আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে চলমান ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০২৩ যারা নিয়মিত দেখছেন এইবার গ্রুপ পর্বে অস্ট্রেলিয়া বনাম আফগানিস্থানের খেলায় গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের ইনিংসটির কথা বহুদিন সবার মনে থাকবে। একই সাথে তাঁকে সঙ্গ দেয়া প্যাট কামিন্সের জুটির কথাও ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। অন্যদিকে প্রথম সেমিফাইনালে ভারত বনাম নিউজিল্যান্ডের খেলায় মরা পিচে প্রাণ সঞ্চার করে ভারতীয় ফাস্ট বোলার মোহাম্মদ সামির সাত উইকেট শিকারের স্মৃতিও ক্রিকেট ভক্তদের মনে দাগ কাটবে দীর্ঘদিন যাবত। তবে দুটি ঘটনার সাথেই আমরা আমাদের দাম্পত্য জীবনকে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করতে পারি! ব্যাপারটা ভেবেই অনেকে ভ্রু কুঁচকাতে পারেন কিন্তু ম্যাক্সওয়েল ও সামির দুটি অতিমানবীয় পারফর্মেন্স দেখে আমি বেশ কয়েকদিন ধরে এমন বেরসিক চিন্তাটা লালন করছি।
প্রেমের বিয়ের কথা বাদ দিয়ে আমরা যদি অভিভাবকদের ইচ্ছে অনুযায়ী আয়োজিত বিয়ের কথা ভাবি সেক্ষেত্রেও নব দম্পতির দাম্পত্য জীবন ভবিষ্যতে কেমন হবে তা কি কেউ বলতে পারি? আমার পঞ্চাশ বছরের জীবনের বিশ্লেষণ হচ্ছে আপনি কোন পক্ষেই যুক্তি দিয়ে যথার্থ বলতে পারবেন না। সেই অর্থে প্রেমের বিয়ের পর দাম্পত্য জীবন অস্থিতিশীল হলে অন্তত অভিভাবক হিসেবে আপনি বলতে পারবেন- কি বলেছিলাম না, আমাদের কথা তো তখন কানে তুল্লে না? যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি বিয়ের সম্পর্কে জড়ানোর পর যাদের বিবাহকাল দীর্ঘস্থায়ী হয় তাঁরা দাম্পত্য ইনিংসটাকে গড়ে তুলতে সফলতা দেখিয়েছেন। এই সফলতা দেখানো মোটেই চাট্টিখানি কথা নয়! তারমানে এই নয় যে দাম্পত্য জীবন দীর্ঘস্থায়ী হলেই তাঁরা সুখী দম্পতি, বরং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত চরম অসুখী অবস্থায় থেকেও অনেকে দাম্পত্য জীবন অক্ষত রাখেন।
দাম্পত্য নিয়ে কত শত ঘটনা ঘটে গেলো এই চোখের সামনে সেসব ভাবলেই এক মহাকাব্য রচনার ইচ্ছে জাগে। মানুষের মন বড় বিচিত্র, কেউ দাঁতে দাঁত চেপে সমস্ত প্রতিকূলতাকে সামলে নিয়ে বাউন্সার, ইন ও আউট সুইংগার, স্লোয়ার, গুগলি, কাঁটার ইত্যাদি বলের মুখোমখি হয়েও হাল ছাড়েন না, ক্রিজ কামড়ে পড়ে থাকেন। দাম্পত্য ইনিংসে ক্যাচ ওঠে, এলবিডব্লিউ আবেদন হয়, স্টাম্পিং, রান আউট এমনকি টাইমড আউটের মুখোমুখিও হতে হয়! রিভিউ নিয়ে অথবা সুক্ষ এক সুতোর ব্যবধানে আউট হওয়া থেকে বেঁচে গিয়ে জুটি অবিচ্ছিন্ন থেকে যায়। ম্যাচ জয়ের আশায় ইনিংসের শেষ বলটি পর্যন্ত খেলার আকাঙ্ক্ষায় জুটি গড়ে ওঠে। ক্রিকেটে যেমন আগেভাগে বলা যায় না কোন ব্যাটারের সাথে কোন ব্যাটারের জুটি দীর্ঘায়িত হবে তেমনটি দাম্পত্য ইনিংসও অনিশ্চিত। আমার দেখা সর্বসম্মত সেরা বর-বৌয়ের বিয়ের দাওয়াত খেয়ে আসা অনেকেরই সংসার টেকেনি বেশিদিন, সহজ বলে ক্যাচ তুলে জুটি ভেঙ্গে যেতে দেখেছি অনেকের! অবিশ্বাস্য হলেও চোখের সামনে অসংখ্য প্রেমের জুটিকে ভেঙ্গে যেতে দেখেছি শুধুমাত্র মান অভিমানের অপ্রয়োজনীয় দ্বন্দে।
