খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার বেদকাশী ইউনিয়নের বেদকাশী কলেজিয়েট স্কুলের প্রিন্সিপাল জনাব আব্দুল মাজেদ সাহেব গত ১৭ বছরে কলেজ ও স্কুল শাখায় প্রায় ১৫ জন শিক্ষক ও কর্মচারি নিয়োগ দিয়েছেন প্রায় ১ কোটি টাকা অবৈধ ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে। ফলে তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ বিত্তের মালিক হয়েছেন। এব্যাপারে নিয়োগপ্রাপ্তরা কেউ মুখ খুলতে রাজি না হলেও উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আব্দুল মাজেদ সাহেবের ব্যাংক হিসাব তলব ও অন্যান্য তদন্ত করলে সকল প্রমাণ বেরিয়ে আসবে বলে এলাকাবাসীর ধারণা। এর স্বপক্ষে দুইজন অযোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগের ফিরিস্তিসহ ৪ টি ঘটনা তুলে ধরা হল-
গত ইংরেজি ১৯ আগস্ট, ২০২১ তারিখে বেদকাশী কলেজিয়েট স্কুলে কম্পিউটার ল্যাব এসিস্ট্যান্ট পদে জনাব আইয়ুব আলী নামক একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয় যে, শিক্ষাজীবনের এইচএসসি পরীক্ষায় কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি বিষয়সহ বিজ্ঞানবিভাগ থাকতে হবে অথবা বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড হতে কমপক্ষে ৩ বছরের ডিপ্লোমা থাকতে হবে । নিয়োগপ্রাপ্ত জনাব আইয়ুব আলীর শিক্ষাগত যোগ্যতা মিলিয়ে দেখা যায় যে, জনাব আইয়ুব আলী এইচএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে উত্তীর্ণ হলেও তার কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি সাবজেক্ট ছিল না। তার ৩ বছরের ডিপ্লোমাও নেই। নিয়োগপ্রাপ্ত উক্ত ব্যক্তি কম্পিউটারের ডাটাবেজ প্রোগ্রামিং এর ওপর ৩৬০ ঘন্টার একটা ট্রেনিং এ অংশ নিয়েছে বলে একটা সার্টিফিকেট জমা দিয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এই সার্টিফিকেটও শতভাগ ভুয়া।
এই অবৈধ নিয়োগপ্রাপ্ত জনাব আইয়ুব আলী পরবর্তীতে জনাব আব্দুল মাজেদের দুর্নীতির অন্যতম সহযোগী হয়ে ওঠেন। তিনি কম্পিউটার ল্যাব অপারেটর হয়েও খবরদারি করতে শুরু করেন শিক্ষকদের ওপর। স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগের পর্যাপ্ত শিক্ষক থাকা সত্ত্বেও প্রভাব খাটিয়ে নবম ও দশম শ্রেণির বিজ্ঞান শাখায় ক্লাস নেয়া শুরু করেন। পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে তার কাছে প্রাইভেট পড়া শিক্ষার্থীদের ভাল রেজাল্ট করানোর সাথে জড়িত হন এবং এই কাজের আর্থিক সুবিধাও জনাব আব্দুল মাজেদ নিতেন। এছাড়া ছাত্রীদের সাথে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার একাধিক অভিযোগ জনাব আইয়ুব আলীর বিরুদ্ধে পাওয়া যায়। এবিষয়ে আব্দুল মাজেদ সাহেবের কাছে শিক্ষকরা বার বার অভিযোগ করলেও তিনি আইয়ুব আলীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো শিক্ষকদের গালমন্দ করতেন। বিষয়টি আমি দেখছি বলে অভিভাবক ও সচেতন মহলকে শুধুই সান্ত্বনা দিতেন। স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাদের সাথে জনাব আব্দুল মাজেদের সখ্যতা থাকায় তাকে বেশি কিছু বলার সাহস করা যেত না, বরং নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক বলেন, তিনি উদ্ধত্য দেখিয়ে বলতেন আমার প্রতিষ্ঠান আমার ইচ্ছায় চলবে।
