আমি ১৯৯১ সাল থেকেই ঢাকার লোকাল বাসের যাত্রী। গত বত্রিশ বছরেও আমার ভাগ্যের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেনি, সময় সুযোগ পেলেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ভ্রমণের উদ্দেশ্যে আমাকে লোকাল বাসে উঠতে হয়। তাতে কোন সমস্যা নেই, আমি লোকাল বাসে উঠতে মোটেই কুন্ঠা বোধ করি না, বরং কখনো কখনো সাশ্রয়ী যাতায়াতে লোকাল বাসের চেয়ে ভালো অপশন আর হয় না। ঢাকার লোকাল বাসে চড়ার এই সুদীর্ঘ ৩২ বছরে আমি বাসগুলোর চেহারায় খুব বেশি পরিবর্তন হতে দেখিনি। বাসের চালক, কনট্রাকটর ও হেলপারদের ভূমিকায়ও আসেনি কোন উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন, বরং এখনকার বাসের পরিচালনায় যুক্ত স্টাফরা অনেক বেশি আগ্রাসী, যাত্রীদের কটু কথা একদম সহ্য করে না। কটু কথা বললাম এই কারনে যে অধিকাংশ লোকাল বাসে যাত্রীদের সাথে বসচা হয় মূলতঃ বাসের ভাড়া নিয়ে। এই ৩২ বছর ধরেই দেখে আসছি কিছু যাত্রী সবসময়ই ঘোষিত ভাড়ার চেয়ে কম দিতে চান, এই কম দেয়া কেনো যৌক্তিক সেটা চিৎকার করে বলতে গিয়ে বাস শুদ্ধ মানুষকে আতঙ্কিত করে বাসের স্টাফদের সাথে হাতাহতি পর্যন্ত করে বসে সামান্য দুই পাঁচ টাকার কমবেশির কারনে। বসচা হবার আর একটি বড় কারন হলো বাসে দাড়ানোর জায়গা নেই তবুও গাদাগাদি করে আরো বেশি যাত্রী ওঠানো অথবা বাস স্টপেজে যাত্রী নাই তবুও দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করা।
ঢাকা শহরের নিত্যদিনের যানযটের সবচেয়ে ভুক্তভোগী এই লোকাল বাসের যাত্রীরা। সকালে অফিস সময়ে বাসা থেকে বের হয়ে সময়মত অফিসে পৌঁছানোর তাড়া আর বিকালে অফিস থেকে ঘরে ফেরার তাড়না দুটোই প্রতিদিন হুমকির মুখে পড়ে থাকে। খুব স্বাভাবিকভাবে দিনের পর দিন যানজট, অফিসে দেরী হবার শংকা আর সময়মত বাসায় ফিরতে না পারার ক্ষোভে লোকাল বাসে চড়া সাধারণ মানুষের মেজাজ সবসময় তিরিক্ষি হয়েই থাকে। তাই বাস চালক যদি অকারনে দেরি করে বা গাদাগাদি করে যাত্রী ওঠায় অথবা ইচ্ছে করেই সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে অধিকাংশ সময় ঘটে যায় ধৈর্য্যচূতি। তারই ফলাফলস্বরূপ চিৎকার, গালিগালাজ, হাতাহাতি এমনকি যাত্রীকে বাস থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে হত্যার মত মর্মান্তিক দূর্ঘটনাও ঘটে থাকে রাজধানীর রাজপথে লোকাল বাসের দৈনন্দিন চলাচলে। এটা যেনো অনেকটা সংষ্কৃতিতে পরিণত হয়েছে, আগের চেয়ে মানুষ অতি আক্রমনাত্মক আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং চিৎকার চেচামেচিকে তাঁরা পৌরুষ জাহির করার উপায় হিসেবে মনে করে। তাই কথা বলার সময় এরা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে বাসের অন্যান্য যাত্রী যেমন অসুস্থ ব্যক্তি, মহিলা, শিশু ও বয়স্ক বা বৃদ্ধদের উপেক্ষা করে অশ্লীল ভাষায় বাক্যযুদ্ধ চালিয়ে যায়। কিছু যাত্রী আবার ঝগড়া না থামিয়ে উসকে দিতে নানান ফোড়ন কেটে পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলতে সহযোগিতা করে।
আমার মত চির অত্যাচারেও রা না করা সহনশীল লোকাল বাস যাত্রীদের জন্য এই প্রতিদিনের যুদ্ধকে খুবই অস্বাস্থ্যকর বা রুচিহীন বলে মনে হয়। আমরা যা বাসভাড়া চাওয়া হয় তা যৌক্তিক কিম্বা অযৌক্তিক তা বিচার না করেই ভাড়া মিটিয়ে বিতর্ক এড়াতে চাই। তাই ঝগড়ারত যাত্রীকে বাস স্টাফদের চাহিদা মত ভাড়া মিটিয়ে ঝগড়া থামানোর জন্য অনুরোধ করলে আবার টিটকারি শুনতে হয়- এসব কথাবার্তা ঝগড়া ফ্যাসাদ ভালো না লাগলে আপনি প্রাইভেট কারে চড়েন গিয়ে মিয়া, আইছে নবাব পূত্র! আপনাদের মত কাপুরুষদের জন্যই তো এই ------ বাচ্চাগুলো মাথায় ওঠে!
