দর্শন শাস্ত্রে কোন একটি বিষয়কে উপজীব্য করে হাজারো রকম ব্যাখ্যা দাড় করানো যায়, যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে সাধারণ একটি বিষয় নিয়েও বিতর্কের গভীর থেকে গভীরে প্রবেশ করে জ্ঞানের সমূদ্রে হাবুডুবু খাওয়া যায়। আমরা সাধারণত ডিম আগে না মুরগী আগে এই নিয়ে হাস্য রসাত্মক বিতর্ক করে থাকি, এটাকেই সিরিয়াস বিতর্কের বা আলোচনার বিষয় হিসেবে দর্শন শাস্ত্রে অনায়াসে চর্চা করতে পারি। এরকমই সাধারণ কিন্তু খুবই সিরিয়াস বিতর্কের বিষয় হতে পারে যে আমাদের ক্ষুধা আছে বলেই জীবিকা এত গুরুত্বপূর্ণ, খাদ্য চাহিদা আছে বলেই মানুষের এতো এতো কাজ করতে হয়! বিজ্ঞানের যে এতো উৎকর্ষ সাধন ঘটেছে এরই ধারাবাহিকতায় যদি মানুষের খাদ্য চাহিদা শূন্য করে দেয়া হয় বা মানুষকে ক্ষুধা থেকে মুক্তি দেয়ার মতো মিরাকল কিছু ঘটে যায় তাহলে পৃথিবীর সব মানুষ কি জীবিকার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে কাজ করা বন্ধ করে দেবে? আর সেরকম হলে পৃথিবী কি খুব দ্রুত অচল হয়ে যাবে না?
আমরা অনুমান করতে পারি প্রাচীন যুগে মানুষ শুধুমাত্র খাবার সংগ্রহ করার জন্যই শিকার করা শিখেছিলো, আগুন আবিষ্কার করেছিলো এবং খাদ্য উৎপাদনের উদ্দেশ্যই কৃষি সভ্যতার যুগে প্রবেশ করেছিলো। তাই বলা যেতেই পারে ক্ষুধা মুক্তির মহাচক্রে পড়ে পৃথিবীর তাবৎ প্রাণীকূল টিকে আছে এবং জীবিকা নির্বাহের জন্য হাজারো রকম পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করে থাকে। আধুনিক যুগে শিক্ষিত ও মেধাবীরা মগজের শ্রম দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করার পথ খুঁজে নেয় আর কম শিক্ষিত বা অশিক্ষিত মানুষেরা কঠিন কায়িক শ্রম নির্ভর ও ঝুকিপূর্ণ জীবিকায় নিজেকে নিয়োজিত করে থাকে। যদিও শিক্ষিত মেধাবীরা কম কায়িক শ্রম দিয়েও মস্তিষ্কের খেলায় শ্রমিক শ্রেণীর উপর শ্রেষ্টত্ব বজায় রাখে।
আমি এসব কথার প্রসঙ্গ আনছি যে কারনে তা হলো আমাদের জীবনের মৌলিক চাহিদা হিসেবে খাদ্য কতটা জরুরী সেই ব্যাপারটির গুরুত্ব অনুধাবনে। “দেশ” নামক প্রচলিত ভৌগলিক বিভাজনের কারনে আমরা দেখতে পাই উন্নত দেশের মানুষের বিলাসী জীবনযাপন, অন্য পক্ষে বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর অনাহারী মানুষগুলো খাদ্যাভাবে না খেতে পেয়ে পুষ্টিহীনতায় ধুকে ধুকে মৃত্যু! আমরা চেয়ে চেয়ে দেখি এই চরম নৃশংসতম বিশ্ব ব্যবস্থা, এখানে এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও একপ্রান্তে চলে উদ্বৃত্ত খাদ্যের অপচয় উৎসব অন্য প্রান্তে চলে খাদ্য ঘাটতি নিয়ে অনাহারী মানুষের সারি সারি লাশের বীভৎসতা! যেসব দেশের জনগনের আহার যোগাড় নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই তারা দিব্যি জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য সাংষ্কৃতি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, কূটনীতি, রাজনীতি, খেলাধুলা ইত্যাদি নিয়ে মেতে আছে। অথচ খাদ্য ঘাটতি বা সংকটে পতিত দেশ সমূহ শুধুমাত্র নিজেদের খাদ্য যোগাতেই ব্যর্থ হয়ে নিজেদের মধ্যেই মারামারি কাটাকাটি করে মরছে! তাই আমরা যতোই মানব কল্যাণের হুঙ্কার ছাড়ি না কেনো অনাহারী মানুষের মুখে যদি প্রয়োজনীয় আহার তুলে দিতে পারি সে এক মহা লজ্জা! তাই ক্ষুধামুক্ত একক বিশ্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না হলে লক্ষ বছরের মানব সভ্যতা কি নিজেদের আধুনিক হিসেবে আদৌ দাবী করতে পারে?
