বেশ দীর্ঘ বিরতি। কিছুটা ব্যক্তিগত জীবনের দোলাচল, অল্প বিস্তর হতাশা, কিঞ্চিৎ বিরক্তির কারনে দৈনিক আলোকবর্তিকায় ফিচার লিখছিলাম না গত চার মাস যাবত। প্রায় একবছর ধরে একটা স্বেচ্ছাসেবক লেখক টীম গঠন করতে না পারার হতাশা থেকে শিখলাম যে গুড় বা চিনি ব্যবহার না করে পিঁপড়ার আগমন আশা করা বৃথা! তবুও কৃতজ্ঞতা জানাই একটানা সাত আট মাস যারা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে লেখা দিয়ে আমাকে উৎসাহিত করেছেন। আমি তাঁদের লেখাগুলো যত্ন সহকারে দৈনিক আলোকবর্তিকায় প্রকাশের ব্যবস্থা করেছি। কোন কোন লেখার ভিউ এক হাজারও ছাড়িয়ে গেছে, এ এক বিশাল প্রাপ্তি। যারা লেখেন, বিশেষ করে পেশাদার নন তাঁদের নিজের লেখা যেকোন মাধ্যমে দেখতে কিন্তু পছন্দ করেন। তাঁদের কেউ কেউ লেখা পাঠাতে আগ্রহী হন কিন্তু নিয়মিত লেখার দায়বদ্ধতা সেখানে তৈরি হওয়া সম্ভব না। সেজন্য প্রয়োজন সামান্য কিছু হলেও প্রণোদনা, ফ্রি ল্যান্সার লেখকগণ যেমন কোন নির্দিষ্ট পত্রিকার নিয়োগপ্রাপ্ত হন না, কিন্তু ধারাবাহিক লেখা দেন কিছু একটা সম্মানী পাবার কারনেই।
দৈনিক আলোকবর্তিকা পত্রিকাটির নিয়মিত প্রকাশনার একটা ট্রায়াল করছিলাম ২০২৩ সালের এপ্রিল মাস থেকে। কিছু পরিচিত এবং স্বল্প পরিচিত অপেশাদার লেখকদের উৎসাহ দিয়ে লেখা সংগ্রহ ও প্রকাশনার কার্যক্রম চলছিলো কিছুটা স্লথ গতিতে। আসলে একটি পূর্নাংগ অনলাইন পত্রিকা নিয়মিত প্রচারের জন্য কমপক্ষে তিন চারজনের একটা পেশাদার টীম থাকা আবশ্যক। পেশাদার জনবলকে তো আর বিনা পারিশ্রমিকে কোন কাজে নিয়োজিত করা যায় না, তাই চাই নূন্যতম চাহিদা মেটাবার রসদ। এই শিক্ষাটি পাবার ব্যাপারে আগেই প্রস্তুতি ছিলো, তবুও কিছুটা চেষ্টা করেছিলাম শখের বশে লেখকদের একটা প্লাটফরম তৈরি করে পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশের মাধ্যমে কিছু বিজ্ঞাপন যোগাড় করে সচল রাখার। কিন্তু অত্যন্ত সঙ্গত কারনেই এখানে নিয়মিত লিখিয়েগণ আর লেখার উৎসাহ পাচ্ছিলেন না। তাই কিছুটা বিরতি নিলাম, এবার একটা পেশাদার টীম নিয়েই মাঠে নামার আশা রইলো। সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় থাকার পাশাপাশি নিজের আত্মভাবনার জগতের দুই একটি লেখা প্রকাশ করার ইচ্ছেতেই আজ এই লেখার পুনরারম্ভ করছি।
চার মাস বাদে আজকের সম্পাদকীয়র শিরোনামটি নেতিবাচক অর্থে দেখা যাচ্ছে যা দৈনিক আলোকবর্তিকার মূল দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচকতার সাথে সাংঘর্ষিক। কিন্তু এমন একটি রাষ্ট্রীয় ও সমাজ ব্যবস্থায় আমরা নিপতিত হয়েছি যে ইতিবাচক বিষয়গুলো অণুবীক্ষণ দিয়েও খুঁজে পাওয়া ভার অথচ সকল নেতিবাচক বিষয়গুলো চোখ বন্ধ করে রাখতে চাইলেও ঘাড়ের উপর এসে নাচানাচি করতে থাকে। সে বিষয়গুলো এড়িয়েও যাওয়া সম্ভব না আবার গিলে ফেলাও অসম্ভব! সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুকে আমরা মানবিক কার্যক্রমে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সহযোগিতা চেয়ে পোস্ট দেখি। পরিচিত অপরিচিত অনেককে পোস্ট করতে দেখে মানবিক বিবেচনায় আমরা সাধ্যমতো সহযোগিতা করেও থাকি। যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা চাওয়া পোস্টগুলো বেশি আবেদন তৈরি করতে পারে তারা বা তাঁদের প্রতিষ্ঠান ততো বেশি অর্থ সংগ্রহ করতে সমর্থ হন। আমি নিজেও অনেক বিপদ্গ্রস্থ মানুষের জন্য অনুদান চেয়ে পোস্ট দিয়েছি ফেসবুকে। অনেক মানুষের কাছ থেকে সহায়তা পেয়ে বিপদাপন্ন মানুষটিকে সেই অর্থ প্রদান করেছি। এমন মানবিক কার্যক্রম আমাদের সমাজের সুস্থ একটি দিকের পরিচয় বহন করে, তাই এই বিষয়টিকে আমার কাছে কখনো অন্যায্য মনে হয়নি।
