নারী পুরুষ সমান অধিকার। এটা নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়, টক শো, বিতর্ক অনেক কিছু হয় শুধুমাত্র এটা প্রমাণ করার জন্য যে নারী পুরুষ সমান অধিকার। কিন্তু আসলেই কি সবক্ষেত্রে আমরা তা দেখছি? একজন নারী হিসেবে আমি তো বিশাল ব্যবধান দেখতে পাই। কিন্তু আজকাল পুরুষদের মতামত হলো ওনারা নাকি নারীর হাতে নির্যাতিত হচ্ছেন। পুরুষরা নাকি নারীর হাতে নির্যাতন সহ্য করতে করতে নীরবে মানসিক ভাবে মৃত্যুবরন করছেন, অথচ লোকলজ্জার ভয়ে লোক সম্মুখে বলতে পারছেন না। আর সবচেয়ে মজার বিষয় হলো কেন নারীবাদীরা এটা নিয়ে কথা বলছেন না এটা ওনাদের সবচেয়ে বড়ো অভিযোগ!! আমার ছোট মস্তিষ্কে একটা বিষয় ঢুকে না যে পুরুষ নির্যাতন নিয়ে পুরুষেরা কেন সোচ্চার না হয়ে সেই দায়িত্বটাও নারীর কাঁধে চাপিয়ে দিচ্ছেন??
বিগত কিছুদিন ধরেই পুরুষ নির্যাতন বিষয় টা ভাবাচ্ছে আমাকে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে নিজের এবং বন্ধুদের পরিবারের ভেতরের কিছু দাম্পত্য পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম আসলেই পুরুষেরা কিভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন আর সে নির্যাতনের মোটিভটাই বা কি? স্বীকার করতে কোন দ্বিধা নেই, অনেক নারীই এমন আচরণ করেন যা একটা সম্পর্কের জন্য মারাত্মক অপব্যবহার (Abuse)। পুরুষও এ ধরনের সম্পর্কের শিকার হয় এই সত্য মেনে নিয়েই বুঝতে পেরেছি "পুরুষ নির্যাতন" আসলে ক্রিয়ার বিপরীতে প্রতিক্রিয়া মাত্র। পুরুষতন্ত্রের চোরাবালিতে আটকে পুরুষেরা নিজের জীবনে এই "নির্যাতন" কে স্বাগত জানিয়েছেন। এটা কেন বললাম একটু বিশ্লেষণ করি।
আমার এক আত্নীয় একটু দেরিতে বিয়ে করেছেন তার থেকে বয়সে বারো বছরের ছোট মেয়েকে। মেয়েটি শিক্ষিতা। আপাতত তাদের একটি বাচ্চা। আমার এক বন্ধু বিয়ে করেছেন তার সহকর্মী একটি মেয়েকে। বিয়ের কিছু দিনের মধ্যে মেয়েটি কনসিভ করে আর সে চাকরি ছেড়ে দেয়। কারণ সে তার বাচ্চাকে সুন্দর ভাবে মানুষ করতে চায়। দুটো সংসারে একমাত্র রোজগেরে পুরুষেরা আর স্ত্রীরা ঘরেই থাকেন। সারাদিন চাকরির ঝামেলা সামলে অফিস শেষ হতেই বাসায় ছুটতে হয় দুজনকে। একটু দেরি হলেই ফোনের ওপর ফোন আসতেই থাকে। ঘরে সাহায্যকারী থাকলেও বউয়েরা নাকি সারাদিন কোন কাজই করতে পারেন না। ঘরের কাজ, বাইরের কাজ, বাচ্চাদের স্কুল সবই নাকি তাদের করতে হয়। পাঁচ মিনিটের হাঁটা রাস্তাও নাকি বউরা একা যেতে পারে না। এজন্য নাকি এদের গুরুত্বপূর্ণ অফিসিয়াল কাজ ছেড়ে বউয়ের সময় দিতে হয়। আপাত দৃষ্টিতে পুরোপুরি গৃহিনী নারীদের এই আচরণগুলো বেশ বিরক্তিকর এবং এগুলো পুরুষদের কাছে অপব্যবহারই (Abuse) মনে হয়।
কিন্তু এমন লক্ষ লক্ষ নারী আছেন যারা ঘরে বাইরে সবটা একা হাতে সামলাচ্ছেন। ভিড় বাসে ঠেলাঠেলি করে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে এসে ব্যাগটা রেখে শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে ছুটলেন রান্নাঘরে তারমধ্যে বাচ্চার হোমওয়ার্ক, বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের দেখভাল!! এমন হাজারো কাজ করতে হয়। একজন রোজগার করবে আবার ঘরও সামলাবে এটা নারী পুরুষ সবার জন্য অপব্যবহার (Abuse)। মজার বিষয় হলো আমার বন্ধু আর আত্মীয় এরা যখন বলছিলো এরা নির্যাতিত, খেয়াল করলাম মুখে বলছে ঠিকই কিন্তু ওদের চোখে একটা অদ্ভুত পরিতৃপ্তি, বউয়েরা ওরা ছাড়া অচল। বুঝলাম ওরা চায় না বউদের ওদের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমে যাক। "আমার বউ আমাকে ছাড়া চলতে পারে না" এই বোধ তাদের অহমের গোড়ায় জল ঢেলেছে, যে জল পেয়ে তারা নিজেদেরকে স্ত্রীর রক্ষাকর্তা ভাবছেন এবং মধুর নির্যাতন সহ্য করছেন।
