গত ১৬ মে ২০২৪ দৈনিক প্রথম আলোর অনলাইন নিউজে ড. আমিনুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি এর "দেশে 'ভালো মানুষের' সংখ্যা এত বেশি কেন" শিরোনামের লেখাটিতে চোখ আঁটকে গেলো। তিনি নিজের লেখার শেষে যে উত্তরটা দিয়েছেন সেটি নিচে তুলে ধরলাম-
"উত্তরটা খুব সহজ। উন্নত দেশগুলোয় তো এত সমাজসেবক দেখা যায় না। এর কারণ, রাষ্ট্রই মানুষ ও সমাজের সেবা করে। আপনি অসুস্থ হলে রাষ্ট্র আপনার দেখভাল করবে। আপনি অসহায় হলে রাষ্ট্র আপনাকে আশ্রয় দেবে। আপনার যদি খাদ্য কিংবা বস্ত্রের অভাব থাকে, রাষ্ট্রই এর ব্যবস্থা করবে। জনগণের ট্যাক্সের টাকা রাষ্ট্র এসব কাজে ব্যয় করে। আর আমাদের দেশে কী হয়?
দুর্নীতির কারণে সাধারণ মানুষ এসব সেবা থেকে বঞ্চিত। আর সেই সুযোগে কিছু মানুষ সমাজসেবক বনে যায় মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে। তখন সাধারণ মানুষ তাদের সাধু ভাবতে শুরু করে। এরপর খুব সহজেই এসব মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে বাস্তব জীবনে অনৈতিক কাজ করে বেড়ানোও যায়।"
আমার কর্মজীবনের প্রায় এক যুগ কেটেছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কয়েকটি বেসরকারি সংস্থায় বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে। বেসরকারি সংস্থাগুলোকে আমাদের দেশে এনজিও হিসেবে জানেন সাধারণ মানুষ, আরও সহজ করে বললে কিস্তির লোক! এখানে কিস্তির মানে হচ্ছে দরিদ্রদের বিনা জামানতে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী যে সংস্থাগুলো সাপ্তাহিক কিস্তি আদায় করে থাকে। এই ক্ষুদ্রঋণ প্রদান ও আদায়ের পদ্ধতিটি আমাদের দেশে ব্যাপকহারে প্রচলিত হয়ে গেলেও ক্ষুদ্রঋণ যাদের (অধিকতর স্বচ্ছল ব্যক্তি বা পরিবারের সদস্যগণ) গ্রহণ করার প্রয়োজন পড়ে না ও ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত জনগণ এখনো পর্যন্ত এটিকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেননি।
সেই নব্বইয়ের দশকেও যেমনটি দেখেছি আজ তিন দশকেরও বেশি পার হয়ে গেলেও ক্ষুদ্রঋণের সমালোচকদের সমালোচনার ভাষার কোন পরিবর্তন হতে দেখিনি। খোদ সরকারী প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অঙ্গ সংস্থা মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির বেঁধে দেয়া সুদের হার মেনে সংস্থাগুলোর ঋণ কার্যক্রম পরিচালিত হলেও সয়ং সরকার প্রধান, মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এই ব্যবসায়ের সাথে সম্পৃক্ত সংস্থা বা ব্যক্তিদের সুদখোর বলে গালাগাল করে থাকেন! তাহলে বাংলাদেশের প্রচলিত তফসিলি ব্যাংকগুলো কি সুদের কারবার করছে না? আমার কাছে এই অদ্ভূত সমালোচনাকে নিতান্তই হাস্যকর মনে হয়। এদেশের সরকার বিদেশ থেকে লক্ষ কোটি টাকা ঋণ করে দেশের অধিকাংশ উন্নয়নমূলক কাজগুলো করে থাকে এবং প্রত্যেক বছর চড়া সুদসহ সেসব ঋণের টাকা বিদেশীদের ফেরত দিতে হয় সয়ং সরকারকে। যে কারনে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে ডলার না থাকলে সবাই অস্থির হয়ে যায়, শ্রীলংকার মতো দেউলিয়া হয়ে যাবার আতঙ্ক কাজ করে আমাদের মাঝে।
আমরা সবাই বিরাট মুসলিম, ইসলাম আমদের প্রাণের ধর্ম। আমরা জানি সুদ ঘুষ ইসলামে হারাম, মসজিদে মসজিদে ইমাম সাহেবদের নিয়মিত বয়ান, ওয়াজ মাহফিলে হুজুরদের তীব্র হুশিয়ারী স্বত্বেও সুদ ঘুষ আমাদের বাংলাদেশে ওপেন সিক্রেট! তাহলে কেনো আমাদের এই বিপরীতমুখী আচরণ? আসুন দেখে নিই একটি গবেষণার ফলাফল, যদিও এটি ফেসবুক পাতা থেকে সংগৃহীত, কিন্তু আমার কাছে খুবই প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে মুসলিম হিসেবে আল্লাহ ও রাসুলের নির্দেশিত পথের বিপরীত আমাদের কর্মকান্ডের আসল চিত্র এখানে ফুটে উঠেছে বলে।
আমরা মুসলমান কি করছি, কোনদিকে যাচ্ছি....
