সেই মৃতপ্রায় বহ্নির ভিতর জগতে হঠাত করেই উলটপালট ঘটে গেলো দুই বছর আগে। মরা গাছে ফুল ফোটার মতোই ওর ভিতর গভীর প্রেমের বীজ কিভাবে কখন বপিত হয়েছিলো তা ঠিক হিসাব করে বের করতে পারে না এখন। নিজের অসহায় অবস্থা দেখে নিজেই অবাক হয়ে যায়! একি হচ্ছে ওর গন্ডিবদ্ধ মনের ভিতর? চব্বিশ ঘণ্টা কেনো একজনের কথাই মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে? কেনো তার জন্য তৃষ্ণায় বুকের ভিতর উথাল পাতাল করে। ফেসবুকে তার ছবি দেখলেই কেন হা করে তাকিয়ে থাকে, কেন ইচ্ছে করে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখতে, কেনইবা কিছুতেই ছাড়তে মন চায় না? বহ্নি কল্পনায় তাঁকে সারাক্ষণ জড়িয়ে রাখে, হাতে হাত ধরে ঘুরে বেড়ায়, ইচ্ছে হলেই আদর করে, অনেক অনেক আদর।
কিন্তু তার মুখোমুখি হলেই বহ্নি কেমন বোকা হয়ে যায়। একভাবে মুখের দিকে তাকিয়ে তার কথা হা করে শুনতে থাকে, কিছু বোধগম্য হয় কিছু ওর মাথার উপর দিয়ে যায়। মানুষটির মধ্যে কি যে এক যাদু আছে, খুব সাধারণ কিন্তু অনন্য অসাধারণ মনে হয় তাঁর প্রতিটি আচরণ, হাসি, কথা, মার্জিত আচরণ সব মিলিয়ে সার্বিক ব্যাক্তিত্ব! এ যেন বহ্নির স্বপ্নের সেই অদেখা রাজপূত্র, যাকে সে কোনদিন কল্পনা করেনি কিন্তু হঠাত করেই যাদুর কাঠি নিয়ে ঘুমন্ত বহ্নিকে জাগিয়ে তুলতে সাত সমূদ্র তেরো নদী পার হয়ে পংখীরাজে চড়ে উড়ে এসেছেন!
নামের ভিতরই একটা যাদু আছে প্রিয়মের, বহ্নির কাছে সেরকমটাই মনে হয়! যদিও প্রিয়ম সেসব হেসেই উড়িয়ে দেয়। নিষ্পাপ এক হাসিমাখা মুখ ও হৃদয় নিয়ে সর্বদা একটা মানুষ কিভাবে চলতে পারে প্রিয়মকে না দেখলে জানতেই পারতো না বহ্নি। একজন মানুষের জীবনে সর্বোচ্চ বিপদের সময়েও ঠান্ডা মাথায় সব মেনে নেয়া এবং সেগুলো সামলানোর আশ্চর্য এক ক্ষমতার অধিকারী প্রিয়ম!
বহ্নির জীবনে প্রিয়মের আগমন বেশ অপ্রত্যাশিত, অন্তত ওর জীবনবোধের পরিপন্থী। সংসার জীবনে পাওয়া হাজার দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, অপমান, অপদস্থ সহ্য করেও বহ্নি স্বামীর সংসার ছাড়ার কথা একটি সেকেন্ডের জন্যও কোনদিন ভাবনায় আনেনি। তাই বিয়ের পর হাজারো প্রেম প্রার্থী পুরুষকে অনায়াসে উপেক্ষা করে গেছে নির্বিচারে। প্রেম নিবেদনের কারনে এমন এমন কাউকে এতোটা বেশি অপমান করেছে যে বহ্নির নিজেরই পরে অনুশচনা হয়েছে! এভাবে না বল্লেও বোধহয় পারতো, আসলে এই ব্যাপারটা বহ্নি নিতেই পারে না সেই কিশোরী বয়স থেকেই। গায়ে পড়া পুরুষদের ও দুই চক্ষে দেখতে পারে না। এখানেই প্রিয়ম অন্য পুরুষদের চেয়ে আলাদা, এইজন্যই এই চল্লিশে এসে আঁটকে গেছে এক অমীমাংসিত প্রেমের ফাঁদে!
