ভাবনা- মানস বিশ্বাস
সেদিন ইস্কুলে পিলারের খুঁটে ডাস্টার ঝাড়ছি, হঠাৎ কে যেন মৌচাক সিনেমার রঞ্জিত মল্লিকের স্টাইলে বলে উঠলো ‘খসসর’! চমকে উঠে বললাম, ‘কে র্যা’? আগে হলে বলতাম, ‘আপনি কে বলছেন’! এখন জমানা পাল্টেছে। আধুনিকতার জয়গান চারদিকে। সেই কবে ডারউইন বলেছেন, সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট। যা করবি, গমকী স্টাইলে করবি, যাতে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে মাথা উঁচু করে থাকতে পারিস। এক লক্ষ্মণে রেহাই নেই সুগ্রীব দোসর! কোন এক পাগলা মুখ ফসকে বলে ফেললো, “হ্যোয়াট বেঙ্গল থিংস টুডে, ইন্ডিয়া থিংস টুমরো”। নাও, এখন ঠ্যালা সামলাও, নদীর ধারে আজীবন ধিড়িঙ্গে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকো! শাস্ত্রে আছে গুরুর কথা ফেলতে নেই, আমরাও তার কথা প্রমান করতে গমকী স্টাইল ছাড়িয়ে ঝালা অবধি পৌঁছে গেলাম। বাঙালী তো! তর সয়না। সংসদে স্পীকারকে কাগজের বান্ডিল ছুঁড়ে, নিজের পাড়ায় স্পীকার ভেঙে, সরণিকে ধরণী বানালাম। পাগলা খাবি কি, ঝাঁঝেই মরে যাবি!
আমার উত্তরে ডাস্টারমশাই সাদা হাসির ধুলো উড়িয়ে বলল, ” আমি গো আমি, আপনার ডানহাত”! শব্দ নাকি অর্থ হয়ে মানুষের মাথায় গাট্টা মারে। ডানহাতে তাকিয়ে দেখি ডাস্টারমশায়ের ফিচেল হাসি। মাথায় রক্ত উঠে গেল। ব্যাটা চামচা, আমি খচ্চর? তুই কি?
বাজান আমি এঁচোড়! যতই ঝাড়ুন আর ঘষুন, পাছার ছাল উঠে গেলেও আমি পাকবো না, চিরকুমার!
তা না হয় হলো, তুই আমাকে গালি দিলি কেন বল?
উত্তেজিত হলে ব্যাটা বাঙাল ভাষায় কথা বলে। উত্তর দিল “আপনারে উদ্দেশ্য কইরা কইলেও আপনারে ঠিক বলি নাই । কিন্তু ঠিক কইসি কিনা আপনেই কন”?
কালিদাসের হেঁয়ালি! এই এক বাঙালীর লেটেস্ট কায়দা! গালাগাল দেওয়াও হলো, আবার অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়াও গেল! সব বুঝেও না বোঝার ভান করি। কার কাপড় নিয়ে টানাটানি করছে কে জানে! ভয় পেলাম। মাস্টাররা ভীতু হয়েই জন্মায়। সবসময় হারানোর ভয়ে থাকে। বুদ্ধিমান মাস্টার আকাট ছাত্রের ভয় পায়, বুদ্ধিহীন মাস্টার বুদ্ধিমান ছাত্রের ভয় পায়, নিষ্ঠাবান মাস্টার সময়কে ভয় পায়, ফাঁকিবাজ মাস্টার পাবলিককে ভয় পায়, শান্ত মাস্টার বৌকে ভয় পায়, রাগী মাস্টার ম্যানেজিং কমিটিকে ভয় পায়, উদাসীন মাস্টার সংসারকে ভয় পায়, লোভী মাস্টার সমাজকে ভয় পায়, চরিত্রবান মাস্টার রাজনীতিকে ভয় পায়, চরিত্রহীন মাস্টার নিজেকে ভয় পায়। মাঝে মাঝে অপরাধ না করেও অপরাধবোধ কাজ করে। সুতরাং সাধু সাবধান! ব্যাটা কোন সত্যি কথা বলে তার ঠিক নেই! তাই তরল স্বরে বললাম, “আচ্ছা কী হয়েছে বল না ?”
“সাতসকালে কাঁসর-ঘন্টা পিটিয়েই তো থলে হাতে ছুটলেন বাজারে। সয়াবিনের উপর শাকের আঁটি চাপিয়ে টু-পাইস মেরে সুড়ুৎ করে পকেটে। আমাকে না ঝাড়তে পেরে সুযোগ বুঝে নিজের দু-হাত ঝেড়ে প্রথমেই বিবেকানন্দ। আহা! কী আদর্শবান, ফিরেই বিড়িতে টান! দেশের কী হাল, তাই নিয়ে কোলাহল! ক্লাসে যাতে না যেতে হয় তার কত ফিকির!”
আমতা আমতা করে বললাম, কিন্তু আমি তো…..
কথা শেষ হলো না। পিছন দিক থেকে নাকী সুরে খিক-খিক করে হাসছে ব্যাটাচ্ছেলে চক!
