কলমে- মানস বিশ্বাস
“জুলি, জুলি রে–, এই জুলেখা তোর আব্বুকে ডাক।”
“আব্বু মসজিদ থেকে এখনো ফেরে নি আম্মু, এই তো দেখে এলাম হুজুর ভাইজানের সঙ্গে কথা বলছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে।”
“ঠিক আছে। তোর ভাই কোথায় দ্যাখ।”
“ও লাট্টু নিয়ে খেলছে আম্মু, আমি বললাম পড়বি আয়, আমাকে পাটকাঠি দিয়ে মারলো, এই দ্যাখো!”
“তোর তো ভাইয়ের নামে শুধু নালিশ! যা, মুরগিগুলোকে খেতে দে।”
“আমার তো পড়া হয়নি, না মুখস্ত করে গেলে স্যার বকবে যে ইস্কুলে!”
“খালি মুখের উপর কথা? একটা কাজ বললাম করতে পারবি না? দাঁড়া, তোর আব্বুকে দিয়ে মার খাওয়াবো, বুঝবি তখন!”
“বা: রে! আমি কি করবো না বলেছি? তুমি শুধু শুধু আব্বুর ভয় দেখাও। আব্বু তো শুধুই তোমার কথা শোনে তো না!”
জুলেখার কথার ধরনে রেগে যায় নূরনাহার। এটা ঠিক, টানাটানির সংসারে সবকিছু অগোছালো থাকলেও নূরনাহারকে বড় ভালোবাসে জুলেখার বাপ জাহিদ। এমনিতে শান্ত স্বভাবের নূরনাহার স্বামীর প্রতিটি কথা সাধ্যমতো শোনে। কখনো তার কথার অবাধ্য হয় না। বাপের বাড়িতে থাকতেই পরিবার থেকে এই শিক্ষা পেয়ে এসেছে সে। বিভিন্ন মাহফিলে ‘স্বামীর প্রতি স্ত্রী-এর কর্তব্যের’ মাসআলায় তাবড় তাবড় হুজুরের বক্তব্যে নূরনাহার উদ্বেলিত হয়ে ওঠে; আল্লাহের কাছে দোয়া ভিক্ষা করে, এ সংকল্প থেকে সে যেন কখনো না সরে। বাপের প্রতি মায়ের এ একান্ত অনুরাগ জুলেখার চোখ এড়ায় না। আব্বু ওকে যথেষ্ট ভালোবাসে, স্নেহ করে, তবুও ওর একটাই কষ্ট সবকিছুতেই মায়ের কথাকে বিশ্বাস করে। নূরনাহার সেটা বুঝতে পেরে রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এসে মেয়ের গালে ঠাস করে এক চড় মেরে বলে, “বেয়াদব!”
ছোট ছোট সামান্য কারণে মার খাওয়ার অভ্যাস আছে জুলেখার। এজন্য কাঁদলো না সে। বিষণ্ণ মুখে মুরগির খাবার দিয়ে ভাইকে খুঁজতে গেল ও, নইলে আবার বকুনি খেতে হবে। শেষ পর্যন্ত পড়ার কথা ভুলেই গেল জুলেখা।
ক্লাসরুমের চেয়ারে বসে অমল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হাতের লেখার খাতার দিকে। বছরখানেক হল, এ স্কুলে বদলি হয়ে এসেছে সে। ওর নাতিদীর্ঘ শিক্ষক জীবনে এই অভিজ্ঞতা হয়েছে যে হাতের লেখা সুন্দর ও দ্রুত না হলে ছেলেমেয়েদের বুদ্ধি ও ধারণ ক্ষমতা যাই থাকুক, পড়াশোনা বেশিদূর হয় না। যে শ্রেণিগুলো ওর ভাগে পড়েছে, সকলের জন্যই বিষয়ালোচনার আগে হাতের লেখা বাধ্যতামূলক করেছে অমল। মাস দেড়েকের ব্যবধানে তফাৎ টা চোখে পড়ছে চোখে পড়ার মতন করে।
স্কুলড্রেসের উপর নিকাব পরে কাঁচুমাচু মুখে সামনে দাঁড়িয়ে আছে জুলেখা। অমল সস্নেহে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “চমৎকার হয়েছে, বেশ সুন্দর!” খাতাটির বিগত পৃষ্ঠাগুলো উল্টিয়ে অমল বলে উঠলো, “দ্যাখ জুলেখা, মাত্র এক মাস আগেও কেমন লিখতিস তুই, তোকে কিন্তু আরও ভালো করতে হবে!”