ইসলামিক দেশগুলি কতখানি ইসলামিক এই নিয়ে গবেষণা করেন জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হুসেন আসকারী। ইসলাম ধর্মে রাষ্ট্র ও সমাজ চলার যে বিধান দেয়া হয়েছে তা যে দেশগুলি প্রতিদিনের জীবনে মেনে চলে তা খুঁজতে যেয়ে দেখা গেলো,-- যারা সত্যিকার ভাবে ইসলামিক বিধানে চলে তারা কেউ বিশ্বাসী মুসলিম দেশ নয়।
স্টাডিতে দেখা গেছে সবচেয়ে ইসলামিক বিধান মেনে চলা দেশ হচ্ছে নিউজিল্যান্ড এবং দ্বিতীয় অবস্থানে লুক্সেমবার্গ। তারপর এসেছে পর্য্যায়ক্রমে আয়ারল্যান্ড, আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক ষষ্ঠ ও কানাডা সপ্তম অবস্থানে। মালয়েশিয়া ৩৮তম, কুয়েত ৪৮তম, বাহরাইন ৬৪তম, এবং অবাক করা কান্ড সৌদি আরব ১৩১তম অবস্থানে। গ্লোবাল ইকোনমি জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণায় বাংলাদেশের অবস্থান সৌদিদেরও নীচে। গবেষণায় দেখা গেছে, মুসলমানরা নামাজ, রোজা, সুন্নাহ, কোরআন, হাদিস, হিজাব, দাড়ি, লেবাস নিয়ে অতি সতর্ক কিন্তু রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পেশাগত জীবনে ইসলামের আইন মেনে চলেনা।
মুসলমানরা পৃথিবীর সবার চেয়ে বেশি ধর্মীয় বয়ান,ওয়াজ নসিহত শোনে কিন্তু কোন মুসলিম দেশ পৃথিবীর সেরা রাষ্ট্র হতে পারেনি। অথচ গত ষাট বছরে মুসলমানরা অন্ততঃ ৩০০০ বার জুমার খুতবা শুনেছে।
একজন বিধর্মী চাইনিজ ব্যবসায়ী বলেছেন, মুসলমান ব্যবসায়ীরা আমাদের কাছে এসে দুই নম্বর নকল জিনিষ বানানোর অর্ডার দিয়ে বলে, অমুক বিখ্যাত কোম্পানির লেবেল লাগাবেন। পরে যখন তাদেরকে বলি আমাদের সাথে খানা খান, তখন তাঁরা বলেন, হালাল না, তাই খাবোনা। তাহলে নকল মাল বিক্রি করা কি হালাল?
একজন জাপানি নব্য মুসলিম বলেছেন, আমি পশ্চিমা দেশগুলিতে অমুসলিমদের ইসলামের বিধান পালন করতে দেখি, আর পূর্বের দেশগুলিতে ইসলাম দেখি কিন্তু কোন মুসলিম দেখিনা। আলহামদুলিল্লাহ, আমি আগেই ইসলাম এবং মুসলমানদের পার্থক্য বুঝেই আল্লাহর ধর্ম গ্রহন করেছি।
ইসলাম ধর্ম শুধু নামাজ রোজা নয়, এটি একটি জীবন বিধান এবং অন্যের সাথে মোয়ামালাত আর মোয়াশারাতের বিষয়। একজন নামাজ রোজা পড়া আর কপালে দাগওয়ালা মানুষও আল্লাহর চোখে একজন মোনাফেক হতে পারে।
নবী (সঃ) বলেছেন, "আসল সর্বহারা আর রিক্ত মানুষ হচ্ছে তারা, যারা কেয়ামতের দিন রোজা, নামাজ, অনেক হজ্জ্ব, দান খয়রাত নিয়ে হাজির হবে কিন্তু দুর্নীতি করে সম্পদ দখল, অন্যদের হক না দেয়া, মানুষের উপর অত্যাচারের কারণে রিক্ত হস্তে জাহান্নামে যাবে।"
ইসলামের দুটি অংশ, একটি হচ্ছে বিশ্বাসের প্রকাশ্য ঘোষণা যাকে 'ঈমান' বলা হয়, আর একটি হচ্ছে বিশ্বাসের অন্তর্গত বিষয় যাকে 'এহসান' বলা হয়,-- যা ন্যায়গতভাবে সঠিক সামাজিক নিয়ম কানুন মেনে চলার মাধ্যমে বাস্তবায়ন হয়। দুটোকে একত্রে প্র্যাকটিস না করলে ইসলাম অসম্পূর্ন থেকে যায় যা প্রতিটি নামের মুসলমান দেশে হচ্ছে।
