যুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত জেনেও যে বীর পিছু না হটে সম্মুখে এগিয়ে যায় তাঁকে আমরা সংশপ্তক বলি। আমরা শুধুমাত্র ১৯ বছর বয়সী টগবগে যুবক সুলেমান দাউদের বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারি না, এই দুঃসাহসিক অভিযানে বের হবার ব্যপারে নিশ্চিত তাঁর পিতা শাহাজাদা দাউদেরই উৎসাহ বেশি ছিলো। এছাড়া বাকী সকলেই প্রাপ্ত বয়স্ক, ধনকুবের, বহু দুঃসাহসিক অভিযানের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ এবং জীবনের বড় একটি অংশ অসংখ্য সাফল্য সহযোগে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করেছেন। আমরা নিশ্চিত হতে পারি আটলান্টিক মহাসাগরের ৪ কিলোমিটার পানির নীচে ১৯১২ সালে ডুবে যাওয়া টাইটানিক জাহাজের ধবংশাবশেষ দেখতে যাবার অভিযানে মৃত্যুর সম্ভাবনা যে আছে বাকী ৪ জন অভিযাত্রী সে সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত ছিলেন! এখানেই অভিযাত্রী বা সাহসী মানুষদের বীরত্ব প্রকাশ পায়, পৃথিবীতে অসংখ্য ধনকুবের আছেন, সবাই কিন্তু সামর্থ্য থাকা স্বত্বেও এমন দুঃসাহসিক অভিযানে যেতে চাইবেন না। যারা হিমালয় বিজয়ে যান, পাহাড়ে উঠতে গিয়েই সেখানে অনেক অভিযাত্রীর মৃত্যু ঘটে, তাঁর মৃতদেহটাও কোনদিন খুঁজে পান না স্বজনেরা। তাই বলে কি হিমালয় জয়ের আকাঙ্ক্ষা আর কোনদিন কোন অভিযাত্রী করেন না? সত্যিই তাঁরা বীর, মৃত্য ভয় আছে জেনেও যারা এমন সব অসাধ্য সাধনে বের হন তারাই সংশপ্তক।
টাইটান ডুবোযানের মোট ৫ জন যাত্রীদের একজন ছিলেন ৬১ বছর বয়সী স্টকটন রাশ, যিনি ওশানগেট কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। টাইটান ওশানগেট কোম্পানীর নির্মিত ও পরিচালিত ডুবোযান, এর আগেও টাইটানিক অভিযান সফলতার সাথে সম্পন্ন করেছিলো ডুবোযানটি। ছিলেন পিতা ও পূত্র দুইজন, ব্রিটিশ পাকিস্তানি ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ৪৮ বছর বয়সী শাহজাদা দাউদ, তার ১৯ বছরের ছেলে সুলেমান দাউদ। আর একজন ছিলেন ব্রিটিশ ধনকুবের ব্যবসায়ী ৫৮ বছর বয়সী অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী হ্যামিশ হার্ডিং, তিনি অভিযাত্রী হিসেবে আগে থেকেই খুব পরিচিত ছিলেন। তিনি মহাকাশ ভ্রমণের পাশাপাশি কয়েক দফায় দক্ষিণ মেরুও ঘুরে এসেছেন। সর্বশেষ জন ফ্রান্সের নৌবাহিনীর সাবেক সদস্য ৭৭ বছর বয়সী পল অঁরি নাজোলে যিনি ছিলেন টাইটানিক বিশেষজ্ঞ, এর আগেও অনেকবার টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের কাছে গিয়েছিলেন তিনি।
বস্তুগত জীবনে অত্যন্ত সফল এসকল মানুষের পাগলামি বলতে এই দুঃসাহসিক অভিযানের নেশার ব্যাপারটাকেই আমরা ধরতে পারি বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ বিষয় হিসেবে। ইচ্ছে করলে এতো মৃত্যু ঝুঁকি না নিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ প্রাসাদ বানিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বাকী জীবন কাঁটিয়ে দিতে পারতেন আরাম আয়েশে। অথবা এই অভিযান সফল করে ফিরে এসেও থাকতেন আগের মতোই এডভেঞ্চার প্রিয় মানুষ হিসেবে নিজেদের একান্ত গন্ডীর ভিতরে। কিন্তু গত ২২ জুন ২০২৩ তাঁদের সলিল সমাধির সংবাদ মূহুর্তেই এনে দিয়েছে অসম সাহসিকতার এক কিংবদন্তি ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকা চিরকালীন কাহিনীর প্রেক্ষাপট। যেভাবে এখনো মানুষ বিস্ময়ের সাথে ডুবে যাওয়া টাইটানিকের ইতিহাস মনে রেখেছে এখন থেকে এই টাইটান বীরদেরও একইভাবে স্মরণে রাখবে। এই অভিযান ব্যর্থ হয়েছে বলার কোন সুযোগই নেই বরং মানুষের কৌতুহলী মন ও সীমাহীন আগ্রহের জয় হয়েছে। এভাবেই মানুষের আত্মত্যাগের মহিমায় যুগে যুগে সৃষ্টি হয়েছে ইতিহাস, নব নব আবিষ্কারে সমৃদ্ধ হয়েছে পৃথিবী। টাইটান ডুবোযান ট্রজেডি তাই বীরত্ব এবং এক অমর শোকগাঁথা হিসেবে হাজার বছরের ইতিহাসে ঠায় করে নেবে।
দৈনিক আলোকবর্তিকা ডেস্ক।