প্রশংসা পেয়ে জুলেখা উচ্ছাসে অমলের প্রায় কানের কাছে এসে গলা খাটো করে বলল, “জানো স্যার, প্রতিদিন মাগরিবের নমাজের পর আমি তো মক্তবে যাই। হুজুর ভাইজান বলছিল, জুলি তুই আরবি সুন্দর লিখতিস। এখন কুফরি ভাষাটাও ভালোই লিখছিস যে! আমরা তো সবাই বাঙালি, বাংলায় কথা বলি, তাহলে সেটা কুফুরি কী করে হয় তুমিই বলো?”
অমল বুঝতে পারে না, মাত্র ক্লাস ফাইভে পড়া সরল নিস্পাপ এ মেয়েকে কীভাবে বোঝাবে সে! বিষণ্ণ মুখে খাতাটা জুলেখার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “তুই আমার বড় মিস্টি মেয়ে!”
জুলেখা খাতাটা ছোঁ মেরে নিয়ে বেঞ্চির দিকে যেতে যেতে আড়চোখে মুচকি হেসে বলল, “তাইই তো!”
টিফিন পিরিয়ডে অন্য সহকর্মীদের মতো চলমান রাজনীতির আলোচনা পছন্দ করে না অমল। অফিসে অন্যদের সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটালেও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশতেই পছন্দ করে সে। ওর স্কুলের সামনে প্রকান্ড মাঠ, মাঠের দক্ষিণ দিকে বেশ বড় এক অশ্বত্থগাছ। ছেলেমেয়েরা সেখানে খেলা করে। অমল মুগ্ধ হয়ে দেখে; ওর ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যায়। কত বিচিত্র রকমের খেলায় যে জানে এরা! কিছু কিছু খেলা অমলের কাছে নতুন মনে হয়। ও কৌতূহলী হয়ে ছেলেমেয়েদের খেলার নাম জিজ্ঞেস করে। ছেলেমেয়েরা উৎসাহিত হয়ে অমলকে খেলায় নিতে চায়। অমল বিস্মিত হলেও আনন্দ পায়, কপট উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, “দূর পাগল! আমি কি তোদের মতো ছোটাছুটি করতে পারি না আমাকে এ বয়সে খেলা করা মানায়!”
অমলদের স্কুলে হিন্দু মুসলমান ছাত্রসংখ্যা আধা-আধি। সবাই একসঙ্গে ক্লাসে বসা কিংবা মাঠে একসঙ্গে খেলা করলেও দু-পক্ষের মধ্যে সূক্ষ্ম একটা সামাজিক দূরত্ব অনুভব করে অমল। কিন্তু তার ধরণটা বুঝতে কিছুটা সময় লেগেছে ওর। ধর্ম নির্বিশেষে যেখানে সংখ্যাগুরু ছেলেমেয়ে হইহই করে খেলা করে, সেখানে মুষ্টিমেয় কিছু ছেলেমেয়ে সকলের সঙ্গে খেলে না। ধর্মভীরু কয়েকটি ছাত্রী খেলা না করে দূরে গাছতলায় বসে গল্প করে, নয়তো ফাঁকা ক্লাসে বসে থাকে। অন্যদিকে যে খেলাগুলোতে মেয়েদের অংশগ্রহণ আছে, সেখানে আবার কিছু ছাত্র কিছুতেই অংশগ্রহণ করে না। এই মনস্তাত্ত্বিক বাধা এতটুকু ছেলেমেয়েদের মধ্যে থেকে কীভাবে দূর করা যায়, সেটাই ওর কাছে এক মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ। অমল বিশ্বাস করে, স্কুলে পড়াশুনোর থেকেও জরুরি চরিত্র গঠন, বিজ্ঞানমনস্ক মন তৈরি করা। ছেলেমেয়েরা প্রতিটি বিষয়ে প্রশ্ন করুক, মানব সভ্যতার নির্মোহ ইতিহাস জানুক, এটাই ঐকান্তিকভাবে চায় অমল।
এক মধ্যাহ্নকালীন বিরতিতে অমল একদিন দেখে ফাঁকা ঘরে চুপটি করে বসে আছে জুলেখা।
“কী রে, শরীর খারাপ?” চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করল সে।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বিষণ্ণ মুখে জুলেখা বলে- “আব্বু ছেলেদের সঙ্গে খেলতে বারণ করেছে”।
দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখে অমল বলল “একটা গল্প শুনবি?”