তাই এই লেখার শিরোনাম ঢাকার লোকাল বাসের যাত্রীদের সুনাগরিকের শিষ্টাচার ও কর্তব্য আসলে কি কি? আসুন দেখে নিই আমাদের সবার মাস্টার মশাই গুগল স্যার সুনাগরিক বিষয়ে কি কি জ্ঞান দান করেন?
এভাবে একজন সুনাগরিকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট, শিষ্টাচার ও কর্তব্য লিখে শেষ করা যাবে না। লোকাল বাস যাত্রীদের অনেকেই হয়তো সুনাগরিকের বৈশিষ্ট বিষয়ক এসব বইয়ের কথা অবগত নন। তাঁরা পরিবার, পরিবেশ বা নিজের জীবন থেকেই মোটাদাগে একটা চরিত্র অর্জন করেন এবং নিজেকেই সবার চেয়ে শ্রেষ্ট্য ও জ্ঞানী মনে করেন এটা নিশ্চিত। অন্যদিক লোকাল বাসের চালক, কনট্রাকটর ও হেলপারদের জীবনে থাকে সীমাহীন দারিদ্র আর বঞ্চনার বেহিসেবী প্রেক্ষাপট, সুনাগরিক হবার কোন সুযোগই তাঁরা পান না। তাহলে আমরা যারা বাসের স্টাফদের সাথে কোমর বেধে যুদ্ধে নেমে যাই আসলে তাঁরা কোন ধরনের মানসিকতা পোষণ করে থাকি, সেটা কি একবারও ভেবে দেখি কখনো?
পক্ষান্তরে বিদেশের মাটিতে এই আমরাই কিন্তু সুবোধ বালক হয়ে থাকি, আমরা সেখানে আট ঘন্টার বদলে আঠারো ঘন্টা কাজ করেও মাথা ঠান্ডা রাখতে পারি। খুব সহজে কারো সাথে তর্কে জড়াই না, দেশ থেকে শিখে না গেলেও সেখানকার সুশৃঙ্খল পদ্ধতির অনুসরণ করে সুনাগরিকের অধিকাংশ বৈশিষ্ট পালন করি অনায়াসে। আসলে তাহলে ঝামেলা কি এই দেশের মাটি, পানি ও আবহাওয়ার? যানজট, বাসের ভাড়া বৃদ্ধি ইত্যাদি অরাজকতার জন্য লোকাল বাসের স্টাফরা কিন্তু কেউ দায়ী না। ঢাকার রাস্তায় চুক্তিভিত্তিক বাস সার্ভিস পরিচালনার পদ্ধতিটাই তো সকল সর্বনাশের মূলে, গত পঞ্চাশ বছরেও কোন সরকার এই জঘন্য পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি বলেই না রাস্তা জুড়ে ৩৬৫ দিনই চলে অরাজকতা। আমরা বিদেশের মাটিতে নিজেদের সুনাগরিকত্ব প্রদর্শণ করতে পারলেও দেশের মাটিতে ব্যর্থ হই শুধুমাত্র সঠিক পদ্ধতি বাস্তবায়ন না করে বিশৃঙ্খল ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষকতার কারনে।
তাই এদেশের সরকার যারা পরিচালনা করবেন আমাদের বিরাট দায়িত্ব হলো তাদেরকে বাধ্য করতে হবে ভালো পদ্ধতিগুলোকে বাস্তবায়ন করাতে। সোজা আঙুলে ঘি কিছুতেই উঠবে না, সচেতন লোকাল বাস যাত্রীদেরই ধর্মঘট ডাকতে হবে, নিত্যদিনের এই নোংরা যুদ্ধ আমরা করতে চাই না। এরফলে কলুষিত হয় নিজের মন, চারপাশের পরিবেশ, শিশুরা বিকৃত মানসিকতার স্বীকার হয়ে পড়ে, অসুস্থ এক সমাজের উদ্ভব ঘটে চারিদিকে। মাত্র একটা দিন যদি আমরা সুনাগরিকত্ব অর্জনের চেষ্টায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলি- এই পদ্ধতিতে চলাচলকারী বাসের যাত্রী আমরা হতে চাই না, আমরা এমন নোংরা ঠেলাঠেলি করে নিজেদের আর মানসিক রোগী বানাতে চাই না। আমরা মানসিক চাপ মুক্তি চাই, আমরা এভাবে প্রতিদিন লোকাল বাসের যাত্রী হয়ে নিজেদের সুনাগরিকত্ব বিসর্জন দিয়ে চলেছি, প্রতিদিনের যুদ্ধ আর ক্লান্তিতে মানসিক অবসাদে ভেঙ্গে পড়ে বরণ করছি অকাল মৃত্যুকে। এই যাত্রী ধর্মঘটটি হবে ঐতিহাসিক, সবাই দেখে থাকে বাস ধর্মঘটে যাত্রী দূর্ভোগ। এই যাত্রী ধর্মঘটে সবাই দেখবে সরকার ও লক্করঝক্কর বাস মালিকদের ঘৃণ্য টাকা কামানোর যুগযুগ ধরে চলমান পদ্ধতির নাকানিচুবানির অমায়িক দৃশ্য!
বিশ্বাস করুন মাত্র একটি দিন উপরের দাবীগুলো নিয়ে রাস্তায় দাঁড়ালেই পরেরদিন থেকেই সবকিছু Systematic হয়ে যাবে, আমি এ ব্যাপারে আপনাদের শতভাগ নিশ্চয়তা দিচ্ছি।
পল্লব খন্দকার, ১৭ আগষ্ট ২০২৩
mazhabkh93@gmail.com