কয়েক সপ্তাহ আগে সাতক্ষীরা থেকে এক বন্ধু কিছু ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট নিয়ে এসে বলল, দোস্তো, রিপোর্টগুলা এট্টু দ্যাহো তো।
কার রিপোর্ট ? কী অসুবিধা?
তোমার ভাবীর। বিটি মাইনষের কী সব অসুবিধা। ফ্যাটে ব্যতা করে। উলটা সিদা মাসিক অয়। এই সব আর কী। তয়, সেই তো এহোন টাহা ছাপানোর মেশিন। সে মেশিন অচল অইয়ে গেলি আমার চলবে কী এইরে?
পেশায় ইঞ্জিনিয়ার হয়েও খাস খুলনার ভাষায় কথা বলে। বছর খানেক হয় অবসর নিয়েছে। বেজায় রসিক মানুষ। আমিও একটু রসিকতা করার লোভ সামলাতে পারলাম না। বললাম, টাকার জন্য শেষ পর্যন্ত নিজের বউকে এই পথে নামালে?
আমার খোঁচা গায়ে না মেখে হেসে বলল, তা কতি পারো। একজনের ইনকামে কি আর সংসার চলে? এ পতে সে অনেক আগেই নামিছে। ইসকুলে ফড়ায়।
ও। বলে আমি রিপোর্টে চোখ বুলাতে শুরু করলাম। একটা রিপোর্ট দেখে চমকে উঠলাম। জানতে চাইলাম, আবার বিয়ে করেছ নাকি?
আরে নাহ। সে কফাল কী আর আমাইগের আছে? সেই লক্কড় ঝক্কর গাড়িই চলতিছে। তা, এ কতা জিজ্ঞেস কইরলে ক্যান?
প্রেগনেন্সি টেস্ট করিয়েছো দেখছি!
আমি করাবো ক্যান? তোমাইগের কাছে আসলিই তো এক গাদা টেস্ট দরাইয়ে দাও। কী জন্যি কী টেস্ট করাও, কীডা জানে? তোমরা তো গাছেরডাও খাও, তলারডাও কুড়াও।
এবার তার খোঁচাটা আমাকে হজম করতে হলো। বাংলাদেশের ডাক্তারদের নিয়ে এই অপবাদটা বেশ প্রতিষ্ঠিত। প্রয়োজন থাকুক বা না থাকুক, অনেক ডাক্তারই আগে কিছু টেস্ট ধরিয়ে দেয়। কেন দেয়, সে ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। তবে এই অপবাদের জন্য প্রয়োজনীয় টেস্টকেও রুগিরা অনেক সময় সন্দেহের চোখে দেখে।
এফসিপিএস ডাক্তার। একটা সরকারি মেডিকেল কলেজের গাইনির এসোসিয়েট প্রফেসর। ৫০ বছর বয়স্কা এক মহিলার অনিয়মিত মাসিকের জন্য প্রেগনেন্সি টেস্ট করিয়েছেন! আর তখনই ইংল্যান্ডের এ এন্ড ই এর প্রফেসর মিস্টার ম্যাকমিলানের কথা মনে পড়ল। বলেছিলেন, “থিংক, এভরি রিপ্রোডাক্টিভ উইমেন আর প্রেগন্যান্ট, আনটিল প্রুভ আদারওয়াইজ”। মেয়েরা পেটে ব্যথা নিয়ে আসলে সবার আগে আমদের এক্টোপিক প্রেগনেন্সী (জরায়ুর বাইরে ভ্রূণ) এক্সক্লুড করতে হত। সো, প্রেগন্যান্সি টেস্ট ওয়াজ এ মাস্ট। তাই বলে পঞ্চাশ বছরের মহিলার? তবে ডাক্তার সাহেবার চিন্তা ভাবনা সুদূর প্রসারীই বলতে হবে। থিওরেটিক্যালি, যতদিন মেয়েদের মাসিক চলবে, ততদিনই সন্তান ধারণের সম্ভাবনাও থাকবে।