খুশিতে প্রায় লাফ মেরে জুলেখা বলে উঠলো, “কীসের গল্প স্যার, ভূতের!”
“তুই কি ভূতের গল্প শুনতে পছন্দ করিস?”
“খুউউব! জানো, আমার আব্বুও অনেক গল্প জানে, রাতে শোনায় তো! ভূতের গল্পও বলে, তবে কম। জ্বীনের গল্প বলে, ফেরেশতার গল্প বলে, আরো কত কী! তুমি তো আবার হিন্দু, জ্বীন কাকে বলে জানো না! জানো, জ্বীন, ফেরেশতা এগুলো সত্যি আছে, আমাদের সব সময় নজর রাখে।”
“আমি হিন্দু নই সোনা, আমি মানুষ।” শান্ত স্বরে বলে অমল। “আজ থেকে তোকে আমি অনেক গল্প শোনাবো, তবে তোকে কথা দিতে হবে ভবিষ্যতে আর কখনো ভূত, জ্বীন এসবে বিশ্বাস করবি না। এসব মানুষের কল্পনা, বাস্তবে এর অস্তিত্ব নেই।”
“কিন্তু কিতাবে এসব লেখা আছে তো! আমাদের হুজুর ভাইজান তো প্রায় বলে। আমি কার কথা বিশ্বাস করবো বলো?”
অমল দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। সত্যিই তো! কীভাবে বিশ্বাস করাবে ওকে? ক্ষণকাল ভেবে হাসিমুখে জুলেখার মাথায় হাত বুলিয়ে অমল স্নেহসিক্ত স্বরে বলে উঠলো, “আচ্ছা বল তো, তুই কাকে বেশি ভালোবাসিস, আমাকে না হুজুর ভাইজানকে!”
“বাব্বা, হুজুর ভাইজান! সামান্য উচ্চারণ ভুল হলে যা মারে না! তুমি হলে তো মরেই যাবে।”
ওর কথায় দু:খে মন ভরে উঠলেও এই শীর্ণ একরত্তি মেয়েটির কথায় হেসে ফেলল অমল। নিজের বাইসেপস দেখিয়ে অমল বলে, “এটা দেখছিস, তোর এই শরীরে যদি বেঁচে থাকিস, তোর কি মনে হয় আমি মরে যাব! ঠিক আছে, একদিন তোর হুজুর ভাইজানের সঙ্গে দেখা করে আমি বলে দেব, যেন তোকে আর এত না মারে।”
জুলেখা এর আগে মক্তবে মার খাওয়া নিয়ে অনেকবার জাহিদের কাছে অনুযোগ জানিয়েছে। জাহিদের এক কথা, আল্লার শুকরিয়া আদায় করতে গেলে অমন একটু আধটু মার খাওয়া ভালো। নূরনাহারও স্বামীর কথায় সায় দেয়। জুলেখা এটা ওর ভবিতব্য ধরে নিয়েছে। অমলের কথায় তাই পরম আশ্বস্ত হবার ভঙ্গিতে জুলেখা খুশিতে বলে, “এটা যদি তুমি করতে পারো না স্যার, আমি তাহলে তোমার সব কথা মন দিয়ে শুনবো।”
অমল উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আজ গল্প থাক, চল তোর মক্তবে যাই।”
প্রথমে কিছুক্ষণ অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে জুলেখা। স্যারের কথাটা এখনো ঠিক হজম করে উঠতে পারে নি সে। কিন্তু অমলের দৃপ্ত দাঁড়ানো দেখে একটা বিরাট যন্ত্রণা সমাধানের আশায় একেবারে লাফিয়ে অমলের হাত শক্ত করে চেপে ধরলো জুলেখা।
