এরপর এ্যাম্বুলেন্স করে বাসার কাছের প্রাইভেট হাঁসপাতালে নিয়ে গেলে জানালো ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সীতে নিয়ে যেতে। তখন ডিউটি ডাক্তারের কথায় প্রিয়মের মাথায় ঢুকলো আত্মহত্যার মোটিভ এটা! পৃথিবীটা শুদ্ধ নড়ে উঠেছিলো তখন, প্রিয়মের স্ত্রীকে ডাক্তার ফিরিয়ে দিচ্ছে আত্মহত্যার মোটিভ বলে? সারারাত ঢাকা মেডিকেলের বারান্দায় মশার কামড় খেয়ে, পুলিশের জেরার মুখে পড়ে রিয়ার নিথর দেহটার পাশে নির্বাক হয়ে বসে আছে প্রিয়ম। গলা দিয়ে নল ঢুকিয়ে পেট ওয়াশ করে কিছু তরল বের করা হয়েছে অজ্ঞান রিয়ার শরীর থেকে। ঢাকা মেডিকেলে ইচ্ছে করলেই বেড পাওয়া যায় না তাই আপাতত ইমার্জেন্সী ওয়ার্ডের বারান্দায় জায়গা হয়েছে, রিয়ার বড় বোন ড্রাইভারকে দিয়ে গোপনে কাঁথা বালিশ পাঠিয়ে দিয়েছেন। এমন একটা বিষয় যে ডাক্তার বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করে কেবিন জোগাড় করার চেষ্টাও করা সম্ভব হচ্ছে না।
ঢাকা মেডিকেলে দ্বিতীয় দিনেও রিয়ার শারীরিক অবস্থার কোন পরিবর্তন না দেখে যখন চরম উৎকণ্ঠা আর অনিশ্চয়তায় প্রিয়মের মতো শক্ত মনের মানুষটাও যখন বিভ্রান্ত তখনই বহ্নি ওর অসুস্থ শ্বশুরকে নিয়ে ইমার্জেন্সীতে ভর্তি করালো। যথারীতি বেড খালি নেই, প্রিয়মের স্ত্রীর পাশেই চাদর পেতে অসুস্থ শ্বশুরকে শুইয়ে রেখে হঠাৎ করেই চোখ পড়লো ঘুমহীন উসকোখুসকো চুলের এক ভদ্রলোক ঘুমন্ত রুগীনীর পানে একভাবে তাকিয়ে যেন ধ্যানে মগ্ন। ব্যস্ত হাঁসপাতালের কোথায় কি ঘটছে সেদিকে লোকটির কোন খেয়াল আছে বলে মনে হলো না। বহ্নির সিক্সথ সেন্স বরাবরই প্রবল, এই মূহুর্তে শ্বশুরবাড়ির নানান আত্মীয়স্বজন সাথে থাকায় অসুস্থ শ্বশুরের জন্য বেড বা কেবিন পাবার চেষ্টায় সিস্টারের সাথে কথা বলতে উঠে গেলো।
বহ্নি তাঁর স্বামীর কাছে অনাদরের হলেও শ্বশুরের কাছে একদম মেয়ের আদর পায়, তাই অসুস্থ হবার প্রথম দিন থেকেই পাশে পাশে থেকে সেবা শ্বশ্রূষা করে যাচ্ছে। অবশ্য বহ্নি ওর শ্বশুরের পরিবারের সবার কাছে হাসপাতাল এটেন্ডেন্ট হিসেবে প্রথম পছন্দের। ওর বরের দূর সম্পর্কের আত্মীয় পরিজনেরাও অসুস্থ হলে বহ্নিকে আগে খবর দেয় এবং হাঁসপাতালে যেতে অনুরোধ করে। বহ্নির বর এই বিষয়টি নিয়ে ভয়াবহ আপত্তি করলেও বহ্নি সে কথা শোনে না, সকলের অসুখ বিসুখ বিপদে আপদে হাসিমুখে পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বরের কাছে অপ্রিয় হলেও বহ্নি ওর শ্বশুরের পরিবারের কাছে নাম্বার ওয়ান বা মোস্ট ওয়ান্টেড বৌমা!
