আমার স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষে মানবিক কার্যক্রমে অনেকদিন ধরে যুক্ত থাকায় পরিচিতজনদের কাছে আমি ব্যক্তিগতভাবে একজন ফেসবুক বা অনলাইনে অনুদান সংগ্রাহক এক্টিভিস্ট হিসেবে স্বীকৃত। আমি মজা করে নিজেকে বলি ডিজিটাল চাঁদাবাজ! একজন প্রকৃত বিপদাপন্ন মানুষকে সহযোগিতা করতে আর্থিক অনুদানের প্রয়োজন হলে পরিচিতজনেরা আমাকেই কঠিনতম এই দায়িত্ব দেন। এই মহান দায়িত্বটি পালন করতে করতে অনেকেই আমাকে এতোটাই বিশ্বাস করেন যে যার জন্য আর্থিক সহযোগিতা চাওয়া হচ্ছে তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে টাকা না দিয়ে আমাকে সরাসরি দিতে চান বা দিয়ে থাকেন। ব্যাপারটা বিব্রতকর মনে হয় তবুও অনেক সময় সেটি গ্রহণ করতে হয় এবং যতক্ষণ না সেই আর্থিক অনুদান বিপদাপন্ন নির্দিষ্ট মানুষটির কাছে পৌঁছে দিতে না পারি ততক্ষণ অস্বস্থিতে ভুগতে থাকি। ভয় হয়, ভুল করে কারো জন্য পাওয়া একটি টাকাও আমার কাছে থেকে গেলে তা খুবই লজ্জাকর। সেই ভয় ও ভুল থেকে বাঁচতে আমি নিজ থেকেও সাধ্যমতো অনুদান যুক্ত করে সহায়তা প্রার্থীকে বুঝিয়ে দিই।
মানবতার ফেরিওয়ালা হতে গেলে আপনাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আর্থিক অনুদান পাবার জন্য অবশ্যই সকলের কাছে আবেদনময়ী একটা মেজেস দিয়ে কন্টেন্ট তৈরি করতে হবে। আপনার সামান্য আর্থিক সহযোগিতায় একজনের জীবন বাঁচতে পারে এমনভাবেই তা উপস্থাপন করতে পারলে অনুদান সংগ্রহের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। আমরা সম্মিলিতভাবে কোন কোন ফেসবুক সহযোগিতার পোষ্ট থেকে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা পর্যন্ত সংগ্রহ করেছি। রীতিমতো বিস্ময়কর ঠেকেছে একজন মানুষের বিপদে অন্যজনের নিরবে পাশে দাঁড়ানোর এই ইতিবাচক মনোভাব দেখে! এমন একটি মহাজজ্ঞ সম্পন্ন করতে পারলে এবং আর্থিক অনুদানে কারো জটিল চিকিৎসা সফল হলে বা জীবন রক্ষা হলে তখন কি যে এক অনির্বচনীয় আনন্দ পাওয়া যায় তার সাথে অন্য কোন প্রাপ্তির তুলনা চলে না।
এই তো ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানবিক কাজে আর্থিক অনুদান সংগ্রহ করার সাধারণ সূত্র, এই মহৎ বিষয়টিকে জটিল করে তুলেছে মানবতার ফেরিওয়ালার ভং ধরা কিছু নিকৃষ্ট মানুষ! ইদানীং প্রায়ই এ সংক্রান্ত প্রতারণার সংবাদ আমরা দেখতে পাই যার সর্বশেষ ঘটনা হিসেবে মিল্টন সমাদ্দার ও গং এর উৎপত্তি। আমি অসংখ্যবার এই চাইল্ড এন্ড ওল্ড এজ কেয়ার এর মানবিক সহযোগিতা চাওয়ার পোস্টগুলো শেয়ার করেছি। পরিচিত বহু মানুষের ব্যক্তিগত মেসেঞ্জারে বা ফোন নাম্বারে সহযোগিতা করতে অনুরোধ জানিয়েছি, বিদেশে অবস্থানরত বন্ধু বা পরিচিতদেরকেও অনুরোধ জানিয়েছি সাধ্যমতো সহযোগিতা করতে। এর পিছনে একটাই কারন তাহলো আমাদের সবাই মিলে যে কাজটি করা অত্যাবশ্যক সেটি মিল্টন নিজ দায়িত্বে করছে! অথচ এখন আমার নিজেকে একই সাথে প্রতারকের সহযোগী এবং প্রতারণার শিকার বলে মনে হচ্ছে!
