অবচয় কি?
যেকোনো ধরনের সম্পদ যেমন দালানকোঠা, আসবাবপত্র ইত্যাদি ব্যবহার করার ফলে সম্পদের মূল্য অল্প অল্প করে কমতে থাকে। যা একটি ব্যবসায়ের জন্য ব্যয়। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী সম্পদের এই মূল্য কমাকে অবচয় বলে।
দক্ষিণ এশিয়ার দারিদ্রপীড়িত চারটি দেশ আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারত। এসব দেশে মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেকই নারী, বাংলাদেশে তো সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী (জনসংখ্যা ও আবাসন শুমারি-২০২২) বর্তমানে প্রতি ১০০ জন নারীর বিপরীতে পুরুষের সংখ্যা প্রায় ৯৯ জন। অর্থাৎ কাগজে কলমে বাংলাদেশে এখন নারীর সংখ্যা পুরুষের চেয়ে বেশি! শুধু কাগজে কলমেই নয় আজকাল স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে একটি শ্রেণিতে পড়ুয়া পুরুষ শিক্ষার্থীদের চেয়ে নারী শিক্ষার্থীদের বেশি সংখ্যায় পাওয়া যায়। ভারতেও প্রতি ১ হাজার জন পুরুষের বিপরীতে নারী আছেন ১ হাজার ২০০ জন। পাকিস্থানে মোট জনসংখ্যার ৪৮.৫৪ শতাংশ নারী এবং আফগানিস্থানেও পুরুষের সংখ্যা কিছুটা বেশি (১ জন নারীর বিপরীতে ১.০৫ জন পুরুষ)।
গুগল ও চ্যাটজিপিটির কাছে প্রশ্ন করে যতোটুকু জানা গেলো তাতে আশিয়ানভূক্ত দেশগুলোতেও মোটামুটি নারী ও পুরুষের অনুপাত প্রায় সমান। যদিও থাইল্যান্ড, ফিলিপিন, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশের রাস্তায়, শপিং মল বা অফিসে এতো বেশি নারীদের পদচারনা দেখা যায় যে আসল পরিসংখ্যান না জানলে সেখানে নারীদের সংখ্যা পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি মনে হতেই পারে। আমার ব্যক্তিগত ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় থাইল্যান্ড ও ফিলিপিনের সব জায়গায় সব প্রতিষ্ঠানে নারীদের প্রধান হিসেবে পেয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে রাস্তার পাশের ফুটপাতের বিক্রয় কর্মী পর্যন্ত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীদের প্রাধান্য। গত আগস্টে থাইল্যান্ড ভ্রমণের সময় একজন ভালো ইংরেজি জানা রসিক ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাথে কথা বলতে বলতে তাঁর গভীর বিস্ময়ের একটি যুতসই উত্তর দিতে পারিনি। উক্ত ড্রাইভার সাহেবের এক বন্ধু বাংলাদেশের মেট্রোরেল অবকাঠামো উন্নয়নের কাজে Italian-Thai Development Company Plc (ITD) তে কর্মরত আছেন। সেই সুবাদে তাঁরা ভিডিও কলে কথা বলেন এবং ড্রাইভার সাহেব কেনো থাইল্যান্ডের রাস্তার মত ঢাকার রাস্তায় নারীদের দেখা যায় না সেই আশ্চর্যবোধক প্রশ্ন করে আমার দিকে তাকিয়ে উত্তরের অপেক্ষা করেন।
প্রশ্নটা আমারও তবে উত্তর আমি জানি এবং বেশ ভালোভাবেই জানি। কিন্তু একজন বিদেশীর কাছে তা সহজে ব্যখ্যা করা সম্ভব নয় কেননা নারীদের নিয়ে আমাদের সাথে রয়েছে তাঁদের মনোভাবের ব্যাপক বৈপরীত্য। আমরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে জন্ম নেয়ায় নারীদের ব্যাপারে একধরনের মাইন্ড সেট আপ নিয়ে থাকি আর থাইল্যান্ডের মত মাতৃতান্ত্রিক সমাজে জন্ম নিয়ে তাঁদের মনোভাব হয় একেবারেই আলাদা। ওদের দেশে নারীরা পরিবারের প্রধান হিসেবে ঘরের বাইরে কাজ করবে এটাই যেমন স্বাভাবিক আর আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা ঘরের ভিতর কাজ করবে সেটাই প্রচলিত ধারণা। যদিও বাংলাদেশ ও ভারতে নারীদের সম্পর্কে পুরুষতান্ত্রিক ভাবনায় খুব বড় কোন পরিবর্তন আসেনি, তবে ঘরের বাইরে চলাফেরা ও কাজ করার ক্ষেত্রে অনেক অনেক এগিয়েছে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এক্ষেত্রে নারী শিক্ষায় এ দুইটি দেশের সরকারের ব্যাপক পৃষ্টপোষকতার কারনে এতোটা উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। কিন্তু ধর্মীয় বেড়াজালের দোহাই দিয়ে পাকিস্থান ও আফগানিস্থানে নারীরা শিক্ষায় যেমন পিছিয়ে পড়ছেন তেমনি নারী হিসেবে সমাজে আত্মমর্যাদার তলানীতেই পড়ে আছেন।
এবার দেখি আমাদের দেশে নারীদের সম্পর্কে পুরুষদের প্রচলিত ধ্যানধারনা কি?