তারমানে এই নয় যে আপনাকে আমি জুটি যেকোনভাবে টিকিয়ে রাখতেই হবে এই মন্ত্র শেখাচ্ছি, আসলে আমি শুধু টিকে যাওয়া দাম্পত্যগুলোর বিস্ময়কর সাফল্যের বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছি। একারনেই চলমান বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উপমাকে সামনে আনলাম, কেননা ম্যাক্সওয়েল কিভাবে পায়ের ক্রাম্প নিয়ে এক পায়ের উপর ভর দিয়ে প্রতিপক্ষের কোয়ালিটি বোলারদের বোলিংকে তছনছ করে জয় ছিনিয়ে এনেছেন তা আমরা চোখ ছানাবড়া করে দেখেছি! টিকে থাকার ইচ্ছে থাকলে, জয়ের নেশা অদম্য হলে আপনি কিছু জীবন পাবেনই, প্রতিপক্ষের হাত গলে কিছু ক্যাচ আপনাকে বাঁচিয়ে দেবেই। কিন্তু আমরা কি করি? অতীব সামান্য কারনেও নিজেদের জেদ বজায় রাখতে হুটহাট দাম্পত্য জীবন থেকে বের হয়ে আসি। সবথেকে কষ্টের হলো বাচ্চা হবার পর ডিভোর্স হয়ে যাওয়া, সেক্ষেত্রে বাচ্চাগুলো যে বড় হয় না বা একদম ধ্বংস হয়ে যায় তা নয়, কিন্তু তাদের উপর বড্ড বেশী মানসিক চাপ পড়ে যায়। সেই চাপ আবার সব বাচ্চা সমানভাবে সহ্য করতে সক্ষম হয় না, বাবা-মায়ের দ্বারা সৃষ্ট সংকটে কেউ কেউ সত্যিই পথহারা হয়ে যেতে পারে বা যায়। এটাই সবচেয়ে ভয়াবহ পরিণাম একটি দাম্পত্য জীবনের অকাল জুটি ভঙ্গের।
আমি যদি আমাকে দিয়ে দাম্পত্য জীবন বিশ্লেষণ করি তবে এক কথায় বলতে হয় আমার ও আমার স্ত্রীর ভালোলাগা, পছন্দ, মনোভাব, অভ্যাস, চিন্তাভাবনা, আচার-আচরণ, জীবনবোধ প্রায় শতভাগ অমিল! চমকে উঠলেন? একটু ভেবে দেখুন আপনাদের দুজনেরও তাই। আরে ভাই কোনকালেই দুজন মানুষের সবকিছুতে মিল থাকার সুযোগ নেই, আমি ঠিকই বলছি, চমকে যাবার মতো কিছু বলিনি। আপনি যদি তেমনটা মনে করেন, আপনাদের অধিকাংশ বিষয়ে মিল থাকবে আমি নিশ্চিত আপনার মানসিক সমস্যা আছে! আমি নিশ্চিত হয়েই বলছি আপনার মানসিক সমস্যার জন্য আজই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া উচিত। তাহলে দাম্পত্য ইনিংস কিভাবে দীর্ঘায়িত হয়? অবশ্যই কোরবানির মাধ্যমে, স্যাক্রিফাইসের কারনে। ঐসব ফালতু চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেন, পৃথিবীতে কেউ কারো মতো নয়, প্রত্যেকের চেহারা যেমন আলাদা, প্রতিটি মানুষের সত্ত্বাও সম্পূর্ণ আলাদা। খুব কম ক্ষেত্রে দুই একটি বৈশিষ্ট্য কাকতালীয়ভাবে মিলে গেলে সেটাই বরং অসামঞ্জস্যপূর্ণ!