প্রিয়মের স্ত্রী হাঁসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে, বাসায় প্রিয়মের ছেলেকে গৃহকর্মীর জিম্মায় রেখে রাতের পর রাত কাঁটছে রোগীর এটেন্ডেন্ট হিসেবে। স্ত্রী রিয়া কোমায় আছে শমরিতা হাসপাতেলের আইসিইউতে সাত দিন ধরে, শরীরের সবকিছু ঠিক আছে কিন্তু জ্ঞান ফিরছে না। ডাক্তারও সেভাবে কিছু আশার কথা বলেন না, নিয়মিত চেকআপ সেরে জানান আশা করি আজকের মধ্যে জ্ঞান ফিরবে, চিন্তার কিছু নেই মিঃ প্রিয়ম। কিন্তু গত সাতদিনেও জ্ঞান ফেরার এতোটুকু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অফিসে খুব ঘনিষ্ট কলিগ বিশাখাকে শুধু জানিয়ে দেয় প্রিয়ম শমরিতা হাঁসপাতালে স্ত্রীকে নিয়ে আছে। বিশাখার বাসা পাশেই, বিশাখার মা প্রিয়মের জন্য ফ্লাটের গার্ডকে দিয়ে দুপুরের ও রাতের খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছেন এই কয়টাদিন। রিয়ার বড় বোন ছাড়া ওদের পরিবারের ও প্রিয়মের পরিবারের সদস্যরা পর্যন্ত এই চরম দূর্ঘটনার খবর জানে না।
মোবাইল ফোন, ফেসবুক সবই বন্ধ করে রেখেছে প্রিয়ম। শুধু খুব জরুরী মনে করলে অফিসে বিশাখা আর বাসায় গৃহকর্মীর সাথে কথা বলছে। আসলে কি কারনে রিয়ার শারীরিক অবস্থার এমন চরম অবনতি ঘটলো তা খুবই রহস্যময়! শনিবার বিকালে শপিং করে বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিতে শুয়ে পড়লো অন্যান্য দিনের মতোই। প্রিয়ম ওর ছয় বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে ড্রইং রুমে ফুটবল খেলছিলো, ছুড়ে দেয়া বল দুজনে ধরাধরি করছে। প্রিয়মের ছেলের ছুড়ে দেয়া বল বেড রুমের মধ্যে ঢুকে গেলে কুড়িয়ে আনতে গিয়ে দেখলো রিয়ার গায়ে জড়ানো কাঁথাটা এলোমেলো!
এটা কিছুটা অস্বাভাবিক, কারন রিয়া খুব গোছানো মেয়ে, ঘুমানোর সময়ও টিপটপ হয়ে ঘুমায়। প্রিয়ম কিছুটা অবাক হয়ে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে বেঘোরে আলুথালু হয়ে যেন এক জীবনের ঘুমে ঢলে পড়ে আছে রিয়া! সন্ধ্যায় বাসায় ঢুকেই এমন পাগলাটে ঘুমের কোন কারন নেই। প্রিয়ম জানে রিয়ার ভয়াবহ মাইগ্রেনের সমস্যা আছে, ঘুমের মধ্যেও ব্যাথায় ভোগে। তাই প্রথমে কপালে হাত দিয়ে প্রিয়ম রিয়াকে ডাক দিলো, না কোন সাড়া নেই! এবার কাঁথা সরিয়ে একটু জোরে নাড়া দিলো রিয়ার মাথায় হাত দিয়ে। হঠাৎ রিয়া অস্বাভাবিকভাবে হাত পা ছুড়ে গোঙ্গানির মত শব্দ করতে লাগলো!
চলমান————–
লেখা: কিশলয় প্রান্ত
সংকলন: দৈনিক আলোকবর্তিকা।
প্রথম পর্বের লিংক:
Leave a Reply