ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হবার বিষয়টি বেশ চমকপ্রদ! কতোভাবেই কতোজনেই নিজের পোস্টকে ভাইরাল অর্থাৎ অধিকসংখ্যক সামাজিক যোগাযোগ ব্যবহারকারীদের মধ্যে প্রচার করতে চেষ্টা চালিয়ে যায় সে বড় এক চক্কর বটে। ইউটিউবে বিকৃত সুরে গান গেয়ে, ভাড়ামিযুক্ত অভিনয় করে এক শ্রেণীর বিশেষ রুচির সামাজিক যোগাযোগ ব্যবহারকারীদের কাছে হিরো আলম তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। এমনকি হিরো আলম না পারলেও দৈনিন্দিন জীবনের নানাবিধ সমস্যা যথাযথ কতৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা ইতিবাচকভাবে ফেসবুকে লাইভ প্রচার করে খ্যাতির শীর্ষে উঠে মাননীয় সাংসদ পর্যন্ত নির্বাচিত হয়েছেন ব্যারিস্টার সুমন। এমনটিও শোনা যায় এসকল ভিডিও যতোবেশি প্রচারিত হয় সেই প্রচার সংখ্যার উপর ভিত্তি করে ডলারও আয় করে থাকেন অনেকে।
অতএব ভাইরাল হবার নেশায় নাচ গান বক্তৃতা থেকে শুরু করে ভয়াবহ বিকৃত উপাস্থপনা আমরা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখতে পাই। সঙ্গত কারনেই ন্যুড ছবি ও ভিডিও বা যৌন উত্তেজক দৃশ্যগুলো প্রচার করতে পারলে খুব সহজে ভিউ বৃদ্ধি করা যায়। তাই কোন বাছ-বিচার ছাড়াই ভাইরাল দুনিয়ার নেশায় ছেলে বুড়ো সকলে এক ফ্যান্টাসি জগতে নিজেদের সমর্পন করেছেন। এই দুনিয়ার অংশীদার শুধুই যারা প্রচার করছেন তারাই নন বরং যারা এসব দেখছেন, শেয়ার করছেন, মন্তব্য লিখছেন তারাও সমানভাবে দায়ী। একটা সময় আমরা নতুন গানের অডিও কিনতে গানের স্টুডিওতে সিডি বা ক্যাসেট কিনতে যেতাম। এখন গানগুলো রিলিজই হয় ইউটিউবের মতো বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আমার একজন গীতিকার বন্ধু লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে নামকরা শিল্পীগণকে নিয়ে অনেক উঁচুমানের গানের ভিডিও করছেন। তিনি কতভাবেই না চেষ্টা করেন একটু ভিউ বাড়াবার, হয়তো ভাইরাল হবার! কিন্তু কপালে সেটি কিছুতেই জোটে না, অথচ দেখেছি কতনা অখ্যাত শিল্পীর কন্ঠে নিম্নমানের যা তা গানের লক্ষ লক্ষ ভিউ।
এই ভাইরাল যুগের নেশায় ছুটে চলা প্রজন্মের কাছে আপনি ইচ্ছে করলেই সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুতর সমস্যার ব্যাপারে কোন প্রতিক্রিয়া আশা করতে পারেন না। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিই হোক লাফিয়ে লাফিয়ে অথবা ব্যাংক শুদ্ধই লুট হয়ে যাক এতে কারো কিছুই এসে যায় না। আমি সত্যিই আশ্চর্য হয়েছিলাম ২০১৮ সালে রাজধানী ঢাকায় স্কুল শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের দাবীতে আন্দোলনে সরস্ফূর্তভাবে অংশ নিতে দেখে। তথাকথিত হেলমেট বাহিনীর নগ্ন ও দানবীয় আগ্রাসনের মুখেও সুশৃঙ্খলভাবে প্রকৃত দাবিগুলো নিয়েই দুই তিনদিন রাস্তায় ছিলো বাচ্চাগুলো। ওদের আন্দোলনের পরিপক্কতা ও স্লোগানের অভিনবতা দেখে রীতিমত চমকে গিয়েছিলাম! আসলে গণ-আন্দোলন বলে কয়ে হয় না, যেমন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরালও বলে কয়ে হয় না।