তবে বাকি টেস্টগুলো প্রয়োজনীয়ই বলতে হবে। হালকা ডায়াবেটিস ছাড়া আর কোনো এবনর্মালিটি দেখতে পেলাম না। আল্ট্রাসনোতে ইউটেরাস একটু বাল্কি (একটু ভারি জরায়ু)। এই বয়সে তা হতেই পারে। বললাম, বন্ধু, তোমার এই লক্কড় ঝক্কর গাড়ি এখনই অচল হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। অনেক দিন চলবে। নতুন গাড়ি কেনার চিন্তা ভাবনা থাকলে বাদ দিতে পারো।
কও কী? চোখ কপালে তুলে বলল বন্ধুটি। ডাক্তার দেহি পিষ্টে ভইরে ওষুধ লেহিছে। দু দুডো ইঞ্জেকশনও দেলো। এট্টা পাছায়। আর এট্টা স্যালাইনে গোলায়ে আতের মইদ্যে।
শুনে এবার আমার চোখ কপালে উঠে গেল! ইঞ্জেকশন কেন? কী ইঞ্জেকশন? তাও আবার স্যালাইনের সাথে? বললাম, দেখি প্রেসক্রিপশন।
ওরে আল্লা। তা তো আনতি বুইলে গেছি।
আমাদের দেশের তথাকথিত শিক্ষিত লোকেরাও যে কেন এত আহাম্মক হয়? মেজাজ বিগড়ে গেল। রেগে মেগে বললাম, রুগি আননি। প্রেসক্রিপশন আননি। আমি কি তোমার চেহারা দেখে তোমার বউয়ের চিকিৎসা দেবো?
দোস্তো, রাগ করতিছো ক্যান? তাড়াহুড়োয় ভুইলে গ্যাছি। ভাবলাম, তুমি বিলাতি ডাক্তার। রুগি না দেইহেও রোগ কইয়ে দিতি ফারবা।
বাংলাদেশের সিনেমায় যেখানে ডাক্তাররা রুগির পালস দেখেই বলে দিতে পারে, মিষ্টি খাওয়ান। আপনি দাদা হতে চলেছেন। সেখানে একজন বিলেত ফেরত ডাক্তার রিপোর্ট দেখেই রোগ বলে দেবে, এই প্রত্যাশা একেবারে অমূলক নয়। রাগটা হজম করে তাকে বুঝিয়ে বললাম,
দেখো, কুপির তেল ফুরিয়ে এলে যেমন বাতি কখনও দপদপ করে জ্বলে, আবার কখনও নিভু নিভু হয়ে যায়, তারপর একসময় নিভে যায়। ডিম্বাণু শেষ হয়ে এলে মেয়েদেরও তেমন অনিয়মিত মাসিক হয়। কখন ভারি, কখনও হালকা। তারপর এক সময় বন্ধ হয়ে যায়। তোমার বউয়ের এখন সেই অবস্থা। মেডিকেলের ভাষায় প্রি-মেনোপজাল স্টেজ বলে। যদিও ডাক্তার সাহেবার একটা হরমোন টেস্ট (এফ এস এইচ) করানো উচিত ছিল। তিনি তা না করিয়ে প্রেগনেন্সি টেস্ট করিয়েছেন। যাহোক, খুব বেশি ব্লিডিং না হলে তেমন কোনো চিকিৎসা লাগে না, এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। আর মাসিকের সময় তলপেটে ব্যথা করলে এই ব্যথার ওষুধ খেলেই হবে। বলে একটা এন্টি-ইনফ্লামাটরি ট্যাবলেটের নাম বলে দিলাম।
বন্ধুটির মুখ দেখে মনে হলো না, খুব একটা আশ্বস্ত হয়েছে। এই এক জ্বালা বাংলাদেশে। শুধু কথায় চিড়ে ভেজে না। তাও আবার বিনে পয়সার ডাক্তারের। পেশাগত জীবনের অধিকাংশ সময় ইংল্যান্ডে কাটিয়েছি। সেখানে প্রতিটা ঔষধ কেন দিচ্ছি, রুগিকে বুঝিয়ে দিতে হত। অপ্রয়োজনীয় কোনো ওষুধ লিখলে যেমন ট্যাক্স পেয়ারের পয়সার অপচয় হত, তেমন সেই ওষুধে কোনো রিয়াকশন হয়ে গেলে রেজিস্ট্রেশন নিয়ে টানাটানি পড়ে যেত। তাই বাহুল্য ওষুধ লেখার অভ্যাস নেই।
