ছেলেবেলায় শেখা অনেকগুলো উপদেশ বাণীর মধ্যে ক্ষমা করতে পারার মহত্ত্ব বিষয়টা বেশ প্রভাব ফেলেছিলো আমার কিশোর মানসে। প্রথমতঃ আল্লাহ মহান ক্ষমাশীল, ভয়ঙ্কর পাপ করেও যদি মানুষ ভুল বুঝতে পেরে, দোষ স্বীকার করে ও অনুতপ্ত হয়ে প্রকৃতই অন্তর থেকে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন তাহলে আল্লাহ মানুষকে ক্ষমা করে দেবেন। তাই ক্ষমা সয়ং সৃষ্টিকর্তার একটি বিশেষ গুণ, সেই গুণের অধিকারী কোন মানুষ হতে পারলে নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁকে প্রিয় বান্দার তালিকায় স্থান দেবেন। বিশেষ করে আমাদের মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এবং ইসলামের বিভিন্ন খলিফাগণের জীবনী পড়ে, তাদের উপর ঘটে যাওয়া অত্যাচার নিপীড়নের পরেও ইসলাম প্রচারের জন্য সবাইকে ক্ষমা করে দেয়ার দৃষ্টান্ত সমূহ ছিলো আমার প্রেরণা ও অন্তর্গত অনুধাবনের উৎস্য। তাই যেকোন বিরূপ পরিস্থিতি বা ঘটনার মুখোমুখি হলে বিচলিত বা উত্তেজিত না হয়ে স্থির থেকে ক্ষমা করতে পারার মধ্যে আনন্দ খুঁজে পাবার চেষ্টা আমার জীবনাচারণের একটা অবিচ্ছেদ্দ্য অংশ হয়েই আছে। কারো কথায় বা আচরণে আমি প্রচন্ড আঘাত পেলেও সহসা প্রতিবাদ করতে পারি না, আর তিনি যদি হন বয়োজেষ্ঠ্য তাহলে আরো বেশি মাথা নত হয়ে যায় আমার। এজন্য আমাকে পরিবারের বা বন্ধুদের কাছে চিরদিনই বিভিন্ন ভৎসনা গঞ্জনা শুনতে হয়েছে কেনো প্রতিবাদ করি না, আমার কোন মেরুদন্ড নেই, প্রচলিত সমাজের ভাষায় আমি হলাম একটি বিশেষ গালির যোগ্য!
বর্তমান সমাজের স্মার্টনেস এর সংজ্ঞার আলোকে অহেতুক তর্ক, উচ্চবাচ্য, কাউকে আঘাত দিয়ে কথা বলা, অশ্রাব্য গালিগালাজ, চাপাবাজি, অবলীলায় মিথ্যা বলা, কুটিলতা, গুটিবাজি, তৈলবাজি এসব সদ্গুণ আমি রপ্ত করতে না পারায় কর্মক্ষেত্রে প্রায়ই বিরূপ পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছি। পারিবারিক, সামাজিক ও দাপ্তরিক ক্ষেত্রে আমার সহজ সরল অভিব্যক্তি প্রকাশের কারনে প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে লাঞ্ছনার স্বীকার হয়েছি বহুবার। সবকিছু বুঝেও এখনো কিন্তু নিজেকে বদলাতে পারিনি, সেই আগের মতোই আছি। যদিও ইদানিং বুঝতে পারি বয়স বৃদ্ধিজনিত কারনে সামান্যতেই রাগ উঠে যায় বা ধৈর্য্যচূতি ঘটে প্রায়ই। মুহুর্তে নিজেকে সামলে নিই, মনে মনে বলি ক্ষমা একটি মহৎ গুণ। অনেক্ষণ মন খারাপ হয়ে থাকে তারপর ধীরে ধীরে কেটে যায় অমাবশ্যার অন্ধকার, তারপর মনের আকাশ জুড়ে ওঠে ঝলমলে পূর্ণিমার চাঁদ। অল্প বয়সে অবশ্য কারো উপর বা কোন ঘটনার কারনে মনের ভিতর রাগ বা ক্ষোভ জন্মালে মনে মনে ধুমসে উচ্চারণের অযোগ্য গালিগালাজ করতাম, তাতেও ক্ষোভ না মিটলে ফাকা জায়গায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে অথবা বদ্ধ ঘরে হাত-পা ছুড়ে রাগ নিয়ন্ত্রণ করতাম। কয়েক বছর আগে এক রোজার মাসে একটি ভিন্ন ঘটনার সূত্র ধরে এক ঘনিষ্ঠজন মোবাইল ফোনে চরম দূর্ব্যবহার করলেন! আমি অনুরোধ করলাম আপনি রোজার মাসে এসব নোংরা কথা উচ্চারণ করে রোজা হালকা করবেন না। আমার অনুরোধ শুনে তিনি গালিগালাজের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিলেন এবং আমাকে সর্বোচ্চভাবে আঘাত করার জন্য আমার বাচ্চার অটিজম ডিজেব্যেলিটি নিয়ে চরম অপমান সূচক উক্তি করলেন! আমি হতভম্ব হয়ে নোংরা ভাষায় বর্ষিত সেই কটু কথাগুলো শুনছিলাম আর নিজের জন্য না বরং সেই ঘনিষ্ঠজনের হেদায়েতের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছিলাম?
