বোধহয় প্রেম
বহ্নির বিয়ের পার হয়ে গেছে পঁচিশ বছর, বাচ্চারা কলেজ ও ভার্সিটিতে লেখাপড়া করছে। স্বামী মোটামুটি বড় ব্যবসায়ী, সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন, অধিকাংশ দিনেই সকালে বাসা থেকে বের হয়ে যান আর গভীর রাতে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে ফিরে এসে ঘুমান। বহ্নির স্বামী বাসর রাত থেকেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে তিনি তাঁর পুরোনো প্রেম কোনদিন ভুলতে পারবেন না, তাই কোনদিন বৌ যেন তাঁর ভালোবাসা পাবার চেষ্টা না করে। সেই ব্যাপারটা বোঝাতেই বাসর রাতেই বিছানা থেকে নামিয়ে নিচে ঘুমাতে বাধ্য করেছিলো বহ্নিকে! সেদিন লজ্জায় অপমানে এতোটাই নির্বাক হয়ে পড়েছিলো যে সে কথা আজ অবধি কারো কাছে প্রকাশ করতে পারেনি।
তারমানে বহ্নি এই জীবনে কারো প্রকৃত ভালোবাসা পায়নি, সারাজীবন একার কষ্ট একাই সহ্য করতে করতে কেটে গেছে পঁচিশটি বছর! অসম্ভব মানসিক ও দেহের কষ্ট মেনে নিয়ে পুরো জীবনটাই কাটিয়ে দিলো সে। অথচ এখন মাত্র চল্লিশোর্ধ বয়সে এসে সংসারের শেষ অধ্যায়ে পৌঁছে গেছে, নিজের সাধ আহ্লাদ বলতে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। স্বামী ষাট বছর বয়সে পৌঁছানোতে এখন যৌন জীবনও খুব অনিয়মিত হয়ে গেছে।
খুবই হতাশায় ভুগতে ভুগতে শারিরীকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়েছে বহ্নি, এই দুই বছর আগেও নিজের চেহারার গর্বে অহংকারী হয়ে উঠতো সে। কিন্তু এখন নিজের চেহারা দেখলেই তার নিজেরই মেজাজ খারাপ হয়। মনে পড়ে তার ক্ষুরাধার চেহারার কারনে স্কুল কলেজে কিভাবে ঝাঁকে ঝাঁকে যুবক ছেলেরা পিছু লাগতো! তখন তার বাবার কড়া শাসন আর নিজের রূপের গর্বে কাউকেই পাত্তা দিতো না মেয়েটা। বাবার ইচ্ছেতে হঠাৎ করেই একদিন বিয়ে হয়ে গেলো মাত্র উনিশ বছর বয়সেই, সংসারের দায়িত্ব পালন করতে করতে কিভাবে বাচ্চা হলো, বাচ্চাদের লালন পালন স্কুলে নেয়া, বাসা বাড়ি গুছিয়ে রাখা, রান্না বান্না সব দ্রুত গতিতে চলতে লাগলো। স্বামীর ইচ্ছেতেই যৌনতায় অংশ নেয়া, দেহের সুখ মিটেছে কি মেটেনি সেটা চিন্তার সুযোগ পায়নি কোনদিন, সেটা যে কি সেসবও বোঝার চেষ্টা করেনি।
বহ্নির স্বামী প্রচন্ড রকম আধিপত্যবাদী চরিত্রের, বৌকে দাসী হিসেবে ব্যবহার করার মানসিকতা থেকেই কথার অত্যাচার থেকে শুরু করে মানসিকভাবে আঘাত দিতে নোংরা সব কথা বলেন, মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বাসায় ফিরে বাপ মা তুলে গালিগালাজ করেন। ছেলেরা বড় হয়ে যাবার পরও তার স্বামীর চরিত্রের কোন পরিবর্তন হয়নি। বহ্নিও নরম স্বভাবের হওয়াতে কোন প্রতিবাদ ছাড়াই দাসী বাদীর মত পতি সেবা করে গেছে।
আজ সন্তানেরা বড় হয়ে গেছে, হাতে কিছুটা অবসর তাই সময় কাটাতে ফেসবুকে সেলফি তুলে আপলোড দেয় বহ্নি। কিশোরী বয়সের মতো একা একা বৃষ্টি ভিজে ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করে। ফেসবুকে অবশ্য মাত্র বেছে বেছে ২০-২৫ জন বন্ধু ওর, বেশিরভাগ স্কুল কলেজের মেয়ে বন্ধু আর পরিবারের কিছু সদস্য। তাই স্বামীর সাথে বিদেশে বেড়াতে গিয়ে সী বিচে শর্ট কাপড় পরে ছবি তুলে ফেসবুকে শেয়ার করে। স্বামী কি ভাবলো সেসব নিয়ে আর এখন অত দুঃশ্চিন্তা করে না। মনে মনে ভাবে স্বামীর সংসার ঠিকঠাক মতো এতোদিন গড়ে দিলাম, আর কত করবো? এখন আমি কিছুটা হলেও আমার মতো চলবো, তবে পরিবারের সম্মান নষ্ট করার মতো কিছু করবো না।
বহ্নি মাঝে মাঝে ভেবে অবাক হয় কিভাবে অবহেলা, ভালোবাসাহীনতায় তথাকথিত সংসার জীবন কেটে গেলো দুই যুগেরও বেশি! এখন সেসব নিয়ে ওর ভিতর বাড়তি কোন অনুভূতি কাজ করে না, অবহেলা আর মানসিক নির্যাতনগুলোই স্বাভাবিক মনে হয়, নিয়তি হিসেবে মেনে নেয়ার পাশাপাশি সেগুলো অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বরং এখন স্বামী কোন কারনে মিষ্টি করে কথা বললে বা নরম আচরণ করলে সেগুলোই অস্বাভাবিক মনে হয়, অস্বস্তি লাগে!
সেই কুড়ি বছর বয়সের কাঁচা স্বপ্নগুলো যখন প্রতিদিন খুনের শিকার হয়েছে, আজ আর কোন প্রতিকূলতাকেই অস্বাভাবিক মনে হয় না বহ্নির। অথচ বিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী ছাত্রী ছিলো সে, অল্প বয়সে বাবা বিয়ে না দিয়ে দিলে লেখাপড়াটা শেষ করতে পারতো অনায়াসে! শিক্ষিতা নারী হয়ে একজন শিক্ষিত ও মার্জিত রুচির পুরুষ মানুষের সংসার করার খুব লোভ ছিলো ওর। যদিও আজকাল অনেক নারীই চাকুরি করে স্বাবলম্বী হতে চায়, বহ্নির কোনদিন চাকুরি করার কোন ইচ্ছেই ছিলো না। অবশ্য এখন মাঝে মাঝে আফসোস হয়, বিয়ের পর জোর জবরদস্তি করে স্নাতক ডিগ্রীটা অর্জন করে নিতে পেরেছিলো, সেই লেখাপড়ার যোগ্যতা দিয়ে অন্তত একটা স্কুলে শিক্ষকতা করতে নিশ্চই পারতো ও।
চলমান--------------
লেখা: কিশলয় প্রান্ত
সংকলন: দৈনিক আলোকবর্তিকা।