“জানি জানি হেডমাস্টার দিয়েছে সকল ভার
সকাল বেলায় সবজি আর বিকেলে রেজিস্টার
মিড-ডে-মিলের টাকা মেরে মেটাও যত হুল
শিক্ষা সেলে টাকা দিয়ে কব্জা করো স্কুল
যেমন ছাত্র তেমন গার্জেন আছো তোমরা ভালো
শিক্ষা দীক্ষার বালাই নেই সবই সাদা কালো”
এই রে! এ যে আবার কবতে করে! মহা মুশকিল! পরিত্রাণের উপায় খুঁজছি। ডাস্টারমশাই নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, “আপনাগো দোষ দিয়া লাভ নাই। একটা সময় আছিল, যখন কিছুই ছিল না, শিক্ষেটাই ছিল। এখন কত্ত কী! ইসে, কী যেন কয়, পিকক মডেল, স্টুডেন্ট ডায়েরি, ফর্মেটিভ, সামেটিভ, ইভ্যালুয়েশন বাপ রে বাপ! তিন হাত কাঁকুড়ের তের হাত বিচি। হ্যাঁগো মাস্টার, আপনেরা যারা মাস্টারি না কইরা চাকরি করেন, তারা ভাবেন কখন এইসব নিয়া? তার উপরে পন্ডিতেরা আবার বার করসে নির্মিতিবাদ।” একটু দম নিয়ে সাদা ধোঁয়ার রিং ছেড়ে চোখ টিপে বললে “এর মানে তো সবই বাদ তাই না ম্যাস্টর?”
এবারে রেগে গেলাম। মাস্টাররা রেগে গেলে ছাত্র পেটাতে পারে না, জোরে জোরে ডাস্টার পেটায়। মোক্ষলাভের শর্টকার্ট রাস্তা। ডাস্টারমশাই ক্ষেপে গিয়ে বললে, “খামোখা আমারে পিটাচ্ছেন, সব যায়গায় একই নিয়ম। যে ছাত্ররা আগে ক্লাসে আসে, অনুপস্থিত ছাত্রদের বকুনি তাদের উপর দিয়েই যায়। আপনারে ভালো মানুষ পাইয়া বললাম, আপনি ও একই! চেতনার কাঁথায় আগুন দিইসি, এবারে দেখি কী করেন?”
আচ্ছা, এই মতলব! আমাকে পার্ট করতে হবে বিবেকের রোল! উঁহু, ঐটি হচ্ছে না বাছাধন! বাড় খেয়ে ক্ষুদিরাম হওয়া অত সহজ নয়। ধুঁকে ধুঁকে পিঁপড়ের মতো মরব, সেও ভি আচ্ছা, বিপ্লব করার মুরদ নেই, খর্চা আছে! আমরা ৩৪ বছর একটা মন্ত্রই শিখেছি। বিপ্লব মানে ইনকিলাব। কোত্থেকে বাঙালি এই শব্দটাকে বড় আপন করে নিয়েছে। ডান হাত মুঠো করে মুগুর ভাজার মতো করে ঘুরিয়ে নাও, হয়ে গেল বিপ্লব। মোল্লার দৌঁড় মসজিদ পর্যন্ত। আমিও মুগুর ভেজে নিলাম।
এদিকে আমার কান্ড দেখে চক বাবাজী হেসে কুটিপাটি হয়ে টেবিল থেকে গড়িয়ে দু-টুকরো হয়ে গেল, তবুও তার হাসি থামে না! ভাঙা দুই টুকরো কোরাসের মতো গেয়ে উঠলো —
দেখো দেখো মাস্টারের আজব যত কান্ড
বিপ্লবের ধরণ দেখে হাসবে বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড
ইনকিলাব মরে গেছে, এখন বন্দে মাতরম
চাটুজ্যে বেঁচে থাকলে করতেন আমরণ অনশন
বালিতে মুখ গুঁজে রাখে, খোঁজ রাখে না দেশের
সব মাস্টারের ঘোড়া রোগ, ভালো করবে কী দশের?
