আমি সৌভাগ্যবান যে দেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েছি। সৌভাগ্যবান এই কারণে বলছি যে, প্রথম বছর মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং বা কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই আমি ভর্তি যুদ্ধে উর্ত্তীর্ণ হতে পারিনি। সেই কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হয়ে গিয়েছিলাম যাতে শিক্ষা জীবনের একটি বছর অপচয় না হয়। দ্বিতীয় বছরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি যুদ্ধে কোনমতে টিকে গিয়ে স্কুল ও কলেজের ভালো ফলাফলের প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলাম। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে আমার মত এমন হাজার হাজার ভালো ফলাফল করা শিক্ষার্থী ভর্তি যুদ্ধে প্রত্যাশিত ফল না পেয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় বিভিন্ন বিষয়ে স্নাতক (অনার্স) পর্যায়ে ভর্তি হন। ইদানীং কালে অবশ্য যাদের অভিভাবকদের যথেষ্ট পরিমাণ আর্থিক সঙ্গতি আছে তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যয়ন করেন। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয় এই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান যুগের সাথে একেবারেই বেমানান বিষয়গুলোতে চার বছর মেয়াদী স্নাতক ডিগ্রী প্রদান করাটা একবারেই যাচ্ছেতাই ব্যাপার!
কেন বলছি এমন আজগুবি কথা? আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। আমার পরিচিত সিনিয়র, জুনিয়র বা সমসাময়িক বন্ধু যারাই লেখাপড়ায় তেমন চৌকস ছিলো না তারা অনার্সের পরিবর্তে দুই বছর মেয়াদী ডিগ্রী বা বিএ/বিএসসি/বিকম পাশ করেই চাকুরী জগতে কম বেতনে যুক্ত হয়েছিলো। আজ তাদের অধিকাংশই কর্ম জীবনে সফল, আমরা যারা অনার্স করতে গিয়ে সময় নষ্ট করেছি তাদের চেয়ে অভিজ্ঞতায় ও বেতনে তারা এগিয়ে আছে। এমনকি পাশ্চাত্যে শুধুমাত্র মেধাবী শিক্ষার্থীরাই অনার্স কোর্স নেয়, বাকী অধিকাংশ শিক্ষার্থীরাই কারিগরি শিক্ষায় ঢুকে পড়ে। অথচ আমাদের দেশে উল্টো নিয়ম চলে, অনার্স নামক অথর্ব চার বছর মেয়াদী ডিগ্রী গ্রহণ না করলে যেমন সমাজেও ইজ্জত পাওয়া যায় না, চাকুরীতেও অবহেলার শিকার হতে হয়। অথচ আমার অভিজ্ঞতা বলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ে হাতে গোনা কিছু শিক্ষার্থী ব্যতীত কারোই শিক্ষা বা জ্ঞান গরিমার বিরাট কোন উন্নতি ঘটে না। তাহলে এই বিশাল একটি জনবলকে চার বছর মেয়াদী শিক্ষায় ঢুকিয়ে সময়ের অপচয় না ঘটিয়ে কর্মমূখী শিক্ষার সাথে যুক্ত করাই উত্তম।
আমাদের দেশের সরকারি বা বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাবার যোগ্যতায় চার বছর মেয়াদী অনার্স কোর্স করা সম্ভবত বাধ্যতামূলক। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পিএসসি এর মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ প্রদান করায় অধিকাংশক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ুয়ারা নির্বাচিত হন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়ারা সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অধিকাংশক্ষেত্রে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে থাকেন। সেই সুযোগও প্রকৃত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পেতেন না একসময়। এখন অবশ্য জাতীয় শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণ না হয়ে কেউ সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাবার যোগ্য হতে পারেন না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য শিক্ষক নিবন্ধন প্রক্রিয়া আরম্ভ হবার পূর্বেই বিশাল সংখ্যক পেশাজীবি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে গেছেন নিয়োগ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। এখন তারা কর্মজীবনে সিনিয়র শিক্ষক হয়ে গেছেন বটে কিন্তু যোগ্য শিক্ষক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি।
আমার দাবী হলো দেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের আর কোন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। আগের প্রতিষ্ঠানগুলোকে কিছু শর্ত সাপেক্ষে সরকারিকরণ করে নেয়ার উদ্যোগ নিতে হবে এবং নির্দিষ্ট মেধা ও কর্ম দক্ষতা যাচাইয়ের সুযোগ রেখে শুধুমাত্র সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের শিক্ষক হিসেবে বিবেচনা করে অযোগ্য অদক্ষ শিক্ষকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দিয়ে বিদায় করে দিতে হবে। যখন সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি হয়ে যাবে তখন পিএসসির স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অধিকাংশ মেধবীরাই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের সুযোগ পাবেন। অন্যদিকে যত্রতত্র অনার্স নামক চার বছর মেয়াদী কোর্স না পড়িয়ে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি করতে হবে। যেখানে অনার্স কোর্স রয়েছে সেগুলোর আসন সংখ্যা সীমিত করে দিতে হবে, পারলে সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই কারিগরি শিক্ষার নতুন কোর্স খুলতে উদ্যোগ নিতে হবে। এখন যারা কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত বিশেষ করে তিন বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন তাদের মেধা একদমই মানসম্পন্ন নয়। তাই অনার্স পড়ার সুযোগ কমিয়ে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি করতে পারলে আরো একটু মেধাবী শিক্ষার্থীগণ কারিগরি শিক্ষায় ভর্তি হতে বাধ্য হবেন। এতে লাভবান হবে সমগ্র জাতি, দেশের চাহিদা মিটিয়েও দেশের বাইরে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে।
আজকের লেখাটায় শুধু শিক্ষক নন বরং বাংলাদেশে অনার্স নামক শিক্ষা পদ্ধতির অপচয় এবং কারিগরি শিক্ষার উপর জোর দিয়ে লেখা হলেও আমার মূল বক্তব্য হলো শিক্ষকতা পেশায় যেন মেধাবীদের যুক্ত হবার সুযোগ বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে কোনমতে অনার্স পাশ দিয়েই যেভাবে শিক্ষক নির্বাচিত হয়ে যান অনেক অযোগ্য মানুষ, পরবর্তী তিন চার যুগ তাঁর অশিক্ষকসুলভ অদক্ষতায় বিরাট ক্ষতির মুখে পড়ে যায় আগামী প্রজন্ম। আমার শৈশবের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীদের মান অবনয়নের উদাহরণ দেখেই সারা দেশের গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিস্থিতি সহজেই অনুমান করতে পারি। তাই দীর্ঘমেয়াদী শিক্ষা সংস্কারের পথে আমাদের এক্ষুনি যাত্রা শুরু করার কোন বিকল্প নেই। শিক্ষার আত্মহত্যা রোধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেধাবী শিক্ষক নিয়োগদানই একমাত্র সমাধান। এ ব্যাপারে সবাইকে একই ছাতার নীচে এসে সম্মিলিতভাবে বাঁচাতে হবে শিক্ষার মৌলিক কাঠামোগুলো। অন্যথায় অবক্ষয়ের তীব্র তোড়ে দূর্বল শিক্ষায় জাতি হিসেবে চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হবে।
চলবে ………………………………
পল্লব খন্দকার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩
mazhabkh93@gmail.com
Leave a Reply