একে টিফিন পিরিয়ড প্রায় শেষ, তার উপর মক্তবে যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা, মনের মধ্যে এই দ্বিধা থাকলেও ওর হাতটা যেভাবে শক্ত করে আঁকড়ে আছে একবুক আশা নিয়ে এই শীর্ণ মেয়েটা, সে দিকে তাকিয়ে চোখের কোন ভিজে উঠল অমলের। হেডমাস্টারের কাছে অনুমতি নিয়ে বাইক স্টার্ট করে অমল শান্ত হয়ে বলল, “ওঠ তুই।”
মক্তবে পৌঁছে অমল এই প্রথম দেখল জুলেখার হুজুর ভাইজানকে। বয়স বেশি না, ত্রিশের কম মনে হল। মুখভর্তি দাড়ি থাকাতে বয়সটা বেশি মনে হয়। অমল ভণিতা না করে পরিচয় ও কুশল বিনিময়ের পর খুব তরল স্বরে অনুরোধ জানিয়ে বলল, “জুলি বড় ভালো মেয়ে। আপনি তো পড়ান একে। আপনি জানেন, ও খুব মনোযোগী ছাত্রী। আমার ধারণা, আপনি এর মতো সকলকে না মারলে এরা আরও আগ্রহী হয়ে ধর্মশিক্ষা করতে পারবে। মনের মধ্যে ভয় নিয়ে কেউ তো শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে না, তাই না? আপনি প্লিজ একটু দেখবেন।”
ভদ্রলোক মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেও ওনার মুখের অভিব্যক্তিতে আশ্বস্ত হতে পারলো না অমল। ফিরে আসার সময় জুলেখা আনন্দে অমলকে বলল, “স্যার, বাতাবি লেবু খাবেন? আমাদের বাড়িতে অনেক বাতাবি লেবু হয়েছে, যা মিস্টি না! চলো না স্যার?” ওর চাপাচাপিতে বাধ্য হয়ে যেতে হল অমলের। যদিও আর একটা উদ্দেশ্য ছিল, জুলির বাপের সঙ্গে একটু কথা বলে আসা। বলা যায় না জুলেখা বাড়ি ফিরে এলে আবার কী ঘটে!
পাঁচ ইঞ্চি ইঁটের ভিতের উপর দরমার বেড়া দেয়া ঘর, তৎসংলগ্ন রান্নাঘর। সেই রান্নাঘরের পাশেই বাতাবি লেবু গাছ। উঠোনে বেশ কিছু মুরগি ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে জাহিদ এই অসময়ে দুজনকে দেখে একটু অবাক হল। অমল দেখল, জুলেখার বাপের মুখেও অতি পাতলা দাড়ি। নিজের পরিচয় দিয়ে অমল বলল, “আপনার মেয়ে কিন্তু খুব বুদ্ধিমতী, পড়াশোনায় খুব মনোযোগীও। মেয়ে যতদূর পড়তে চায়, আপনি কিন্তু চেষ্টা করবেন ততদূর পড়াতে। এমন মেয়ে সকলের হয় না। ও হ্যাঁ, আপনাদের মক্তবেও গিয়েছিলাম। শুনলাম, হুজুর বাচ্চাদের বড় মারেন, তাই ওনাকে অনুরোধ করে এলাম যাতে না মারেন বাচ্চাদেরকে। মারলে তো বাচ্চা ভয় পেয়ে যাবে তাই না? তাহলে শেখার আগ্রহটাও চলে যাবে, আপনি কী বলেন?”
চিন্তান্বিত মুখে জাহিদ স্বগতোক্তি করে, “দেখেন, যেটা ভালো মনে হয়।”
এই বিরাট সমস্যা সমাধানে জুলেখা ভিতরে ভিতরে আনন্দে অস্থির হলেও শান্ত হয়ে অমলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। এ বিষয়টা দৃষ্টি এড়ায় না অমলের। বিস্মিত হয়, এত পরিণত হতে কীভাবে শিখলো এই একরত্তি মেয়ে!