ক্ষুধা সমস্যার সমাধান ছাড়া গোটা বিশ্ব ব্যবস্থা আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়! ইদানিংকালের বিশ্ব নেতাদের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক লম্ফঝম্ফ আমার কাছে অন্তরসারশূণ্য ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। আমরা পুরোটাই ব্যর্থ পৃথিবী নামক গ্রহে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাটির সমাধানে, যেনো এই ব্যর্থতা ঢাকতে বিশ্ব রাজনীতির ভাড়েরা চূড়ান্ত ভাঁড়ামি করে মানুষের দৃষ্টিকে ভিন্নদিকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করে চলেছে। আমাদের একমাত্র স্লোগান হওয়া উচিত ক্ষুধামুক্ত একক বিশ্ব, এখানে ধনী দেশগুলোর আরো ধনী হবার খুনী মানসিকতা থেকে বের হতেই হবে। বিশ্ব সাম্যতা হয়তো প্রতিষ্ঠা করা সম্ভবপর নয় কিন্তু আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলেই ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব বলে আমি বিশ্বাস করি। যারা বিশ্ব রাজনীতির বড় বড় খেলোয়াড় তারা আফ্রিকা সহ বিভিন্ন অঞ্চলের দূর্ভিক্ষ পীড়িত, ক্ষুধায় জর্জরিত হাড় জিরজিরে মানুষগুলোর ছবি দেখেও কিভাবে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যান? সময় কি হয়নি এক্ষুনি ঝাপিয়ে পড়ে পৃথিবীর এক নম্বর বা প্রথম সমস্যাটির টেকসই সমাধান করার?
অন্যান্য সম্পদের ক্ষেত্রে সমবন্টন করার প্রয়োজন নেই কিন্তু খাদ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সবাইকে এক ছাতার নীচে আসতে হবে। কাউকে ক্ষুধার্ত রেখে আধুনিকতা ও উন্নয়নের স্লোগান, গণতন্ত্র ও মানবতার জয়গান মূল্যহীন এক আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। ক্ষুধাযুক্ত এই ভারসাম্যহীন বিশ্ব আমি মানি না, যেখানে যে দেশেই খাদ্যের যোগান বেশি অবশ্যই সেখান থেকে জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য সংস্থার মাধ্যমে যে দেশে খাদ্য ঘাটতি সে দেশে যোগান দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রযুক্তির মহা উন্নয়নে ছোট হয়ে গেছে বিশ্ব, আমরা এখন জানি বিশ্ব জনমিতি ও খাদ্য উৎপাদন পরিসংখ্যান। তাই একজন মানুষকেও ক্ষুধার্ত রাখবো না এই গ্রহে এটাই হোক নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার স্লোগান। এটা সম্ভব, খুবই সম্ভব, প্রয়োজন শুধুই সদিচ্ছা, একজন সার্বজনীন বিশ্বনেতা আর পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য সীমাহীন ভালোবাসা।
পল্লব খন্দকার, ২৩ জুন ২০২৩।
Leave a Reply