নাঃ! এত অপমান সহ্য হয় না। গন্ডারের চামড়া বলে কী গন্ডারের বিবেক নেই! কাল থেকেই কোমর বেঁধে লাগবো। রাতে শুয়ে ভাবলাম, কোমর যে বাঁধবো তার কাপড় কই! মরুক গে, তেমন তেমন হলে প্যান্ট খুলেই বেঁধে ফেলবো। ইংরেজের পোশাক নিপাত যাক।
পরদিন সক্কাল সক্কাল ঘড়ির কাঁটার নিয়ম মেনে স্কুলে পৌঁছলাম। হেড মাস্টারমশাইকে বললাম, স্যার, স্কুল ছুটির পর একটা মিটিং ডাকার ব্যবস্থা করুন। কিছু বিষয় আলোচনা করতে চাই। ভদ্রলোক সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন। অস্বাভাবিক কোনো কিছু করতে গেলেই সবার ভুরু কুঁচকে যায়। চলতি কা নাম গাড়ি। যেমন চলছে চলতে দাও। নয়তো চোলাই খেয়ে দু-লাখ টাকা নাও। কিন্তু জল ঘোলা কোরো না। মাওবাদী হয়ে যাবে। তখন জেলে বসে ম্যাও ম্যাও করতে হবে। যা হোক, তিনি রাজী হলেন।
মিটিং এর শুরুতেই সবাই একযোগে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। বললাম বিদ্যালয়কে কীভাবে আরও পঠন পাঠনের উপযোগী করা যায় এটা নিয়ে আলোচনা চাই। এক সহকর্মী বললেন, “কী ঘাটতি দেখলেন?” গড়গড় করে ফিরিস্তি দিয়ে ফেললাম–তিন মাস অন্তর শিক্ষক-অভিভাবক মিটিং চাই, মিড-ডে-মিলে সাধ্যমতো বৈচিত্র চাই, ফর্মেটিভ অ্যাসেসমেন্ট এর টুল চাই, জ্ঞানমূলক, বোধমূলক, দক্ষতামূলক বিকাশে কার্যকরী পদক্ষেপ চাই, শারীরিক শিক্ষার বিকাশ চাই….
“দাঁড়ান মশাই দাঁড়ান! আপনি মাসকাবারি বাজারের ফর্দ বের করে ফেললেন নাকি?” কথা শেষ না হতেই এক সহকর্মী ফুট কেটে বললেন, “আমারও ডিএ চাই, পে-কমিশন চাই, বাড়ীর কাছে পোষ্টিং চাই, শিক্ষকের সম্মান চাই…”। প্রধান শিক্ষক বললেন, ” আপনারা কী আলোচনা বলতে তরজা বোঝেন? এটা কী এবিপি আনন্দ পেয়েছেন, না বিধানসভা?” বর্ষীয়ান পল্টুবাবু বিড়ির শেষ টানটা দিয়ে খক খক করে কেশে মিটিং রুমে ঢুলু ঢুলু চোখে ঢুকলেন। বিপ্লবের নামে অনেক কিছু পাল্টে দেন। শিক্ষা সেলের দোর্দন্ড প্রতাপ নেতা, দেখে বোঝা যায় না। যদিও তা বোঝার কথা না, অদৃশ্য শক্তি অন্য জায়গায় থাকে, সময় মতো দেখা দেয়। অনেকটা ছবিতে দেখা ঠাকুরের পিছনের জ্যোতির মতো। প্রধান শিক্ষক ভদ্রলোককে বেশ সমীহ করে চলেন, বিনীতভাবে বর্ণিত বিষয় ব্যাখ্যা করলেন। শেষমেশ বিস্তর আলোচনার পর ভদ্রলোক আমাকে আদেশ করলেন ভাবনাগুলো লিখিত আকারে দিতে। উৎসাহ দিয়ে বললেন, “এই তো চাই! আপনাকে আমরা আমাদের থিঙ্ক ট্যাঙ্কে ব্যবহার করতে পারি। আমি আমাদের সংগঠনে আপনার লেখা ভাবনা-চিন্তাগুলো শেয়ার করবো। আপনি কাল থেকেই লেগে পড়ুন। ”
“আমি লেগে পড়বো মানে?” অস্ফুটে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল কথাটা। ভদ্রলোক কাশি মিশ্রিত হাসি দিয়ে বললেন, “শোনেন, যখন পাশে কেউ ছিল না, তখন আমাদের নেত্রী একাই বাংলা কাঁপিয়েছেন। বিপ্লব একা একা করতে হয়। স্বপ্ন সবাই দেখে না, একজনই দেখে; বাকীরা অনুসরণ করে। আপনি এগোন, আমরা আপনার পিছনে আছি। ”
শেষের কথাগুলো মুখস্ত মুখস্ত শোনাচ্ছিল। তা হোক গে, শুনে গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। এমনি এমনি নেতা হওয়া যায় না।
পরদিন থেকে বিদ্যালয়ের পরিবেশ একটু যেন অন্যরকম। সবাই দেখি আমার থেকে একটু দূরে দূরে। যেন আমার ছোঁয়াচে রোগ হয়েছে। ভাবলাম, ভূমিকম্পের পর আফটার শক চলছে। কয়েক দিনের মধ্যে থিতু হয়ে যাবে।
দিন কয়েকের মধ্যেই অন্য স্কুলে থিতু হয়ে গেলাম। ড্রাফট ট্রান্সফারের চিঠি। আমাদের শিক্ষক নেতা বললেন, “ঐ স্কুলে আপনার মতো লোকই দরকার”।
চলে যাবার শেষ দিনে ডাস্টারমশাইকে হাতে তুলে নিলাম। দেখি প্রাণহীন। টেবিলে রাখতে ধুলো ঝরে পড়লো। বুঝলাম আমার লেখাটা ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে লিখিনি যে ডাস্টার দিয়ে মুছে ফেলবো!
কৃতজ্ঞতা: অতিথি লেখক হিসেবে গল্পটি পশ্চিমবঙ্গ থেকে পাঠিয়েছেন।
সংকলন: দৈনিক আলোকবর্তিকা।
Leave a Reply