বেশ অনেক বছর আগের একটা ঘটনা বলি, আমার পরিচিত একজন বিয়ে করেন অনার্স পড়ুয়া একটা মেয়েকে। দেখেশুনে পারিবারিকভাবেই বিয়ে হয় তাদের। মেয়েটি ভালো গান করতো, সুন্দর আবৃত্তি করতো, টুকটাক লেখালেখি করতো, আর দেখতে একেবারে যে পাতে দেওয়ার মতো নয় তাও না। আর সে ছিলো অত্যন্ত বন্ধুবৎসল স্বভাবের। বিয়ের মাস তিনেক পর থেকে শুরু হয় বিপত্তি। মেয়েটির স্বামী মেয়েটিকে সন্দেহ করতে শুরু করেন। যার ফলশ্রুতিতে মেয়েটির পড়াশোনা, গান-বাজনা এমনকি ঘর থেকে বাইরে বের হওয়াও বন্ধ হয়ে যায়। মেয়েটির জীবন থেকে তার ভালোলাগাগুলো সব কেড়ে নেওয়া হলো। আরো ভয়ংকর বিষয় হলো মেয়েটির বাপের বাড়ির সাথেও সব যোগাযোগ বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়। আর সবচেয়ে মজার বিষয় হলো এসব কাজগুলো করেন মেয়েটির স্বামী, যিনি কিনা দেশের স্বনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা এবং মুখে নিজেকে প্রগতিশীল দাবি করা একজন ভদ্রলোক। মেয়েটি সব মেনে নেয় শুধু সমাজ আর তার বাবার সন্মানের কথা চিন্তা করে। এতোকিছুর মধ্যেও মেয়েটি পড়াশোনা শেষ করে। একাধিক বার চাকরির জন্য ডাক পেয়েও সে ডাকে সাড়া দিতে পারেনি স্বামীর অনুমতি না মেলায়। অথচ তার স্বামী বাইরের লোকের কাছে বলে বেড়ায় তার জীবনটা নাকি শেষ হয়ে গেলো। সে যে কি ভীষণ মানসিক নির্যাতনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে একমাত্র সে-ই জানে। তার সব বন্ধুর বউ চাকুরিরতা, কিন্তু তার বউ ইউজলেস ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি হাজারো অভিযোগ। এখানে আমি আসলে ভেবে পাইনা সবকিছুতেই সাফার করলো মেয়েটি আবার সে-ই হয়ে উঠলো স্বামীকে নির্যাতনকারী? সত্যিই কি বিচিত্র এই নির্যাতন অনূভুতি!
এবার বেশ সিরিয়াস একটা পুরুষ নির্যাতন এর ঘটনা বলি। বেশ অনেকদিন আগে একটা পত্রিকায় পড়েছিলাম। ভদ্রলোক একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, স্ত্রী ব্যাংকার। তাদের ১৫ বছরের একটা মেয়ে আছে। গত এগারো বছর ধরে তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক নেই। দরকার ছাড়া কথা বলেন না, দুজন দু রুমে থাকেন। অথচ তারা কিন্তু একসময়ে নিজেদের পছন্দে বিয়ে করেছিলেন। হঠাৎ করে ভদ্রলোকের মনে হলো স্ত্রীকে ওনার আর ভালো লাগছেনা। স্ত্রী আগের মতো সুন্দরী নেই। মোদ্দা কথা স্ত্রীর প্রতি তার কোন আকর্ষণই নেই এজন্য দুজনের ঘর আলাদা হয়ে গেছে। এখন ভদ্রলোক মনে করছেন তিনি ভীষণ ভাবে নির্যাতিত কারন, তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাইছেন কিন্তু ওনার বর্তমান স্ত্রী তাতে মত দিচ্ছেন না। ভদ্রলোক রোজগার করা সত্বেও ওনার স্ত্রী, সংসার বা সন্তানের কোনও খরচই বহন করেন না। ওনার ভাষ্যমতে স্ত্রী র কাছে দ্বিতীয় বিয়ের কথা বললে স্ত্রী মামলা করার হুমকি দিচ্ছেন!! কি ভয়ঙ্কর পুরুষ নির্যাতন হচ্ছে একটিবার ভেবে দেখুন! আচ্ছা এই ঘটনাটা যদি উলটো ঘটতো তাহলে কি হতো? আমাদের সমাজে লক্ষ লক্ষ নারী আছেন যারা প্রতিদিন নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বৈবাহিক নির্যাতন বা ধর্ষণের শিকার হন। তাঁরা সবকিছু মেনে নিচ্ছেন শুধু সন্তান বা সমাজের কথা মাথায় রেখে আর যাতে সংসারটা টিকে থাকে সেজন্যে।
