পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে একমাত্র ভরসাই ছিলো ফেরী, সেটি পারাপারের সময় ঝালমুড়ি আর সিদ্ধ ডিম না খেলে নাকি মনেই হয় না ফেরী ভ্রমণ করছি। একটি বড় ফেরীতে ৫-৬ জন ঝালমুড়িওয়ালা ও ৩-৪ জন সিদ্ধ ডিমওয়ালা সারা ফেরী ঘুরে ঘুরে, বাসের জানালায় দাঁড়িয়ে, কেউ কেউ বাসের ভিতরে উঠেও ঝালমুড়ি ও ডিম বিক্রি করে থাকে। আমিও একসময় ঐতিহ্য অনুযায়ী ফেরীতে উঠে ঝালমুড়ি কিনতাম, বড়ই রসনা পরিতৃপ্তিকারী খাদ্য এটি, খিদা পেলে তো অমৃত মনে হয়! কিন্তু ফেরীতে উঠে একসময় এই মজাদার খাদ্যটি আমি এড়িয়ে চলতাম, প্রথমত আমাকে একজন সচেতন করার জন্য বলেছিলো যারা ঝালমুড়ি বিক্রি করে তাদের বিভিন্ন উপকরণ যেমন কুচি করে কাটা কাঁচা মরিচ, পিঁয়াজ কুচি, সরিষার তেল, টমেটো স্লাইস, ধনিয়া পাতা, লেবু ইত্যাদি সরবরাহ করে আরেকটি দল যারা সব উপকরণ প্রক্রিয়া করে খুচরা বিক্রেতার কাছে পৌঁছে দেয়। এই তথ্য আমার আগে জানা ছিলো না, আমি ভাবতাম যারা খুচরা বিক্রেতা তারাই সব প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রি করে। তারমানে আরো কিছু হাত ঘুরে এই কাঁচা উপকরণগুলো খুচরা বিক্রেতার হাতে পৌঁছায় ফলে অবধারিতভাবে হাতবদলের সময় চান্স অফ কন্টামিনেশন বৃদ্ধি পায়। আমাকে যে এই তথ্য দিয়েছিলো সে আরো বলেছিলো যে, যারা এসব প্রক্রিয়া করে তারা খুবই অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে, অপরিষ্কার পাত্রের উপর রেখে নদীর ঘাটেই আশেপাশে বসে প্রস্তুত করে। এই তথ্য জানার পর আমি সতর্ক হয়ে যাই, বাংলাদেশের স্ট্রীট ফুড অত্যন্ত মজাদার মুখোরোচক হলেও কিছু গবেষনায় দেখা গেছে সেগুলো ভয়ংকর রকম ব্যাকটেরিয়াল লোড দ্বারা পরিপূর্ণ! ইকোলি, স্যালমোনেলার মত প্রাণঘাতী ব্যাকটেরিয়া থাকে হাজারে হাজার। তাই একসময় খাওয়া কমিয়ে দিই, খুব লোভ না লাগলে আর ধারে কাছে যেতাম না কারন ফেরীতে উঠে ঝালমুড়ির তীব্র সুগন্ধ নাকে আসতেই সেদিকে ছুটে যেতে ইচ্ছে করতো। তবে একদিন স্বচক্ষে আরেকটি দলের দুজনকে দেখলাম পরিত্যাক্ত পল্টূনের টয়লেটের দরজায় বসে নোংরা গামছার উপর ঝালমুড়ির কাঁচামালগুলো প্রক্রিয়াজাত করছে!