“ও আব্বু, স্যার প্রথম এলো আমাদের বাড়িতে, স্যারকে বাতাবি লেবু পেড়ে দাও!” বলেই ঘরে ব্যাগ আনতে ছুটলো জুলেখা।
ফেরার পথে অমল স্নিগ্ধ স্বরে বলল, “কী রে, তুই খুশি তো? এবার আমার কথা শুনে চলবি তো?”
“তোমার সব, সব, সব কথা শুনে চলবো আমি, দেখো।”
দিন চলে যায়, সময় এগোতে থাকে। প্রতিদিন টিফিনের সময় গল্প শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে অনেক ছেলেমেয়ের সঙ্গে জুলেখাও। অমলও প্রাণপাত করে সহজ ভাষায় ছোটদের মতো করে এই জীব জগতের রহস্য বোঝাতে। কোনটা ঠিক, কেন ঠিক, কোনটা ভুল, কেন ভুল, মজার ছলে গল্পের মেজাজে সেসব বলে যায় অমল। লক্ষ্য ওর আজ স্থির, যেভাবে হোক অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কার দূর করবেই সে এইসব শিশু মন থেকে। এখনি না করলে আর হবে না, কোনোদিনই না।
প্রতিদিন রোল কল করার সময় ছাত্রছাত্রীদের দিকে তাকায় অমল। ‘রোল নম্বর দশ, জুলেখা খাতুন?’ বলে তাকাতেই বিস্মিত হয়ে উঠল অমল। জুলেখাকে আজ কেমন অচেনা অচেনা লাগছে! গোটা মাথা, কপাল ঢাকা, থুতনির নীচে ক্লিপ দেয়া এক মেয়েকে দেখে এসেছে অমল এতদিন, আজ সে সব উধাও! ওর যে এত চমৎকার চুল, এই প্রথম দেখল সে। মুখে কিছু না বললেও ভিতরে ভিতরে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল অমল। ও পেরেছে! এটা শুধু এক টুকরো কাপড় না, এটা একটা বিশ্বাস, একটা বেড়াজাল, যা থেকে বেরনো এভারেস্ট ডিঙানোর মতো।
টিফিন পিরিয়ডে জুলেখা বলল, “তুমি খুব চমকে গেছো,তাই না স্যার!”
“তুই বুঝলি কী করে?”
“তুমি যেভাবে তাকিয়ে ছিলে!”
“তুই এভাবে আজ বাড়ি থেকে বেরোলি কী করে?”
জুলেখা এ কথার জবাব না দিয়ে বেঞ্চ থেকে এক ঝটকায় ব্যাগটা টেনে চেন খুলে কাপড়টা অমলের দিকে দোলাতে দোলাতে বলল, “শোনো, আমি তো হিজাব পরেই বেরোই, যদি কেউ দেখে ফেলে? স্কুল থেকে বেরনোর সময় আবার পরে ফেলব, হয়ে গেল সমাধান! সবাই খুশি, আমিও খুশি!”
অমল এই প্রথম শ্রদ্ধার চোখে তাকাল জুলেখার দিকে। ওর অবশ্য সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই, ‘স্যার আসছি’, বলেই লাফাতে লাফাতে ছুটল মাঠের দিকে খেলা করতে। ওর এই যাত্রাপথে নির্নিমেষ চোখে চেয়েই রইল অমল।
ফেব্রুয়ারী মাস। স্কুলে সরস্বতী পুজোর আয়োজন চলছে। অমল ছেলেমেয়েদের বুঝিয়েছে, ঠাকুর পুজো, মন্ত্র এসব কোনো বিষয় না, বাগদেবীকে কেন্দ্র করে উৎসব, হইচইটাই আসল।যাদের অঞ্জলি দিতে ইচ্ছে হবে না, দিবি না। জুলেখার অবশ্য যত আগ্রহ ও উত্তেজনা কীভাবে স্কুল সাজাবে সেই নিয়ে। কে কে আলপনা দেবে, কারা কাগজের মালা তৈরি করে ঝোলাবে, কে কে পুজোর উপচার সংগ্রহ করবে, বয়স অনুযায়ী ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছে অমল। পুজোর আগের দিন খড়িমাটি নিয়ে আলপনা দিতে মেতে গেল অনেকের সঙ্গে জুলেখা।
অমল ওকে ডেকে বলল, “শোন জুলি, তুই আলপনা দেয়ার চেয়ে মালা গাঁথ। আলপনা দিতে গেলে ফ্রকে লাগিয়ে ফেলবি, বাড়ি ফিরে সমস্যায় পড়বি।”
জুলেখা মুখ ভেংচিয়ে বলল, “তুমিই আমাকে বলেছিলে, মন যেটা চাইবে সেটা করবি। আমার এখন আলপনা দিতে ইচ্ছে করছে, আমি এটাই করবো।”
মনে মনে অমল স্বগতোক্তি করে, “আহারে, কর, কর। আজ তোর যা মন চায় তাই কর।”
বাড়ি ফেরার সময় জুলেখা আবার এলো লাফাতে লাফাতে অমলের কাছে। “ও স্যার, শোনো, কাল কিন্তু আমি শাড়ি পরে আসবো। বৃষ্টি, দিয়া, পিউ সবাই আসবে শাড়ি পরে। আমি আম্মুর একটা লালপেড়ে শাড়ি পরে আসবো, কেমন?”