তবে একজন নবী ও সাপের একটি শিক্ষামূলক গল্প আছে রাগ করা ও রাগ না করা নিয়ে। সাপ কামড়াবে না জানলে যেমন মানুষ তাকে নিয়ে একদম হেলাফেলা করবে তেমনি আমাকে নিয়েও কেউ কেউ কখনোবা তেমন চেষ্টা করে থাকেন। নবী সাপকে কামড়াতে নিষেধ করেছিলেন কিন্তু ফোস করতে বা ফণা ধরতে কিন্তু নিষেধ করেননি। আমার ক্ষেত্রে ফোস করা বা ফণা তোলার ব্যাপারটা এই লেখালেখির ভিতর দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। আমি খেয়াল করেছি যদি আমি চাই তবে লেখনীর মাধ্যমে তীব্র আক্রমণ করতে পারি যা হয়তো মুখে বলতে পারি না। আমার লেখার ফণার আঘাতে যে কাউকে বিষে জর্জরিত করতে পারি যখন-তখন। যদিও সচারচার তাও আমি করি না, কর্মক্ষেত্রে নিতান্ত বাধ্য হয়ে শোকজ লেখা বা চাকুরী হতে অব্যাহতি পত্র লেখার মতো অজনপ্রিয় কাজ আমাকে বিভিন্ন সময় করতে হয়েছে! পরবর্তীতে তার জন্য অনুতপ্ত হয়েছি, এখনো তাদের কথা মনে পড়লে মন খারাপ হয়, তাদের প্রমাণিত সুনির্দিষ্ট অপরাধের জন্য বরখাস্ত করতে হয়েছে, তবুও ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি সৃষ্টিকর্তার কাছে। আমার স্কুল জীবনের একটি ঘটনায় আমার দেয়া সত্য স্বাক্ষীর প্রেক্ষিতে কিছু বন্ধুকে স্কুল থেকে বহিস্কার করা হয়েছিলো, এখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারিনি, ওদের জন্য এখনো মন খারাপ হয়!
তবে আমরা যদি বর্তমান পারিপার্শিক, দেশীয় ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করি তাহলে দেখতে পাই কেউ কাউকে ক্ষমা করতে প্রস্তুত নয়। সবাই যেনো বিষাক্ত ফণা তুলে বসে আছে ছোবল দেবার জন্য, ঘরে ঘরে,পাড়ায় পাড়ায়, দেশে দেশে হিংসা, হানাহানি, খুন, জখম, যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই আছে সর্বক্ষণ। ক্ষমা শব্দটি এখন প্রায় ডিকশোনারি বন্দী হতে চলেছে যা ভীষণ অকল্যাণকর পুরো পৃথিবী ও মানবজাতির জন্য। ক্ষমা ব্যতিত এই পৃথিবীর মানচিত্র স্থিতিশীল থাকতে পারে না, যুগে যুগে আমরা ক্ষমার মহত্ত্ব সম্পর্কে বহু উদাহরণ দেখেও ক্ষমা করা ভুলে যাচ্ছি। উদারতা বা ক্ষমাকে এ যুগে দূর্বলতার প্রতীক হিসেবে উপহাস করা হয়, তবু আমি বিশ্বাস করি “যে সয় সে রয়”।
পল্লব খন্দকার
১৬ জুন, ২০২৩।
Leave a Reply