এই যে ফেসবুকে আমার দেয়া সহযোগিতার পোস্ট দেখে যারা বিশ্বাস করে টাকা পাঠিয়ে দেন, অনেকে নাম পর্যন্ত জানান না। গোপনে সহযোগিতা করলে নেকি বা সওয়াব বেশি পাওয়া যায় সেই ধর্মীয় অনুভূতি থেকে কেউ কেউ নিজের নাম প্রকাশ করতে চান না। সেই মানবিক ডাকে সাড়া দেয়া মানুষগুলো যদি দেখেন অনুদানের টাকার অপব্যবহার করা হয়েছে বা একজন ছদ্মবেশী প্রতারককে অনুদান প্রদান করা হয়েছে কি গভীর কষ্ট অনুভূত তা শুধু ভুক্তভোগী মাত্র অনুধাবন করতে পারেন। তাই মানবতার ফেরিওয়ালা সেজে সংগৃহীত অর্থের স্বচ্ছ হিসাব নিয়মিত প্রকাশ করাটা সকলের নৈতিক দায়িত্ব। আমরা দেখে থাকি মসজিদগুলোতে সাপ্তাহিক অর্থ সংগ্রহের পরিমাণ ইমাম সাহেব ঘোষণা করে থাকেন। এতে মুসল্লিরা একধরণের আস্থা পান ও তৃপ্তি বোধ করেন। আমার শৈশবের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ করতে সম্মানিত প্রধান শিক্ষক পাঁচ পয়সা দশ পয়সার হিসাবটিকেও গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরতেন এলাকার অভিভাবক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সামনে।
বাবাকে পেটানোর মত চরম গর্হিত কাজ করে নিজ গ্রাম থেকে বিতাড়িত মিল্টন সর্দার ঢাকায় এসে যদি মানবতার ফেরিওয়ালা সেজে বসে সেক্ষেত্রে এক সময় তার দানবীয় চরিত্র প্রকাশিত হবেই। সেটিই ঘটেছে, মিল্টনের স্ত্রী ডিবিকে নাকি বলেছেন- অটিজম আক্রান্ত ও প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের টর্চার সেলে নির্মমভাবে পিটিয়ে উল্লাস করার সময় তিনি স্বামীকে বিচারের ভয় দেখিয়েছেন। বলেছেন যে, এই অবুঝ বাচ্চাদের সাথে এমন নিষ্ঠূর নির্মমতার জেরে একদিন তার সকল পাপ প্রকাশিত হবে এবং কঠিন বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। মিল্টন স্ত্রীর পরামর্শ শুনে সংশোধিত হবার একটা সুযোগ পেয়েছিলো কিন্তু কথায় আছে “চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী”। অবশ্য ডিবি অফিস থেকে বের হয়ে মিল্টনের স্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন- তিনি নাকি প্রকাশিত মিল্টনের ভয়ঙ্কর অপরাধের কথা কিছুই জানেন না?
কথা হচ্ছে গ্রেফতার, মামলা ইত্যাদির পর এখন কেনো মিল্টনের চরিত্রের অন্ধকার দিকগুলো মিডিয়াতে আসছে? আপনাদের কি ধারনা আমি বলতে পারবো না কিন্তু আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি এটিই আমাদের দানব রাষ্ট্রের মৌলিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। সাবেক আইজিপি রাষ্ট্রীয় শুদ্ধাচার প্রাপ্ত বেনজির সাহেবের মহাসমুদ্র সমান সম্পদের সংবাদ এখন কেনো রঙ লাগিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে? কারন একটাই, আমরা সবাই দখল হয়ে গেছি, আমাদের সবার হাতই নোংরা, আমাদের সকলের মুখেই চুনকালি। তাই জানি বুঝি যে সরকারি চাকুরির বেতন দিয়ে বা একটা অফিস পিওনের সংসার চালাতে যেখানে হিমশিম খাওয়ার কথা সেখানে নামে বেনামে কিভাবে এনারা অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়ে যায়? তার কি আত্মীয়পরিজন কেউ প্রশ্ন করেন এই আলাদীনের চেরাগের কি রহস্য? না করেন না, পিছনে টুকটাক বদনাম করলেও সামনে হাত কচলে নোংরা আয়ের কিছুটা ভাগীদার হতে পিছপা হন না। আমরা সবাই জানি কেনো এখন জাতীয় সংসদ বা সব পর্যায়ের রাজনীতিতে আমলা ও ব্যবসায়ীদের রমরমা উত্থানের কারন। জানি কিন্তু চুপ করে থাকি, শুধুমাত্র নিজ স্বার্থ ক্ষুন্ন হলে একটু নড়ে চড়ে বসি! মিল্টনের স্ত্রীর মতো দেখেও না দেখার ভান করি! আসলে আমরা সবাই এ সমাজে দানব সৃষ্টির আসল কারিগর।
চলবে………………
পল্লব খন্দকার
দৈনিক আলোকবর্তিকা।
Leave a Reply