ধর্মীয় বিধি নিষেধ মানা যার যার ব্যক্তিগত দায়িত্বের মধ্যে পড়ে এবং এটি আল্লাহ ও বান্দার মধ্যকার বিষয়। কিন্তু সামাজিক বিধি নিষেধ মেনে চলা একজন বান্দার সাথে অন্য বান্দার মধ্যকার বিষয়। অন্য কথায় ইসলামিক নীতিমালা যদি মুসলমানরা নিজেদের জীবনে ব্যবহারিক প্রয়োগ না করে, মুসলিম সমাজ দুর্নীতিতে ছেয়ে যাবে এবং আমাদের ভবিষ্যৎ হবে অসম্মানজনক।
লর্ড বার্নার্ড' শ একবার বলেছিলেন, "ইসলাম হচ্ছে শ্রেষ্ঠ ধর্ম এবং মুসলমানরা হচ্ছে সর্ব নিকৃষ্ট অনুসারী।"
(সংগৃহীত)
নব্বই ভাগ মুসলিম জনগোষ্ঠী অধ্যূষিত আমাদের দেশের দানব সমাজ তৈরির প্রেক্ষাপট কিভাবে কতশত বছর ধরে ক্রমবিস্তার ঘটেছে সেই প্রকৃত বিশ্লেষণ আমার মতো স্বল্প মেধাবী মানুষের দ্বারা সম্ভবপর নয় এই কথা সবিনয়ে স্বীকার করে নিচ্ছি। তবে আমার জন্ম বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরবর্তী বছরে বিধায় আমার পারিপার্শিক জ্ঞানের বিস্তার যদি ধরি নব্বই দশকের শুরুর দিকে তাহলে গত পয়ত্রিশ বছরের সমাজ ব্যবস্থা কিঞ্চিৎ হলেও বিশ্লেষণ করার যোগ্যতা আছে তা জোর দিয়ে বলতে পারি। সেই কৈশোরে গ্রামের পরিবেশেই দেখেছি একপাশে ওয়াজ মাহফিলে হুজুরের বয়ান চলছে নর-নারীর সম্পর্ক, ব্যাভিচারের কবীরা গোনাহ ও কাল কেয়ামতের দিন কঠোর শাস্তি নিয়ে তখন দেখেছি পাড়ার দুই অবিবাহিত যুবক যুবতি ওয়াজ শোনার নাম নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে এসে ওয়াজ মাহফিলের অন্ধকার কোনায় অনৈতিক শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে!
আমাদের দেশের দানব চরিত্রের মানুষদের ধর্ম চর্চাটা পুরোপুরিই এক লেবাসের অংশ। দূর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা যারা প্রকৃত ধর্মভিরু এবং শুদ্ধ চর্চার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য পেতে চাই তারা অশুদ্ধ চর্চাকারীদের নোংরা কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করি না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে টাকাওয়ালা নীতিনৈতিকতাহীন এসব দানবীয় চরিত্র সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করি। যদিও জানি মানুষটি চরম দুর্নিতীবাজ, হয়তো খুনের মামলায় অভিযুক্ত, নারী নির্যাতনকারী, মাদক কারবারী, আধিপত্যবাদী, সন্ত্রাসী তবুও তাকে এলাকার মেম্বার চেয়ারম্যান বা সাংসদ বানাই, হুজুর হুজুর করি। খুব সঙ্গতভাবেই আমাদের সেই সকল মহান নেতারা প্রতিনিয়ত আড়ালে অথবা প্রকাশ্যে নিজেদের নোংরা কর্মকান্ড অব্যাহত রাখতে সাহস পায়, ধীরে ধীরে দানব থেকে মহাদানব হিসেবে আভির্ভূত হয়। আমার খুব সাধারণ বিশ্লেষণ হলো ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার ক্ষেত্রে আমরা অতি সুবিধাবাদী, নিজের স্বার্থের পক্ষে যা যা যায় সেগুলোই দানবেরা জায়েজ করে নেয় সরল ধর্মভিরুদের চোখে ধুলো দিয়ে।
চলবে —————–
পল্লব খন্দকার
দৈনিক আলোকবর্তিকা।