সহিংস, কর্তৃত্বপরায়ণ, যৌনকামনাযুক্ত, অবজ্ঞাসূচক, রসিকতাপূর্ণ, অর্ধেক মানুষ, বুদ্ধিহীনা, জড় পদার্থ, কমজোরি, অপদার্থ, অযোগ্য, অধীনস্ত, অকাজের, দেহসর্বস্ব ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি আরো আছে।
আমরা নারীকে কিভাবে দেখতে চাই?
আদর্শ, কোমলমতি, নম্র, ভদ্র, পতিব্রতা, গৃহলক্ষী, সুদর্শনা, প্রেমময়ী, সুভাষীনি, ছলাকলা পারদর্শী ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি আরো আছে।
আশা করি পাঠক আমাদের দেশের নারীদের নিয়ে আরো কিছু বিশেষণ নিজেদের মত করে ভেবে নিতে পারবেন। আমি শুধু আমাদের দেশের নারীদের উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটা বিষয়ে আলোকপাত করতে পারি। তাহলো আমাদের দেশের মেয়েরা এখনো স্কুলে যাওয়ার সময় নিরাপত্তা ভীতির শিকার হয়, আমাদের নারীরা তাদের কর্মস্থলে নিরাপদে, নির্ভয়ে ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অংশগ্রহণ করতে পারেন না। রাত বিরাতে বা নির্জন স্থানে আমাদের নারীরা নিরাপত্তার অভাবে ভোগেন এমনকি সংগবদ্ধ যৌন নিপীড়নের স্বীকার হন প্রায়শই। সেই হিসেবে আমার দেখা থাইল্যান্ডের রাস্তায় রাত বারোটা একটায়ও নারীদের একা নির্জন বাস স্টপে অবস্থান করতে এবং নির্ভয়ে আত্মবিশ্বাসের সাথে ভ্রমণ করতে দেখেছি। আমাদের দেশে একজন নারীর পক্ষে এটা প্রায় অসম্ভব!
সম্প্রতি খুলনার বটিয়াঘাটায় চার কিশোরী ফুটবলারের ওপর হামলা করা হয়, মাঠে অনুশীলনের সময় হাফ প্যান্ট পরিধান করাই এই হামলার প্রধান কারন। এদেশে সর্বক্ষেত্রে ‘নারীর পোশাক' নিয়ে নারীর প্রতি হামলা ও কটুক্তি করার ঘটনা খুবই স্বাভাবিক৷ সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি কথা খুব চালাচালি হচ্ছে যে ‘নারী কিসে আটকায়?' এর উত্তর হচ্ছে নারী কিছুতেই আটকায় না, কিন্তু নারীর পোশাকে সমাজ আটকায় যায় বারবার৷ সমাজের চোখ শুধু নারীর পোশাকের দিকে- হোক সে খেলোয়াড়, ছাত্রী, গায়িকা বা নায়িকা, অফিসের কর্মী অথবা গৃহিনী৷ এমনকি বোরকা হিজাব করা মাদ্রাসায় পড়ুয়া নারী শিক্ষার্থীও নিজের শিক্ষকের দ্বারা যৌন হেনস্তার স্বীকার হয়ে থাকেন। এর একমাত্র কারনই হলো নারীদের নিয়ে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চরম নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। একজন পুরুষ হিসেবে এই দৃষ্টিভঙ্গির হাজারো তত্ত্ব ও তথ্য আছে আমার কাছে। আমার ছেলেবেলা থেকেই নারীদের সহজাত বিকাশে সমাজে পদে পদে বাধাপ্রাপ্ত হতে দেখেছি এবং এখনো পর্যন্ত নারীদের প্রতি পুরুষের সেইসব একপেশে দৃষ্টিভঙ্গির খুব একটা পরিবর্তিত হয়নি।