ফেরীঘাটে দেরী হবে এ তো আমরা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ মেনেই নিয়ে থাকতাম, ফেরীঘাট ফাঁকা থাকা, ঘাটে লম্বা যানজটে না দাঁড়িয়ে একটানে ফেরীতে ওঠা এসব ঘটনাকে আমরা মিরাকল বলে ধরে নিতাম এবং আল্লাহর নিকট অশেষ শুকরিয়া আদায় করতাম! ফেরীঘাটে এসে ফেরীতে ওঠার জন্য ৩-৪ ঘন্টা অপেক্ষা করাকে আমরা কালচারের অংশ হিসেবে ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু এই অপেক্ষা যদি ৬ ঘন্টা, ৯ ঘন্টা, ১২ ঘন্টা, ১৫ ঘন্টা হয়? কেমন লাগে মামা? যারা নিয়মিত ঢাকা হয়ে দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলে যাতায়াত করেছেন তারা এমন বিড়ম্বনায় একবার নয় বহুবার পড়েছেন। কি কি কারনে ফেরীঘাটে আটকে যেতে হতো? খুবই কমন। শীতকালে কুয়াশা, গ্রীষ্মকালে চর পড়ে নদীর নাব্যতা হারানো, বর্ষাকালে তীব্র ঢেউ বা স্রোতের তোড়ে ঘাটের পল্টূন ছিড়ে যাওয়া। অর্থাৎ সারা বছর কোন না কোন কারনে ঘাটে ৩ থেকে ১০ কিলোমিটার জ্যাম থাকতে পারে, এতে মনে কিছু করলে হবে না! এছাড়া দুই ঈদে আমরা পঙ্গপালের মতো উৎসব করতে করতে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে যাই, আবার গ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরে আসি। এসময় ১০-১২ ঘন্টা ঘাটে আটকে থাকাকে আমরা মামুলী হামজ্বর মনে করেছি! এই ফেরীঘাটের কষ্টে আমরা সত্যিই মজলুম জনতা হয়ে গেছিলাম। কত যে সন্তান বাবার অপেক্ষায় রাত জেগে জেগে ক্লান্ত হয়ে মনোকষ্টে ঘুমিয়ে পড়তো? কত বেচারা যে সময়মত চাকুরীর ভাইভায় অংশ নিতে পারে নাই? কত সহস্র মানুষ যে অফিসে সঠিক সময় পৌছাতে না পেরে বসের ঝাড়ি খেয়েছে বা চাকুরীটাই হারিয়েছে? কতজন অতি মূমূর্ষ রোগী যে এমবুলেন্সে শুয়েই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন? কতশত মানুষ যে আপন জনের জানাজায়ও অংশ নিতে পারেননি এই ফেরীঘাটের নির্মম জ্যামের কবলে নাস্তানাবুদ হয়ে! সেসবের হিসাব রয়ে গেছে নিরবে, লক্ষ কোটি মানুষের আক্ষেপ দীর্ঘশ্বাসের কাহিনী নিয়েই ছিলো আমাদের ফেরীঘাট । মাওয়াঘাটে লঞ্চ ডুবিতে কত সহস্র প্রাণ সংহার যে ঘটেছে দিনের পর দিন, শুনতে হয়েছে আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে?
ফেরীঘাটের দুঃস্বপ্ন থেকে রেহাই পেতে আমাদের কল্পনায় ভাসতো যে একদিন পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে আমাদের বহনকারী গতিশীল বাস বা ট্রেন ছুটবে গন্তব্যে, যার যখন সুবিধা সেই অনুযায়ী টিকিট কেটে রাত-বিরাতে রওনা হয়ে প্রত্যাশিত সময়ের সামান্য এদিক ওদিক ঘটিয়ে পৌঁছে যাবো প্রিয়জনের সান্নিধ্যে! মধুর সেই স্বপ্নগুলোকে একসময় দিবাস্বপ্ন ধরা হলেও আজকের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন নতুন দিনের হাতছানি দিচ্ছে আমাদের। এমন বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী হতে পেরে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা বেড়ে গেছে যেনো আরো কিছুদিন! কিন্তু কিভাবে? আমরা তো মরণপ্রবন জাতি, আমাদের প্রাণের মূল্য তুচ্ছ পিপিলিকার মতই এদেশের হর্তাকর্তাদের কাছে। বেঁচে থাকাই আমাদের কাছে মিরাকল, এক সেকেন্ডেরও তো ভরসা নেই, উত্তর-দক্ষিণ পূর্ব-পশ্চিম উর্ধ-অধো সবদিকে হায়েনার মত অপেক্ষা করছে সড়ক দূর্ঘটনা, গ্যাস বিস্ফোরণ, অগ্নিকান্ড, ভবন ধ্বস, নৌকা বা লঞ্চডুবি, সন্ত্রাসী, খুনখারাবি, ঘুষ, দূর্নীতি, মিথ্যাবাদিতা, অশিক্ষা আরো কতো যে মৃত্যুদূত? চারিপাশের বাতাসে টনকে টন অক্সিজেন রয়েছে, তবু কি আছে সেই অক্সিজেন বুক ভরে নেয়ার গ্যারান্টি?
পল্লব খন্দকার, ২৮ জুন ২০২৩।
mazhabkh93@gmail.com