আমি জানি অনেকেই আমার কথার পাল্টা শক্ত যুক্তি দাঁড় করাবেন, কিন্তু আমি নিশ্চিত আমার বিশ্লেষণে এক চুল ভুল নেই। আমরাই আমাদের মনের ভিতর কিছু ভ্রান্ত ছবি আঁকি, বিভ্রান্তির চোরাবালিতে দাঁড়িয়ে দাম্পত্যকে দীর্ঘায়িত করতে চাই। জেদ করি সে কেনো আমার মতো হবে না, তাঁকে আমার মতো হতেই হবে? নাহলে সমাধান খুব সহজ, ছাড়াছাড়ি, মারামারি, কাদা ছুড়াছুড়ি! অথচ প্রতিদিন মারামারি করেন এমন জুটিকেও আমি আমৃত্যু একসাথে ইনিংস গড়তে দেখেছি। একজন আরেকজনের সাথে এক বিছানায় ঘুমান না পনের কুড়ি বছর তবুও দাম্পত্য চালিয়ে যান। অনেকেই বলতে পারেন এমনটা কি সুস্থ সম্পর্কের পরিচায়ক? আমি স্পষ্টভাবে বলছি- ‘না’। কিন্তু আমার ফোকাসের জায়গাটা হচ্ছে এক অনমনীয় দৃড়তা নিয়ে ইনিংসের শেষ বল মোকাবিলা করবার এই শক্তিকে অবশ্যই বাহবা দিতে হবে। আমরা কে না জানি, এক ছাদের তলায় স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বাস করতে গেলে টক্কর লাগবেই, ঝগড়া, উচ্চবাচ্য, মতের অমিল এসবই খুব সাধারণ চিত্র। কিন্তু অসাধারণত্ব হলো সবকিছু ভুলে গিয়ে আবার হাতে হাত রাখা, হাসি ঠাট্টায় মেতে ওঠা, ইনিংসের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধির পাশাপাশি রানের চাকা সচল রাখা।
তবে হ্যাঁ, দম্পতিদের কেউ একজন যদি স্থায়ীভাবে প্রমানিত প্রতারক বা ভন্ড, প্রচন্ড মাত্রায় আগ্রাসী বা মারধোর করার প্রতি আসক্ত, মানুষকে মানুষ হিসেবে নূন্যতম সম্মান দিতে জানে না, সর্ববস্থায় নিজের জেদ বজায় রাখে, এক তিল পরিমাণ ত্যাগের মনোভাব নেই, ভয়ঙ্কর ক্রিমিনাল মানসিকতা সম্পন্ন তাহলে এমন কারো সঙ্গে দয়া করে কেউ একটি দিনের জন্যও জুটি গড়বার চেষ্টা করবেন না। দরকার হলে ইচ্ছে করে ক্যাচ তুলে দিয়ে বা বোল্ড হয়ে ক্রিজ থেকে বের হয়ে আসুন, কারন আত্মসম্মানের চেয়ে বড় কিছু আর হয় না। দাম্পত্যে দুজনের সাধারণ চারিত্রিক চরম গরমিলের মাঝেই যারা ত্যাগের প্রস্তুতি নিতে পারেন শুধু তাঁরাই লম্বা ইনিংস গড়তে পারবেন। ফেরাউন বা রাবনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যধারী কাউকে নিজের জীবনের সাথে জোর করে বেঁধে রাখার মত বিড়ম্বনা আর কিছু হয় না। কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়, আমরা নিজেদের বোঝার বা বোঝাবার যথেষ্ট সময় না দিয়েই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি বড্ড দ্রুত। আমাদের কল্পিত অবাস্তব দাম্পত্যের একদম কোন বিচ্যুতি সহ্য করতে পারি না। যাকে বলে ধরো তক্তা মারো পেরেক, একটু মতের অমিল, মনমালিন্য? ধরিয়ে দিই ডিভোর্স লেটার একখানা!
এই যেমন মোহাম্মদ সামির সাত উইকেট নেয়ার অতিমানবীয় ঘটনার পাশাপাশি আমরা যদি তাঁর দাম্পত্য জীবনের তুলনা করি, কি দেখতে পাই? ওঁরা আলাদা থাকেন, একটা বাচ্চা আছে, কোর্ট ফয়সালা করে দিয়েছেন সামি তাঁর স্ত্রী ও সন্তানের ভরণপোষণের জন্য প্রতি মাসে এক লক্ষ তিরিশ হাজার রুপি দেবেন। সামি যতোই দশ উইকেট পান না কেনো ওনার স্ত্রীর তাতে কিচ্ছু যায় আসে না, আমরা জানি না কি অসম্ভব কারনে এই বিচ্ছেদ? সামিকে কি মনে হয় লোকটা খুবই প্রতারক বা রাবন চরিত্রের অধিকারী? যে ব্যক্তি পারিবারিক জীবনের হতাশাকে জয় করে খেলার মাধ্যমে অসাধারণ বিনোদন দেন তিনি আর যাই হোক রাবন চরিত্রের হবার কথা নয়! তাই বলছিলাম সোজা হিসেবে বলার উপায় নেই দাম্পত্য ইনিংস কিভাবে টিকে থাকে, কোন জুটিই বা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। শুধু সারমর্মে বলা যায় দাম্পত্য ইনিংস গড়ে ওঠে দুটি মানুষের লক্ষ কোটি ত্যাগের বিনিময়ে প্রতিটি সেকেন্ড, প্রতিটি ঘন্টা আর যুগের পর যুগ অনন্য আপোষকামীতার চিরন্তন এক অলিখিত সূত্রের বিস্ময়কর জয়যাত্রায়।
পল্লব খন্দকার, ১৮ নভেম্বর ২০২৩।
Leave a Reply