বেদকাশী কলেজিয়েট স্কুলটি সম্প্রতি এমপিও ভুক্ত হয়েছে। সেখানে জনাব মোস্তাফিজুর রহমান নামক একজন লেকচারার নিয়োগ পেয়েছেন যিনি এসএসসি পরীক্ষায় বেদকাশী কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৯৯-২০০০ শিক্ষাবর্ষে ফেল করেছিলেন। পরে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বারবার পরীক্ষা দিয়ে অবশেষে ২০০৩ সালে এসএসসি পাশ করেন। তিনি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় জালিয়াতি করে (বডি চেঞ্জের মাধ্যমে) অর্জন করেছেন বলে বুক ফুলিয়ে বলে বেড়াতেন। তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত থাকায় তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে চাইত না। জনাব মোস্তাফিজ কলেজ এমপিওভুক্ত হওয়ার পূর্বে একদিনও ক্লাস নেননি, শিক্ষকতার মত মহান পেশায় তার মিনিমাম যোগ্যতা তার নেই বরং তিনি ছিলেন কোরিয়ান একজন প্রবাসী শ্রমিক, তার পাসপোর্ট যাচাই করলে তা প্রমাণিত হবে। কলেজ এমপিও ভুক্ত হওয়ার ঘোষণা আসার পরই তিনি কোরিয়া থেকে ফিরে এসে আব্দুল মাজেদ সাহেবকে মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে কলেজে যোগদান করেন এবং কলেজের অদূরে রঞ্জন মার্কেটে তিনি একটা রুম ভাড়া নেন। যা মোস্তাফিজ স্যারের ডেরা নামে পরিচিত। সেখানে তারই ছাত্রদের সাথে মাদকের আখড়া বসানো, ক্যারাম খেলা, ধুমপান করা, ছাত্রদের সাথে একলাইনে দাঁড়িয়ে প্রসাব করা ইত্যাদি অশ্লীল কর্মকান্ডে জড়িত ছিল। এছাড়া তার বিরুদ্ধে প্রিন্সিপাল আব্দুল মাজেদ সাহেবের মদদে হাজিরা খাতায় অগ্রিম স্বাক্ষর করে রেখে কলেজ থেকে চলে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এছাড়া তার এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার জিপিএ ২.৫০। অথচ শিক্ষাজীবনে একের অধিক থার্ড ডিভিশন যোগ্যতার মাপকাঠিতে গ্রহণযোগ্য নয়। রাজনৈতিক প্রভাবে এসব কর্মকাণ্ড সে অকপটে চালিয়ে যেত। এদেরকে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদ করলে বাকি সব অবৈধ লেনদেনের খোঁজ পাওয়া যাবে।
এছাড়া জনাব আব্দুল মাজেদ বেদকাশী কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বিনোদনের জন্য উন্মুক্ত একমাত্র খেলার মাঠটি ২০১৯ সাল মোজাহার এন্টারপ্রাইজ নামক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কাছে কয়েকবছরের জন্য লিজ দিয়ে দেন যা ২০২৪ সালেও আংশিক দৃশ্যমান (বর্তমানে মাঠে নির্মাণ সামগ্রী রাখার আংশিক ছবি সংযুক্ত)। ফলে ছাত্র ছাত্রীরা খেলাধুলার মত আবশ্যক একটা অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ে। বিনোদনের অভাবে নানাবিধ অসামাজিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। জনাব আব্দুল মাজেদ মাঠ ভাড়ার টাকা বিদ্যালয়ে জমা দেয়ার ক্ষেত্রেও হিসাবে গড়মিল দেখান। বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থি মিজানুর রহমান সবুজ বলেন, ২০১৯ সালে মাঠভাড়ার চুক্তিপত্র দেখতে চাইলে তিনি তা দেখাতে অপারগতা প্রকাশ করেন এবং নিজের চৌর্যবৃত্তি লুকানোর চেষ্টা করেন।
জনাব আব্দুল মাজেদ সাহেবের নিজের শিক্ষাসনদগুলোও জাল বলে সন্দেহ করার কারণ আছে। তিনি বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সার্টিফিকেট শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমাণ হিসেবে হিসেবে দেখিয়েছেন প্রাথমিক তদন্তে অনলাইনে result.bou.ac.bd ওয়েবসাইটে সার্টিফিকেট যাচাই করে সেটি ভুয়া বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। যা অধিকতর তদন্তের দাবি রাখে। এছাড়া তিনি অভিজ্ঞতার সনদ জালিয়াতি করে প্রধান শিক্ষক হয়েছেন বলে জানা যায়। একারণে আবু ইছা গাজী নামের একজন অভিভাবক সদস্য আব্দুল মাজেদ সাহেবের নামে মামলা করেন পরবর্তীকালে অবৈধ লেনদেন করে সেই মামলা তুলে নেয়া হয়। অধিকতর তদন্ত করলে তার বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে।
প্রতিষ্ঠানের সাবেক শিক্ষার্থী ও স্থানীয় অভিভাবকদের দাবি- ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানে এভাবে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে যেসব অপকর্ম অতীতে হয়েছে তার সুষ্ঠু তদন্ত করে তাদের সবার অপসারণ ও আইনানুগ শাস্তি।
লেখা: মোঃ রবিউল ইসলাম।
সংকলন: দৈনিক আলোকবর্তিকা।