ঢাকার রাস্তায় ঘুমানো মানুষদের দূর্দশা নিয়ে এর আগে আমি লিখেছি, ভাসমান মানুষদের আশ্রয় দিতে না পারার চরম রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা নিয়ে সমালোচনা করেছি। আশ্রয়হীন মানুষদের নিয়ে গভীর এই সমস্যাটির সমাধানের ব্যাপারেও কিছু চিন্তা ভাবনা প্রকাশ করেছি। স্বভাবতই এসব বয়স্ক, মানসিক ভারসম্যহীন দরিদ্র ভাসমান মানুষদের পূনর্বাসনের জন্য আমার মতো অনেকের ভেতরই একধরনের আকাঙ্ক্ষা কাজ করে। তাই কথিত মানবতার ফেরিওয়ালা মিল্টন সমাদ্দারের ফেসবুক পোস্টে অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, প্রতিবন্ধী মানুষ ও অটিজম আক্রান্ত শিশুদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা, চিকিৎসা ইত্যাদি পূনর্বাসন কার্যক্রম নিয়ে আবেগী কথাবার্তা আমার মতো অনেককেই নাড়া দিয়েছে। সমগ্র দেশের সংবেদনশীল মানুষ যথাসাধ্য সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে মিল্টনের এই মহতী কার্যক্রমে শরিক হতে। কারন আমরা মুখে আহ-উহ করলেও রাস্তার ধারে পড়ে থাকা অসহায় দুস্থ মানুষদের দুই পাঁচ টাকা ভিক্ষা দিয়ে দায়িত্ব সম্পন্ন করে থাকি। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে, একজন মানুষ হিসেবে দূর্দশাগ্রস্থ এসব মানুষকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে পরিচর্যা করার কথা কিন্তু ভাবি না।
মিল্টন সমাদ্দার সাধারণ মানুষের এই আবেগকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কাজে লাগিয়েছে সেটি ফেসবুকে প্রায় দুই কোটি ফলোয়ার দেখেই বোঝা যায়। এই দুই কোটি ফলোয়ার গড়ে একশত টাকা সহযোগিতা করে থাকলে তার পরিমাণ দুইশত কোটি টাকা! অনুমান না করে বাস্তবতাও যদি দেখি শুধুমাত্র চাইল্ড এন্ড ওল্ড এজ কেয়ার এর একাউন্টে দেড় কোটি টাকা অবশিষ্ট রয়েছে। এর বাইরে অনেকগুলো মোবাইল নাম্বারের মাধ্যমেও অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে যার পরিমাণ নির্ধারণ করা দুরূহ। ইতিমধ্যে চাইল্ড এন্ড ওল্ড এজ কেয়ার এর নিজস্ব জমিতে সাভারে বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তুলেছে, গত মার্চ মাসে সেটির উদ্বোধন করা হয়েছে। মিল্টন সমাদ্দারকে ফেসবুকে নিয়মিত ফলো করি বিধায় আমারও ইচ্ছে ছিলো প্রতিষ্ঠানটি একবার ঘুরে দেখে আসার। কিন্তু সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় সমাদ্দারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ ওঠা, থানায় মামলা হওয়া এবং সর্বশেষ গ্রেফতার, আইন আদালত পর্যন্ত গড়ানো এবং ডিবি পুলিশ কতৃক স্বীকারোক্তি বিষয়ে কিছু ভয়ঙ্কর তথ্য প্রদান আমাকে রীতিমতো হতভম্ব ও বাকহীন করে তুলেছে। বিশেষত অটিজম আক্রান্ত অবুঝ ফেরেশতাতুল্য বাচ্চাদের উপর ভয়ঙ্কর নির্যাতনের বর্ণনা আমি কিছুতেই নিতে পারছি না।
চলবে..................
পল্লব খন্দকার
দৈনিক আলোকবর্তিকা।