সেকারনেই আমাদের জনদরদি শাসক শ্রেণী সবসময় যেকোন ছোটখাট আন্দোলনকেও ভয়ের চোখে দেখেন। আমাদের মনে আছে দিনাজপুরে ইয়াসমিনকে পুলিশের যৌন নির্যাতন ও হত্যার ঘটনায় হঠাৎ করেই বিচারের দাবীতে আঞ্চলিক গণআন্দোলন সৃষ্টি হয়েছিলো? তাই কোথায় যে আন্দোলনের বারুদ জমে আছে সেই গ্যারান্টি দেয়া যায় না বলেই এই উপমহাদেশের শাসকেরা জনগনকে বিশ্বাস করেন না, জনগনের উপর নূন্যতম আস্থাও নেই তাঁদের। শুধুমাত্র রাস্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের সুবিধার জন্য যে সকল সূত্র প্রয়োগ করতে হয় সেগুলো নিখুঁতভাবে করতে চান। এই যেমন জনদরদি সাজার অভিনয়, চটকদার আসর বা সমাবেশ মাতানো মেঠো বক্তৃতা, টিভি মিডিয়াতে ইদানিংকালের টক শো। কয়েকজন তো টক শো করে বিখ্যাত হয়ে দেশের মন্ত্রী পর্যন্ত হয়ে গেছেন। তাই আর কি চাই দুটো রঙ মিশিয়ে মিথ্যে কথা বলা, নিখুঁত অভিনয়ে নিজেকে নাম্বার ওয়ান জনদরদি হিসেবে প্রমাণ করতে পারলেই তো বাজিমাত।
সম্প্রতি এক গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছে সুজন নামক একটি জাতীয় নাগরিক কল্যাণ সংস্থা। যদিও টিআইবি বা সুজন এর মতো সংস্থাগুলোর গবেষণার ফলাফল কখনোই ক্ষমতাসীন থাকাকালে কেউ স্বীকার করেন না। বেশ চিত্তাকর্ষক এই গবেষণার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে নিজেদের দেয়া সম্পদ বিবরণীতে উপজেলা চেয়ারম্যনদের সম্পদ বৃদ্ধির হার মাননীয় সংসদ সদস্যদের সম্পদ বৃদ্ধির হারের দ্বিগুণের থেকেও বেশি! বিরোধী দলে থাকাকালে একই তথ্য উপাত্ত শতভাগ সঠিক বলা যেমন একটি জাতীয় ব্যাধি ঠিক তেমনি ক্ষমতাসীন অবস্থায় সেই একই তথ্য উপাত্ত ও গবেষণার ফলাফল ভুয়া হয়ে যায়। এটাই আমাদের নিয়তি, এগুলোকেই বলে দানব চরিত্র! পুরোপুরিই এক মিথ্যা ও ছল চাতুরীতে পারদর্শী প্রতারক নেতৃত্বের কবলে জিম্মি হয়ে এক অকল্যানকর রাষ্ট্রের নিষ্পেষিত আমজনতা হিসেবে আমাদের মতো দূর্ভাগা দেশ কমই আছে পৃথিবীতে।
সাংসদ ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমনকে আমি দীর্ঘদিন ধরেই ফেসবুকে ফলো করি। বিভিন্ন সমস্যা ও অসঙ্গতি নিয়ে ফেসবুক লাইভে তাঁর আন্তরিক উপস্থাপনা ভালো লাগে, আশাবাদী করে তোলে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার কিছু বিরল প্রজাতির মানুষ যে এখনো বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডে জীবিত আছেন তা দেখে অনুপ্রাণিত হতে হয়। কিন্তু খেয়াল করেছি তিনি একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের গোঁড়া সমর্থক বিধায় অন্য একটি রাজনৈতিক দলের গোঁড়া সমর্থকেরা এসব লাইভ ভিডিওতে নেতিবাচক মন্তব্য করে থাকেন। এটাই আর এক দানব রাজনৈতিক সাংস্কৃতি আমাদের দেশের জনগণের। আমি যে দলের সমর্থক সেই দলের লক্ষ কোটি অন্যায়ও না দেখার ভান করে পাশ কাঁটিয়ে যাই বেহায়ার মতো। আমি যে দলের বিরোধী তাঁদের ভালো কাজগুলোকেও স্বীকার না করে তীব্র আক্রমনাত্মক সমালোচনায় লিপ্ত হয়ে ঝগড়া বিবাদে জড়িয়ে পড়তে দ্বিধা করি না।
চলবে —————–
পল্লব খন্দকার
দৈনিক আলোকবর্তিকা।