আমি গাইনি বিশেষজ্ঞ নই। গাইনির একজন প্রফেসর যখন পৃষ্ঠা ভরে ওষুধ লিখেছেন, দুই দুইটা ইঞ্জেকশন দিয়েছেন, নিশ্চয়ই কারণ আছে। অনেকটা কৌতূহল নিবারণের জন্যই বললাম, বাসায় গিয়ে প্রেসক্রিপশনটা হোয়াটসআপ করে দিও।
সে রাতেই হোয়াটসআপ এলো। প্রেসক্রিপশন দেখে আমি হাসব না কাঁদব বুঝতে পারলাম না। গাইনি বিশেষজ্ঞ না হলেও গাইনির বেসিক নলেজ তো আমার আছে। গুনে দেখলাম, মোট এগারো আইটেম।
সবার আগে যে জিনিষটায় চোখ আঁটকে গেল, সে হলো আয়রন ইঞ্জেকশন (Inj. Ferintus 500mg)। স্যালাইনের সাথে দেওয়া হয়েছে। অথচ তার কোনো এনিমিয়া নেই। আয়রন ডেফিসিয়েন্সিরও কোনো লক্ষণ ব্লাড টেস্টে ধরা পড়েনি। তিনি রক্তে আয়রন লেভেলও পরীক্ষা করাননি। বিনা প্রয়োজনে এই ভাবে আইভি আয়রন দেওয়া শুধু অপচিকিৎসাই নয়, রীতিমতো ফৌজদারি অপরাধ।
দ্বিতীয়ত: Inj. Testanon 250mg (Testosterone Hormone) । যে সব পুরুষের জন্মগত ভাবে টেস্টেস্টেরন কম থাকে বা পরে কোনো রোগ বা সার্জারির কারণে কমে যায়, হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি হিসেবে তাদের দেওয়া হয়। আবার যে সব ট্রান্সজেণ্ডার পুরুষ হতে চায়, যৌনাঙ্গের অপারেশনের পরে তাদের নিয়মিত দিতে হয়। অবশ্য মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর রমণীদের যৌন চাহিদা উদ্রেক করার জন্য টেস্টেস্টেরন দেওয়া যেতে পারে। তবে তা অত্যন্ত কম পরিমাণে। ক্রিম কিংবা জেল হিসেবে চামড়ার উপরে লাগানোর জন্য। কোনো মতেই এত উচ্চ ডোজে নয়। এই ডোজে টেস্টেস্টেরন ব্যবহারে মহিলাদের দাড়ি গোঁফ গজিয়ে যেতে পারে!
তৃত্বীয়তঃ Tab Choliva 5mg । জটিল লিভারের রোগ যেমন প্রাইমারি বিলিয়ারি কোলাঞ্জাইটিস (যকৃতের পিত্তনালীর প্রদাহ) কিংবা লিভার সিরোসিসে দেওয়া হয়। ডাক্তার সাহেবান রুগির কোনো লিভার ফাংশন টেস্ট করাননি। এমনকি আল্ট্রাসনোতেও লিভারের কোনো ত্রুটি ধরা পড়েনি। তবুও কেন দিলেন, তিনিই ভালো বলতে পারবেন। আমার তা বোধে আসেনি।
চতুর্থত: Cap. Prostanor 8mg । এই ট্যাবলেট সাধারণত পুরুষদের প্রোস্টেট গ্লান্ড বড় হয়ে গেলে দেওয়া হয়। প্রোস্টেট গ্লান্ড বড় হয়ে গেলে রাতে ঘনঘন প্রস্রাব হয়। এই ওষুধ তা কিছুটা উপশম করে। এই ওষুধে শরীরে টেস্টেস্টেরনের পরিমাণও বেড়ে যায়। তবে যে সব মেয়েদের পেশাবের পর তলপেটে ব্যথা করে অথচ পেশাবে ইনফেকশন নেই (Bladder Pain Syndrome), তাদের বেলায় এটা ব্যবহার করা যেতে পারে।
