোপ, আফ্রিকা ও দুই আমেরিকা সহ পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে এমন কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে প্রত্যেক নাগরিক নিজেকে অনাকাঙ্ক্ষিত যেকোন বিপদ হতে নিরাপদ ভাবেন, বৈষম্যমুক্ত ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র বজায় রেখে তাঁরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারেন। নারী পুরুষ নির্বিশেষে যার যার মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা ও পছন্দের উপর ভিত্তি করেই নিজের জীবন পরিচালনা করতে কোন ধরনের বাঁধা তাঁরা অনুভব করেন না। চেহারা, আকৃতিগত ত্রুটি অথবা যেকোন প্রতিবন্ধিতার কারনে সেসব রাষ্ট্রে কেউ নিগ্রহের স্বীকার হন না বা নিজেকে নিয়ে কোন হীনমন্যতায় ভোগেন না। বরং সেসব রাষ্ট্রে প্রতিবন্ধিতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে মূল নাগরিকদের মতই সম্মানের সাথে সমান মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে জাতি, ধর্ম, সাংষ্কৃতি কোন ব্যাপারেই কেউ বাড়তি সুবিধাও পান না আবার ব্যক্তি পর্যায় বা রাষ্ট্রের পক্ষ হতে বাধাগ্রস্থও হতে হয় না। শুধুমাত্র কিছু মূল বিষয়াদি যেমন শান্তিপূর্ণ, ঝামেলামুক্ত ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র বজায় রেখে রাষ্ট্রীয় নিয়মানূবর্তিতা পালন করে চলতে হয়। কেউ কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলাতে পারেন না, কে কি পোশাক পরলো বা কি খাবার খায় এসব নিয়ে কারো কোন প্রশ্ন বা কৌতুহল নেই। নির্ধারিত আইন অনুযায়ী ন্যায় বিচার সেখানে প্রতিষ্ঠিত আছে, যেকোন সমস্যায় আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে নাগরিকদের যেকোন বিপদ হতে রক্ষা করতে সদা প্রস্তুত থাকে। সেখানে রাত-বিরাতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একা অথবা দলবদ্ধ হয়ে দেশের যেকোন স্থানে চলাফেরা করতে পারে। চুরি-ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের মতো বিষয়গুলো খুবই অস্বাভাবিক, খুন বা যৌন সন্ত্রাসের মতো ঘটনা কালেভদ্রে ঘটে থাকে। সেসব রাষ্ট্রে রাস্তাঘাট সহ বিভিন্ন অবকাঠামোগুলো শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধিতাসম্পন্ন ব্যক্তি বান্ধব হয়ে থাকে। নতুন কোন অবকাঠামো নির্মানের সময় সমান বিকল্প ব্যবস্থা রাখা হয় যাতে নাগরিক কোন দূর্ভোগ বোধ না করে। এমনকি নাগরিক ইচ্ছে করলে যেকোন দূর্ভোগের জন্য সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের কাছে প্রতিকার চাইতে পারে।
এসব রাষ্ট্র এমনই কল্যাণমূলক ব্যবস্থা চালু করেছে যে একজন মানুষের চাকুরি বা উপার্জনের ব্যবস্থা না থাকলেও রাষ্ট্র তাঁর ও পুরো পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়ে থাকে। গত করোনা মহামারীকালীন কর্ম হারানো সেসব দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রায় ২ বছর ধরে রাষ্ট্রীয়ভাবে ভরণপোষণের ব্যবস্থা করেছে। তবে এতো কল্যাণ প্রতিষ্ঠার পিছনে সবচেয়ে বড় ম্যাজিক হলো সেসব দেশের আয়কর ব্যবস্থাপনা। একজন ব্যক্তি তাঁর আয়ের প্রায় ৫০-৬০ ভাগ সরকারি কোষাগারে জমা করেন, কেউ কর ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করেন না। করেও লাভ নেই, তাঁদের সমগ্র জীবন ব্যবস্থাকে এমনভাবে ডিজিটলাইজ করা হয়েছে যে রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জীতে একটি শিশু জন্ম নেয়ার পর হতেই সমগ্র নির্ভুল তথ্য সংরক্ষিত ও হালনাগাদ থাকে। ইচ্ছে করলেও কেউ রাষ্ট্রকে ফাঁকি দিয়ে বেহিসেবী ধনসম্পদের মালিক হয়ে যেতে পারেন না, সেটা করতে হলেও রাষ্ট্রকে তার পূর্নাংগ অংশীদার করেই অর্জন করতে হয় অর্থাৎ নিয়মের ভিতরেই সম্পদ অর্জন ও নির্ধারিত পরিমান কর প্রদান করতেই হয়। স্বচ্ছ নাগরিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সেখানে সবাইকে স্বচ্ছ থাকতে বাধ্য করা হয়, ব্যক্তিজীবনে একজন অসৎ বা মিথ্যাবাদী হলেও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করার সুযোগ থাকে না।
আমরা এমন কল্যাণমূলক রাষ্ট্রকে অনেক সময় স্বপ্নের দেশ বলে থাকি, এসব দেশে পাড়ি দেবার জন্য জীবনও বাজী রাখি কখনো কখনো। তার কারন খুবই পরিষ্কার, উপরের এইসব নাগরিক সুযোগ-সুবিধার আমরা কতোটাই বা পাই এই দেশে? ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, নারী-পুরুষ, সরকারি-বেসরকারি ইত্যাদি নিয়ে হরেকরকম বৈষম্য আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। অশিক্ষা-কুশিক্ষা আর রাষ্ট্রীয় চরম অব্যবস্থাপনার শিকার হয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হই ন্যায় বিচার থেকে। প্রতিবন্ধিতা সম্পন্ন মানুষদের জন্য নেই সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার পর্যাপ্ত সুবিধা, এহেন কোন দূর্ঘটনা নেই যা যেকোন সময় যেকোন নাগরিকের জীবনে ঘটতে পারে। কোটিপতি থেকে রাস্তায় ঘুমানো মানুষটিও নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারেন না এখানে। কর ফাঁকি দিয়ে অবৈধ সম্পদ লাভ করা এদেশে অনেকটা সাংষ্কৃতির মতো, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারীরা আইনকানুনের উর্ধেব উঠে যেকোন অনিয়ম করতে দ্বিধা করেন না। এখানে সাধারণ জনগণ ও রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারী এমপি, মন্ত্রী, আমলাগণ রাষ্ট্রের সকল সেরা সুবিধাগুলো ভোগ করে থাকেন। দুর্নীতিকে এদেশে সামাজিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে, ভেজাল ও ক্ষতিকারক পণ্য বাজারজাত করে নিয়ন্ত্রণহীন মূল্য নির্ধারণ করে মানুষকে ঠকিয়ে ব্যবসা করা আমাদের কাছে খুবই সাধারণ ব্যাপার। আমরা প্রচন্ড ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ জাতি কিন্তু ধর্মীয় বিধিনিষেধ বা রাষ্ট্রীয় নিয়মনীতি পালনে পুরোপুরি অস্বচ্ছ! আমরা মানুষের সামনে নিজেদের অত্যন্ত উচ্চতায় উঠিয়ে প্রকাশ করতে পছন্দ করি আর প্রকৃতপক্ষে আমাদের মানসিকতা অত্যন্ত নিম্নতায় অবস্থান করে, যাকে অনায়াসে বলা যায় আমরা হলাম যথার্থ হিপোক্রেট জাতি!
পল্লব খন্দকার, ২৮ জুন ২০২৩।
mazhabkh93@gmail.com
Leave a Reply