মাওয়া ঘাটে স্পীডবোট পারাপারের অম্লমধুর অভিজ্ঞতাগুলো বর্ণনা করা ছাড়া পদ্মা সেতুহীন নদী পারাপারের গল্পগুলো শেষ করার সুযোগ নেই। আমি ভালো সাঁতার পারলেও ব্যক্তিগতভাবে পানিপথে চলাচলের ব্যাপারে কিছুটা ভীতু প্রকৃতির মানুষ তাই পারতপক্ষে লঞ্চ অথবা ফেরীর বাইরে মাওয়া ঘাট পারাপারের ঝুঁকি কখনো নিতে চাইনি। বিশেষতঃ ভরা বর্ষা মৌসুমে পদ্মার মাওয়া অংশে নদীর মূল ধারায় যে স্রোত এবং ঢেউ দেখতাম তা আমার কাছে ভীতিকরই মনে হতো! লঞ্চে বা ফেরীতে পার হওয়ার সময় দেখতাম যাত্রী ভরে নিয়ে স্পীডবোটগুলো দূরন্ত গতিতে পানি কেটে সাই সাই করে পার হয়ে যাচ্ছে। সেসব স্পীডবোটে নারী, শিশু, বৃদ্ধ মানুষেরাও যাত্রী হয়ে পার হয়ে যাচ্ছেন কোন ভয়ভীতি ছাড়াই! তবুও আমার কাছে কেনো জানি একদমই নিরাপদ মনে হতো না এই স্পীডবোট সার্ভিস, পারাপারে মাত্র ২০ মিনিট মতো লাগতো শুনতাম, সে হিসেবে সময় বাঁচাতে বেশ কার্যকরী ছিলো এই সার্ভিসটি। মাঝেমাঝেই স্পীডবোট উল্টে মানুষের ভোগান্তি, মুখোমুখি সংঘর্ষে মৃত্যু এবং যাত্রীবেষে প্রতারণা করে সর্বস্ব ছিনতাই করে নেয়ার খবর আসতো পত্রিকায়। উদ্বেগের এতো বেশি ব্যাপারস্যাপার জড়িত থাকা স্বত্বেও মাওয়া ঘাটে স্পীডবোট সার্ভিসের রমরমা ব্যবসা প্রচলিত ছিলো। অনেক লঞ্চ যাত্রীকে দেখেছি কিছুটা কম ভাড়ার লোভে ও দ্রুত পার হবার উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট ঘাট থেকে না উঠে লঞ্চের পাটাতন থেকে ঝুঁকি নিয়ে স্পীডবোটে চড়ে পার হতে।
ঐ যে বলে না প্রয়োজন কোন বাঁধা মানে না? আমি যেহেতু ঢাকা-খুলনা-যশোরের নিয়মিত সাপ্তাহিক যাত্রী ছিলাম সেহেতু জরুরী দাপ্তরিক প্রয়োজনে বেশ কয়েকবার স্পীডবোট করে নদী পার হতে বাধ্য হয়েছি। প্রথম দুয়েকবার পার হবার সময় পুরোটা সময় দোয়া দরূদ পড়তে পড়তে পার হতাম, একেকটা ঢেউ আসতো আর উছলে ওঠা পানির ঝাঁপটায় পিলে চমকে যেতো! দুই একজন চালক ছাড়া অধিকাংশই অপ্রাপ্তবয়স্ক, দেখে বোঝাই যেতো এদের স্পীডবোট চালনায় কোন প্রশিক্ষণ বা লাইসেন্স নেই। সাবধানে চালানোর অনুরোধ করলে এরা আরো বেপরোয়া হয়ে চালাতো, খুবই উগ্র টাইপের চেহারা, কাউকে কাউকে মনে হতো মাদকাসক্ত! আর ঘাটের তদারকিতে থাকা সহযোগী এবং টিকিট কাউন্টারের দায়িত্ব পালনকারীদের সে যে কি হম্বিতম্বি? যাত্রীদের সাথে অব্যাহতভাবে দূর্ব্যবহার করা তাদের একমাত্র কর্তব্য হিসেবে মানতো, কোন যাত্রীকেই তাদের সমীহ করতে দেখিনি কোনদিন। ভাবখানা এমন যে সব যাত্রী বুঝি টিকিট না কেটে ফাঁকি দিয়ে স্পীডবোটে ঘাট পার হতে চাইছে। অতএব কে টিকিট কাটা নিপাট ভদ্রলোক আর কে বিনা টিকিটে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে আসতে পারে সেই বাছবিচার তাদের কাছে ছিলো গৌণ। টিকিট কাটা শেষ তো আপনার সব সম্মান শেষ, কোন ডাকাডাকি তো নেইই পারলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে স্পীডবোটে বাদেই পদ্মা পার করে দিতো। বিশেষ করে দুই ঈদের মৌসুমে এই স্পীডবোট পরিচালনায় জড়িতদের পুরোপুরি চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীর ভূমিকায় দেখা যেতো, ইচ্ছেমতো ভাড়া হাঁকিয়ে সাধারণ মানুষের গালিগালাজ আর অভিশাপ কুড়াতো। পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হলে অনেক যাত্রীকেই বলতে শুনেছি —— বাচ্চারা, সেতু চালু হলে তোদের যেনো ভিক্ষার থালা হাতে নিয়ে ঘুরতে হয়!