পঞ্চমত: পেশাবে কোনো ইনফেকশন নেই। রক্তে পরীক্ষায়ও কোনো ইনফেকশন ধরা পড়েনি। রুগির কোনো জ্বর (ইনফেকশনের প্রধান লক্ষণ) নেই, অথচ অতি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন এন্টিবায়োটিক Tab. Arlin 400mg (Linozolid) দিয়েছেন। এমন যথেচ্ছ এন্টিবায়োটিক ব্যাবহার শুধু অন্যায় নয়, রীতিমতো মহা অপরাধ।
বাকি ছয় আইটেমের কথা নাহয় বাদই দিলাম। যে রোগে মাত্র একটা কিংবা দুইটা ওষুধ লাগার কথা, সেই রোগে এগারোটি ঔষধ লিখেছেন! এ তো মশা মারতে কামান দাগা নয়, রীতিমতো ক্লাস্টার বোমা নিক্ষেপ করা! সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এগারোটির মধ্যে আটটি সিল মেরে দিয়েছেন। তার মানে এই ওষুধগুলি উনি নিয়মিত লেখেন এবং কেউ তাকে সিলগুলি বানিয়ে দিয়েছে। যাতে ডাক্তার সাহেবাকে কষ্ট করে লিখতে না হয়, ঠকাস করে মেরে দিলেই চলে!
কিন্তু কেন? জবাবটা পেয়ে যাবেন যে কোনো ডাক্তারের চেম্বারে গেলেই। দেখবেন, চেম্বারের সামনে প্রচুর মোটরসাইকেল। আর দেখবেন প্যান্ট, শার্ট, টাই পরা কিছু স্মার্ট তরুণ। একজন রুগি চেম্বার থেকে বের হলেই তারা মৌমাছির মতো হামলে পড়ে। কী লিখেছেন ডাক্তার সাহেব, দেখার জন্য। কেউ কেউ তো প্রমাণ হিসেবে মোবাইলে ছবিও তুলে রাখে। কেন রাখে? সেও ওপেন সিক্রেট। তবে তারা কি জানে না, রোগ একজন মানুষের একান্ত গোপনীয় তথ্য? রুগি, ডাক্তার ও চিকিৎসায় নিয়োজিত লোকজন ছাড়া আর কারও জানার অধিকার নেই! অথচ সেই তথ্যই ফেরে অজানা মানুষের হাতে হাতে!
মানুষ রোগাক্রান্ত হলে প্রথমে আল্লাহ, ঈশ্বর, ভগবানকে স্মরণ করে। তারপর ডাক্তারের দ্বারস্থ হয়। সেই ডাক্তার যদি স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এভাবে নীতির বিসর্জন দেয়, তাহলে মানুষ কার কাছে যাবে? ডিম কিংবা কাঁচা মরিচ নিয়ে সিণ্ডিকেট হলে খবরের কাগজে ফলাও করে প্রচার হয়, সংসদে আলোচনা হয়, অথচ বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এই সিণ্ডিকেট নিয়ে কথা বলার কেউ নেই। কিছু বললেই ডাক্তার সাহেবরা সবাই জোট বেঁধে স্ট্রাইক করে বসেন। বড় বিচিত্র এই দেশ সেলুকাস!
শরীর আপনার। রোগ আপনার। পয়সা আপনার। সুতরাং পয়সা খরচ করে ওষুধ কিনে খাওয়ার আগে ডাক্তারের কাছ থেকে জেনে নিন, কোন ওষুধ কেন দিচ্ছেন? কেন খাচ্ছেন?
বিদ্রঃ কাউকে ছোট করার জন্য এ লেখা নয়। বিবেকের তাড়নায় লিখেছি। যাতে সচেতনতা বাড়ে। বিবেক জাগ্রত হয়।
সূত্রঃ ডাঃ আফতাব হোসেন এর ফেসবুক পেজ থেকে।
সংকলনেঃ দৈনিক আলোকবর্তিকা।
Leave a Reply