অমল জানে, ঐ কচি মেয়েটির এ সাধ পূরণ হবার নয়। জুলেখার পরিবার ও সমাজের গোঁড়ামি ওর অজানা নয়। কষ্ট বুকে চেপেই কিছুটা রহস্য করে বলল, “কাল না হলেও অন্যদিন পরিস। ঈদের দিনও পরতে পারিস, আমি খুব খুশি হব।”
সরস্বতী পুজো গেল, পরের সপ্তাহও গেল, কিন্তু জুলেখা স্কুলে এলো না। অমল মনে মনে বিচলিত হয়, কিন্তু ছেলেমেয়েদের সামনে সেটা প্রকাশ করে না। তার পরের সপ্তাহের মঙ্গলবার জুলেখা এল, মাথায় হিজাব। করুণ ফ্যাকাশে মুখে বসে আছে বেঞ্চে। অমল জানে, টিফিনে ওর কাছে ভেঙে পড়বে জুলেখা। রোল কল করে নি:শব্দে হোমওয়ার্কের খাতা চেক করতে শুরু করল অমল। জুলেখার খাতা নিয়ে চেক করার সময় অমলের পাশে এসে দাঁড়ালো সে। টিক মেরে খাতা ওর দিকে এগিয়ে দিতেই জুলেখা খাতা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ছুটে এসে অমলের গলা জড়িয়ে ডুকরে উঠলো, “বাবা, ও বাবা! বলো না তুমি আমার বাবা! একবার বলো তুমি আমার বাবা! দ্যাখো, মেরে আমার হাতে কালশিটে ফেলে দিয়েছে। তাও আমি কিছু বলিনি। কিন্তু ওরা যে আমাকে মাদ্রাসায় নিয়ে যাচ্ছে! ওদের একটু বলো না বাবা, আমি যে পড়তে চাই, অনেক কিছু শিখতে চাই, জানতে চাই….”, কান্নার উচ্ছ্বাসে কথা শেষ করতে পারলো না জুলেখা।
ঝাপসা চোখে জুলেখার ছুঁড়ে ফেলা খাতাটার উপর খসখস করে নিজের ফোন নম্বরটা দিয়ে জুলেখার কপালে চুমু খেয়ে অমল অব্যক্ত স্বরে বলে উঠলো, “আমি পারলাম না রে তোকে ধরে রাখতে। কিন্তু তুই ভালো থাকিস, ফোন করিস, আমার কথাগুলো আজীবন মনে রাখিস, তাহলেই হবে।”
টিফিন পিরিয়ডে টিসি নিয়ে দিকশূন্য চোখে জাহিদের হাত ধরে যখন চলে যাচ্ছে জুলেখা, মাঠের দক্ষিণ দিকের পাতাহীন খাঁখাঁ অশ্বত্থ গাছের নীচে দাঁড়িয়ে অপলক তাকিয়ে রইল অমল।
কৃতজ্ঞতা: অতিথি লেখক হিসেবে গল্পটি পশ্চিমবঙ্গ থেকে পাঠিয়েছেন।
সংকলন: দৈনিক আলোকবর্তিকা।
Leave a Reply