অনেক স্বামীকে তো বলতে শোনা যায় বউরা তো সারাদিন ঘরে বসে থাকে আরামে, আর আমাদের ভাবে টাকার মেশিন। ইনকাম করতে কি কষ্ট তারা কি জানে সেটা? তাদের মতে বউদের সব চাহিদা পূরন করতে করতে জীবন শেষ। বউয়েরা কেন টাকা বানানোর মেশিন মনে করে? কারন আপনি সেটাই চান। আপনি তো টাকা বানানোর মেশিন হয়ে কারো ভাত কাপড়ের মালিক হয়ে থাকতে চান। পুরুষতন্ত্র আপনার মনস্তত্ত্বে পুরে দিয়েছে নিজেকে রক্ষাকর্তা ভাবার চাপ। সেই চাপেই তো উপার্জনের চাবিটি কেড়ে নিয়ে আপনি দিনের পর দিন বউ বানিয়ে তাকে ব্যাস্ত রেখেছেন সংসার, সিরিয়াল, পার্লার, শাড়ি, গয়না, কসমেটিকস এর পেছনে। এখন সে তো টাকার মেশিন ভাববেই আপনাকে। আপনি কতো কষ্ট করে ঘেমে নেয়ে টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে পরিবারের জন্য রোজগার করেন এটা তো কোনদিন তাকে বুঝতেই দেননি। পুরুষতন্ত্রে নারী- পুরুষ উভয়েরই এমন ধারণা হয়েছে যে, পুরুষ ছাড়া নারী অসহায়।
আপনার স্ত্রী আপনাকে সন্দেহ করে কারন সে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। আপনি তো তাকে ভাবতে বাধ্য করেছেন সে আপনার বান্ধবী বা অফিস কলিগের মতো তুখোড় বা চৌকস না। এই নিরাপত্তাহীনতার মানসিকতা তো সে আপনার কাছ থেকেই শিখেছে। আপনি আপনার স্ত্রীকে নিয়ে নিরাপত্তাহহীনতায় ভোগেন বলেই তাকে শুধু বউ বানিয়ে রেখে তার স্বাধীনতা, স্বনির্ভরতার স্বাদ সব কেড়ে নিয়েছেন। এখন সে নিজের নিরাপত্তার জন্য আপনার পুরোপুরি দখল চাইবে এটাই কি স্বাভাবিক নয়?
পিতৃতন্ত্রের ধারনাটাই এমন, যেখানে নারীদের পিষছে বিধিনিষেধের শিল পাটায়, পুরুষদের চুষছে দায়িত্বের যাঁতাকলে। আমাদের পুরুষ শাসিত সমাজে যে নিয়ম কানুনগুলো আছে সেগুলো আসলে পুরুষেরা নিজেদের সুবিধার জন্য করেছে। সে নিয়ম মানতে যেয়ে নারী হয়ে উঠেছে নিপিড়ক। এই পিতৃতন্ত্র নারীর মনে একটা দাসত্বের বীজ বুনে দিচ্ছে। তা আস্তে আস্তে শেকড় ছড়াচ্ছে নারীদের নিজেকে রক্ষার জন্য। আর সেই আক্রমণের শিকার হন পুরুষ। আসলে নারী নয় আপনাকে নিপীড়ন করে আপনার অহম। এটি আসলে পিতৃতন্ত্রের অহমের উপর এক মধুর প্রতিশোধ।
যে পুরুষ নিজের ওপর আস্থাশীল সে সঙ্গী হিসেবে মানসিকভাবে স্বাধীন, শারীরিকভাবে সক্ষম এবং স্বনির্ভর একজন নারীকে পছন্দ করবে। যে বিনা কারনে পুরুষের ওপর চাপ বাড়াবে না।
স্ত্রী নয়, আপনার জীবনে একজন সঙ্গী আনুন। তাকে নিজের দায়িত্ব, প্রয়োজনে পুরো সংসারের দায়িত্ব নেওয়ার মতো শারীরিক সক্ষমতা, মানসিক সবলতা, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন করতে দিন। কোথাও বেঁধে গেলে তাকে হাত ধরে সে বাঁধা অতিক্রম করতে দিন, তার সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবেন না। সত্যিকারের পার্টনারশিপ গড়ে তুলুন। দেখবেন দিনশেষে আপনিই লাভবান হবেন।
বনানী ঘোষ, খুলনা থেকে।