হাঁসপাতালে নিয়মিত দৌড়াদৌড়ি করার কারনে বহ্নির মোটামুটি মুখস্ত হয়ে গেছে কিভাবে কাকে ধরলে বেড বা কেবিন দ্রুত পাওয়া যায়। এছাড়া বহ্নির সুন্দর হাসি, মার্জিত আচরণ আর লাস্যময়ী চেহারায় গলে গিয়েও হাঁসপাতালের অনেকে সহযোগিতা করতে আগ বাড়িয়ে এগিয়ে আসে। ব্যাপারটা বহ্নি উপভোগ করে আবার জটিলতাও তৈরি হয়, ওরচেয়ে কম বয়সী ইন্টার্নী ডাক্তারও প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বসে! নিতান্তই রোগীর সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে এসব উৎপাত মেনে নিতে হয়। হাসপাতাল ছাড়ার পর পুচকে ডাক্তারের নাম্বার বা ফেসবুক ব্লক মেরে দেয় নির্মমভাবে!
কয়েক ঘন্টার মধ্যে বেডের ব্যবস্থা নিশ্চিত করে শ্বশুরের কাছে ফিরে এসে বহ্নি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সেই ভদ্রলোকের দিকে, একইভাবে লোকটি বসে আছে রোগীর মাথার কাছে। এখানে আসা অধিকাংশ রোগীর আত্মীয়স্বজনের ভীড় দেখা গেলেও বহ্নির মনে হলো এই লোকটির সাথে আর কেউ নেই। ওর খুব মায়া হলো, যা ওর স্বভাবে নেই দুম করে সেই কাজটি করে বসলো যেন কারো এক অদ্ভুত ইশারায়! নিজ থেকেই আগ বাড়িয়ে লোকটির পাশে দাঁড়িয়ে বল্ল- এক্সকিউজ মি, রোগী আপনার কি হন? লোকটির ধ্যান ভেঙ্গে গেলো বোধহয়, কিছুটা অবাক হয়ে প্রথমে বহ্নির মুখের দিকে তাকিয়ে বল্ল- জী আমার স্ত্রী। বহ্নি মানুষটির কণ্ঠস্বর শুনে একটু চমকে উঠলো, কেমন চেনা চেনা কণ্ঠ! বল্ল- আপনার সাথে আর কেউ নেই? কদিন এসেছেন এখানে? বেড পাননি?
লোকটা কিছুটা ভরসা পেলো মনে হয় বহ্নির আন্তরিক প্রশ্ন শুনে। দুগালে টোল দুলিয়ে হেসে বল্ল- না, আমি একাই আছি ওর সাথে। বহ্নি বল্ল- কিছু যদি মনে না করেন, ওনার কি হয়েছে? খুব স্বাভাবিকভাবেই লোকটি বল্ল- সুইসাইড কেস বলে ডাক্তার ধারণা করছেন। অবাক করা ব্যাপার, মানুষটা কি বিশ্বাস করে না তাঁর স্ত্রী সুইসাইড করতে পারে? ব্যাপারটা খুবই ইন্টারেস্টিং মনে হলো বহ্নির, তাই পাল্টা প্রশ্ন করলো- আপনার কি মনে হয়? মানুষটা খুব আস্থার সাথে বল্ল- ডাক্তারের মতামতের সাথে আমি একমত কিন্তু ওর আত্মহননের এটেম্পটের বিষয়টার সাথে পুরোপুরিই দ্বিমত!
চলমান————–
লেখা: কিশলয় প্রান্ত
সংকলন: দৈনিক আলোকবর্তিকা।
পর্ব-২ এর লিংক:
Leave a Reply