আমি যদি আরও একটু খোলামেলাভাবে বলি তাহলে নারীদের এদেশে স্রেফ পণ্য হিসেবেই দেখা হয়। আমাদের দেশের যুবক ছেলেদের চোখে নারীরা হলো তথাকথিত Product এর বাংলা অর্থের সমার্থক। Product এর এই বাংলা ভার্সনটাকে যে কি জঘন্যভাবে রসিয়ে রসিয়ে ইভ টিজিং, বন্ধু আড্ডায় ও গালিগালাজের সময় উচ্চারণ করে পুরুষেরা তাতে আমারই গা ঘিনঘিন করে। আজ আমরা তৈরি পোষাক শিল্পের উত্থানে যদি নারী গার্মেন্টস কর্মীদের অবদান স্বীকার করি তাহলে ঘৃণ্য Product এর বাংলা ভার্সনটির ব্যবহার আজই ছেড়ে দেয়া উচিত। এখন সকলের একবাক্যে মেনে নেয়ার সময় এসেছে যে, আমাদের দেশের নারী শক্তি আমাদের জন্য সম্পদ এবং এই সম্পদের এখনো ব্যাপক উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে। আশার কথা নারী বিদ্বেষী সমাজ হলেও এদেশের সরকার প্রধান নারী, তাই আমরা নারী উন্নয়ন নিয়ে আশাবাদী থাকতেই পারি।
মহান সৃষ্টিকর্তা এবং প্রকৃতি কিন্তু সমস্ত সৃষ্টিকূলের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে একটা অংক বা ছক কষে কষে হিসাব মিলিয়ে দিয়েছে। নারীদের দৈহিক শক্তি কম দেয়া হয়েছে সৃষ্টিকূলের সার্বিক ভারসাম্য বজায় রাখতেই, তাকে অবজ্ঞা করার মত দুঃসাহস আমাদের দেখানো উচিত নয়। নারী পুরুষের দৈহিক গঠনের পার্থক্য তৈরি হয় নানাবিধ হরমোন নিঃসরণের প্রাকৃতিক পদ্ধতিতেই। এখানে আমাদের তো কারো হাত নেই, এটা নিয়ে তাই প্রশ্ন করারও অধিকার আমাদের নেই। তাহলে কি বাঘের গায়ে শক্তি বেশি বলে পুরুষ মানুষের মর্যাদার চেয়ে বাঘের অবস্থান উপরে রাখতে হবে? এটা কি হাস্যকর হবে না? যদি তাই হয়, পুরুষ মানুষকে কি শুধুমাত্র বুদ্ধিমত্তার কারণেই বাঘের চেয়ে শক্তিশালী ধরি আমরা? নিশ্চই বাঘ ও পুরুষ মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব তুলনা করার ক্ষেত্রে বুদ্ধিমত্তাই মূল ব্যাপার। সেক্ষেত্রে নারীর বুদ্ধিমত্তার কারণে কি পুরুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হতে পারে না?
সৃষ্টিকর্তা বা প্রকৃতি যদি নারীকে বুদ্ধিহীনা করে রাখতেন তাহলে আমি একবাক্যে মেনে নিতাম তাঁদের নিয়ে সকল প্রকার নেতিবাচক ধারণাকে। কিন্তু তা করা হয়নি, সৃষ্টিকর্তা এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সুরক্ষার স্বার্থেই নারীদের জ্ঞান বুদ্ধিতে ঘাটতি ফেলেননি। তাই আমাদের অধিকার নেই সেই জ্ঞান বুদ্ধিকে অকাজে ব্যবহার করার। ঘরে ফেলে রেখে সম্পদের অপচয় যেমন করা যাবে না তেমনি নারীকে যোগ্যতা ও মেধা অনুযায়ী কাজের স্বাধীনতা দেয়ার মাধ্যমে সমাজের সম্পদের অবচয় হিসাবের ভিতরে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। তাঁদের দ্বারা সকল প্রকার কাজই করানো সম্ভব শুধু প্রয়োজন নারীদের ক্ষমতা নিয়ে পুরুষের হীন মানসিকতার পরিবর্তন। আমরা যদি সৃষ্টি ও স্রষ্টার প্রতি যথার্থই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চাই তাহলে অবশ্যই নারীর জ্ঞানের শক্তিকে আমাদের সম্মান করতে হবে। নারী-পুরুষের পারস্পারিক শ্রদ্ধা ও সম্মানের জায়গাটা সমান্তরাল না হলে আমাদের সমাজে নারী সম্পদের অবচয় কোন হিসাবেই আসবে না, হবে শুধুই নারী শক্তির অপচয়।
পল্লব খন্দকার, ২৩ আগষ্ট ২০২৩