মানুষ কেনো অভিশাপ দেবে না তাদের? কেনোই বা গালিগালাজ করবে না? মানুষের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া নিয়েও সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের চরম অবহেলা কেউ সহ্য করতে পারতো না। অধিকাংশ বোটে থাকতো না লাইফ জ্যাকেট, ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে নিয়ে সারাক্ষণ ঝুঁকির মধ্যে রেখে পারাপার করার এক জঘন্য সার্ভিস ছিলো সেটি। শুধুমাত্র মানুষের প্রয়োজন বিধায় এমন অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করতে হয়েছিলো দক্ষিণবঙ্গের মজলুম জনগনের স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগেরদিন পর্যন্ত।
আমি নিজের ভুলে একবার স্পীডবোটে ঘাট পার হতে গিয়ে পড়েছিলাম ভয়াবহ বিপদে! শীতের সকালে ঢাকায় কোথাও কুয়াশার লেশমাত্র না দেখে মাওয়া ঘাট পার হয়ে নড়াইল যাবার পরিকল্পনা নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে মাওয়া ঘাটে গিয়ে দেখি ডাঙ্গায় কোন কুয়াশা নেই অথচ নদীর পানির অংশ অদ্ভুত ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা। লঞ্চ, ফেরি বন্ধ, আটটা বাজে তবু কোথাও সূর্যের আলোর দেখা নেই, কখন লঞ্চ বা ফেরি ছাড়বে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। ওদিকে আমার প্রকল্পের জরুরী দাতা সংস্থার হর্তাকর্তাদের মাঠ পরিদর্শনের সিডিউল রয়েছে। খুবই বিচলিত বোধ করে স্পীডবোট ঘাটে গিয়ে দেখি সেটাও বন্ধ। কয়েকজন ব্যস্ত যাত্রীর চাপাচাপিতে দেখলাম কাউন্টার থেকে কিছু টিকিট ছাড়া হলো। আমি অনেকটা অসহায় হয়ে চাকুরীর মায়ায় টিকিট নিয়ে নিলাম কিন্তু কোন চালক যাত্রী নিয়ে ওপারে যেতে চাইছিলো না।
হঠাৎ সিনেমার নায়কের মতো ঘন কুয়াশা ভেদ করে একটি ষন্ডা মার্কা অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে স্পীডবোট নিয়ে ঘাটে ভিড়ে বল্ল- আমি যাবো যাত্রী নিয়ে। ছেলেটার চেহারা দেখে সুবিধার মনে হলো না, দ্বিধা নিয়ে উঠে পড়লাম ১৫-১৬ জন যাত্রী মহিলা ও শিশু সহ। এরপর এক ঘন্টা ধরে ঘন কুয়াশার মধ্যে দিক হারিয়ে চলতে থাকলো আমাদের স্পীডবোট, কখনো মাছের জন্য দেয়া ডালপালার ঘেরার মধ্যে ঢুকে পড়ছে তো কখনো উঠিয়ে দিচ্ছে অচেনা বালুচরে। একদিকে চলতে চলতে কিছু জেলেদের নৌকা পাওয়া গেলে তারা জানালো পুরো উল্টো পথে এসেছি আমরা। কিছুক্ষণ পর তো মহিলারা কান্নাকাটি আরম্ভ করলেন। আমি চালকের পাশে ছিলাম, দেখলাম সেও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে, তাকে সাহস দিচ্ছিলাম, কতোক্ষণ তেল থাকবে আর আমরা ঠিক কোথায় আছি এটাও জানা নেই। এভাবেই পুরো এক ঘন্টা ইতস্তত ঘুরাঘুরি করে কুয়াশা কেটে সূর্যের আলোর দেখা মিলল, আমরা হাফ ছেড়ে বাঁচলাম! সময় বাঁচাতে গিয়ে কি ভীষণ ঝুঁকির মধ্যেই না পড়ে গিয়ছিলাম সেদিন, আশা করি আমাদের পদ্মা সেতুর কল্যানে সেই আতঙ্কের দিনে আর কোনদিন ফিরে যাবার প্রয়োজন পড়বে না।
পল্লব খন্দকার, ১৩ জুলাই ২০২৩
mazhabkh93@gmail.com
Leave a Reply