বহ্নি সরকারী হাঁসপাতালের চিকিৎসা নেয়ার ব্যাপারে অভিজ্ঞ, বুঝতে পারছে এই লোকটা খুব অসহায় হয়ে পড়েছে স্ত্রীর সঠিক চিকিৎসা নিয়ে। আর কোন প্রশ্ন না করে পাশের কাউন্টারে গিয়ে রোগীর কেস হিস্ট্রি যোগাড় করে সিস্টার ও ডিউটি ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে বহ্নি। একটা এ্যাম্বুলেন্স ঠিক করে শমরিতা হাঁসপাতালে বহ্নির ডাক্তার কাজিনের সহযোগিতায় আধাঘন্টার মধ্যে ঢাকা মেডিকেল থেকে পাচার করে দেয় প্রিয়ম ও তাঁর রোগীকে। পুলিশ কেস হওয়াতে হাঁসপাতাল থেকে রিলিজ না নিয়েই এসব আয়োজন গোপনে করতে হয়। সিস্টারদের কাছে বহ্নি জানতে পারে যে সাংবাদিকরাও সকাল থেকে অনেকবার এসেছিলো খবর সংগ্রহ করতে।
শ্বশুর চলে গেলেন। ভীষণ অভিমান হলো বহ্নির। রেগে গেলে ও যাচ্ছে না তাই গালিগালাজ করতে পারে। শ্বশুরের সাথে বহ্নির সম্পর্ক ছিলো অনেকটা বন্ধুত্বের, ওর নিজের বাবার সাথেও সম্পর্ক বন্ধুত্বের। তাই শত প্রতিকূলতার মাঝেও এমন বন্ধু হারিয়ে পুরোপুরিই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লো কিন্তু অন্যদের মতো হাউমাউ করে কাঁদতে পারছে না, অঝোরে চোখে অশ্রু ঝরছে, স্থির হয়ে বসে আছে এ্যাম্বুলেন্সের সিটে শ্বশুরের সদ্য প্রাণহীন শরীরটা ছুঁয়ে। আর মৃত শ্বশুরকে উদ্দেশ্য করে মনে মনে গালিগালাজ চালাতে থাকলো নিজের উপর, ও যে চিরদিন ভালোবাসার বড্ড কাঙ্গাল। বাসর রাত থেকেই জানে স্বামীর ভালোবাসা পাওয়া যাবে না, তাই সে আশা ছেড়ে দিয়ে শ্বশুর বাড়ির মানুষদের ভালোবাসা দিয়ে মন জয় করার প্রতিজ্ঞা করেছিলো বহ্নি।
এক মাস কেটে গেছে, বাড়িটা জুড়ে বিশাল শূন্যতা। বহ্নি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো ওর স্বামী একদমই নিতে পারছে না বাবার এই চলে যাওয়া। পুরোপুরিই চুপচাপ হয়ে গেছে, নিয়মিত খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। বহ্নি ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে গেলেও বরাবরের মতো নিজের দুঃখ প্রকাশ করছে না, নিজের কষ্ট খোলস বন্দী করে সবাইকে স্বাভাবিক হবার জন্য বিভিন্ন ভালো ভালো রান্না করছে, হাসি ঠাট্টা তামাশা করছে বাড়ির বাচ্চাদের সাথে। যদিও ভিতরটা জ্বলে যাচ্ছে চৈত্রের দাবদাহে ফেটে যাওয়া জমিনের বুকের মতো, কিন্তু সে তো কাউকে বোঝানো সম্ভব না। হাজারো ব্যক্তিগত একান্ত কষ্টগুলো বুকে চেপে রেখে অন্যদের মুখের হাসি দেখানোর অভ্যাস তো বহ্নির হয়েই গেছে গত পঁচিশ বছর ধরে।
কতো শত সহস্র লক্ষ কোটি কষ্ট! সেই মেয়েবেলা থেকে? জ্ঞান হবার পর জেনেছে বহ্নি ও নাকি বাবা মায়ের আনওয়ান্টেড চাইল্ড! বড় বোনের জন্মের ১৪ বছর পর বাবা মায়ের অসতর্ক মিলনের ফসল, ছেলের আশা করে মা ওর জন্মের পর মেয়ে হয়েছে বলে কোলে নেননি! ছোটবেলায় ছেলেদের কাপড় পরিয়ে রাখা হতো বহ্নিকে, মা ওকে একদমই পছন্দ করতেন না, এখনো করেন না। ছোটবেলা থেকেই মায়ের কাছ থেকে পাওয়া অনাদরের এই গভীর কষ্টের ক্ষত নিয়ে বেড়ে উঠতে উঠতে বহ্নির বাবার সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। বাবার সাথে সব ধরনের কথা, ইয়ার্কি ঠাট্টা, ঝগড়া বিবাদ সবকিছুই চলেছে সমানতালে। তাই বিয়ের আগ পর্যন্ত ওর জীবনে পুরুষ বলতে বাবাকেই আদর্শ হিসেবে ভেবেছে। বহ্নির চোখে পৃথিবীর তাবৎ পুরুষ মানেই ওর বাবার মতো চরিত্রের হবে এমন এক বায়বীয় বিশ্বাস নিয়ে স্বামীর সংসারে প্রবেশ করেছিলো।
এখন আর ওসব নিয়ে ভাবে না। বিয়ের পর প্রথম কয়েক বছর বহ্নির স্বামী যখন ওর সাথে ব্যাপক খারাপ ব্যবহার করেছে, কিছুতেই সহ্য করতে না পেরে বাবার বাড়িতে এসেছে কিছুটা মন হালকা করতে, বহ্নি কাউকে কোন অভিযোগ করেনি। সেটা আর কেউ না বুঝতে পারলেও বাবা ঠিকই ধরে ফেলতেন মেয়ে জামাইয়ের সাথে সুখে নেই, খুটিয়ে খুটিয়ে বের করে ফেলতেন মেয়ের মনের আসল কথা। একবার এতোবেশি ঝামেলা তৈরি হলো যে ওর স্বামী দুই তিন মাসও কোন খোঁজ খবর নিলো না। তখন বহ্নির বাবা বলেছিলেন তুমি যদি এই সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসতে চাও আমি আপত্তি করবো না! কিন্তু বহ্নি প্রতিজ্ঞা করেছিলো আর যাই হোক সংসার ছেড়ে কোনদিন যাবে না।
চলমান————–
লেখা: কিশলয় প্রান্ত
সংকলন: দৈনিক আলোকবর্তিকা।
পর্ব-৩ এর লিংক: https://dainikalokbortika.com/%e0%a6%9b%e0%a7%8b%e0%a6%9f-%e0%a6%97%e0%a6%b2%e0%a7%8d%e0%a6%aa-%e0%a6%ac%e0%a7%9c-%e0%a6%97%e0%a6%b2%e0%a7%8d%e0%a6%aa%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%ae%e0%a7%87%e0%a6%b2%e0%a6%be-%e0%a6%ac-2/