চিংড়ি আহরণের পর অনিরাপদ হওয়া শুরু হয় নানান হাতে, নানান স্থানে, নানান ভাবে, নানান কৌশলে। উৎপাদনের সব উত্তম প্রক্রিয়া মেনে অর্থাৎ উত্তম চাষ পদ্ধতি ( Best Aquaculture Practice-BAP) অনুসরণ করে চাষ করা খুব ভালো মানের চিংড়িও আহরণের পর অনিরাপদ হয়ে যেতে পারে!
সাধারণত চিংড়ি আহরণ করার পর চিংড়ি নিরাপদ পানি দিয়ে ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করে এক স্তর চিংড়ি তার উপর এক স্তর বরফ কুঁচি দিয়ে প্লাস্টিক ক্যারেটে রাখতে হয়। তাই আহরণের পূর্বেই সেখানে নিরাপদ পানি এবং বরফ কুঁচি রাখার প্রয়োজন হয়। বাস্তবতা হচ্ছে আমদের চিংড়ি চাষিরা তা করেন না। ডিপো মালিক এবং অকশন সেন্টারের মালিকগণও চাষিদেরকে চিংড়ি আহরণের পর পরিষ্কার না করে এবং বরফ না দিয়েই ডিপোতে নিয়ে আসতে উৎসাহিত করেন। কারন ডিপো মালিকরা মনে করেন এসব করতে গিয়ে চাষিরা চিংড়ির ওজন বৃদ্ধি করতে অপদ্রব্য ব্যবহার করার সুযোগ নিবে।
চিংড়ি খামার বা ঘের থেকে ডিপো পর্যন্ত পরিবহনের সময় বলা যায় কোন রকম যত্নের ছোঁয়াই থাকে না। অপরিষ্কার বাজারের ব্যাগ, এমনকি পরনের লুঙ্গিতে করে প্রায় এক/দেড় কি.মি পথ হেটে চাষি্দেরকে চিংড়ি নিয়ে ডিপোতে আসতেও দেখা যায়। তারপর ডিপো কিংবা অকশন কেন্দ্রে আনার পর সেখানে আরো একটা লম্বা সময় বরফ ছাড়াই চিংড়ি জমা করা হয়। কারন ডিপো গুলোতে কাংখিত পরিমান চিংড়ি একত্রিত না হওয়া পর্যন্ত ডিপো মালিকরাও বরফ ব্যবহার করেন না। করলেও আনুপাতিক হারে করা হয় না। যেখানে প্রতি কেজি চিংড়িতে স্তরে স্তরে দুই কেজি বরফ কুঁচি দিয়ে ঢেকে রাখতে হয় সেখানে প্রতি কেজি চিংড়িতে এক কেজি বরফও দেয়া হয় না। আর সেই বরফও যে খুব একটা ভালো মানের তাও না। খুব কম ডিপোই রেজিস্ট্রাড বরফকল এ তৈরী নিরাপদ বরফ ব্যবহার করেন। ফলে ডিপো কিংবা অকশন কেন্দ্রে আসার পর চিংড়ির মান আরো একধাপ নীচে নেমে যায়!
চিংড়ির নিরাপদ না হবার আর একটা বড় কারন হলো ওজন বৃদ্ধির অসৎ উদ্দেশ্যে চিংড়িতে অপদ্রব্য বা ক্ষতিকর পদার্থ প্রবেশ করানো যা পুশ নামেই বেশি আলোচিত। চিংড়ির ওজন বাড়িয়ে অধিক লাভের জন্য এই অনৈতিক কাজটি করা হয়। চাষির হাত থেকে চিংড়ি অন্য হাতে যাওয়ার পর ফড়িয়া, পাইকার কিংবা অসাধু ডিপো মালিকরা বিভিন্ন গোপন স্থানে এ অপকর্মটি করে থাকেন। অসাধু অতি লোভী ব্যবসায়ীরা টাকার বিনিময়ে স্থানীয় কিছু লোকজন দিয়ে এই পুশ করানোর কাজটি করান। এক কেজি চিংড়িতে তারা ১০০ থেকে ১৫০ গ্রাম পর্যন্ত অপদ্রব্য পুশ করেন। সাধারণত চিংড়ির শরীরে সিরিঞ্জ দিয়ে ফিটকিরির পানি, ভাতের মাড়, সাগু, এরারুট, লোহা বা সীসার গুলি, মার্বেল, ম্যাজিক বল, জেলিসহ বিভিন্ন ধরনের অপদ্রব্য পুশ করেন।
এসব অপদ্রব্য গলদা চিংড়িতে বেশি পুশ করা হয়। কারন তুলনামুলকভাবে গলদার মাথাটা বেশ বড় হয়। পুশ করা এসব চিংড়ি পরে ঢাকাসহ বড় বড় শহরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বিভিন্ন আড়ত থেকে সেই ভেজাল মিশ্রিত চিংড়ি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র লটে খুচরা বাজারে পৌঁছায়। চিংড়ি ভোক্তার নিকট পৌঁছানোর পূর্ব পর্যন্ত যে অপকর্মগুলো হয় তার অনেক কিছুই সাধারন ভোক্তা খুব একটা জানতে পারেন না। রফতানীর ক্ষেত্রে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে ভেজাল চিংড়ি সনাক্ত করা হলেও দেশীয় বাজারে পরীক্ষা–নিরীক্ষা ছাড়াই চিংড়ি বেচাকেনা হয়ে থাকে। কোনটা ভেজাল এবং কোনটা নির্ভেজাল কেনার আগে তা ভোক্তাকেই যাচাই-বাছাই করে নিতে হয়। না জানার কারনে এ যাচাই—বাছাই এর কাজটা সব ভোক্তা ঠিকমত করতেও পারেন না।
ভোক্তাদের আরেকটা সমস্যা হলো সকলে সব সময় চকচকে চিংড়ি পছন্দ করেন। একটু লালচে কিংবা সামান্য নরম চিংড়ি হলে চলবে না। সাধারণত ঘের থেকে তোলার পর সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে চিংড়ি কিছুটা লাল রঙ ধারণ করে। এসব লাল রঙের চিংড়ির মান কম না হলেও বাজারে লাল চিংড়ির চাহিদা কম, দামও কম। অথচ চাষিরা যদি চিংড়ি আহরণ করার ৪৮ ঘন্টা আগে চিংড়িকে খাওয়ানো বন্ধ রাখে তা হলে 'লাল মাথা' নামে পরিচিত চিংড়ির মাথায় অফ-কালারের বিকাশকে কমিয়ে দিতে পারে। আসলে চিংড়ির অন্ত্রে (cephalothorax segment)- এ খাদ্য হজম হওয়ার কারণে বিবর্ণতা হয়। এই বিবর্ণতা কোনও খাদ্য নিরাপদতা বা ভোজ্য মানের সমস্যা না হলেও ভোক্তারা তাই মনে করেন।
এখন চিংড়িতে জেলি ব্যবহার করা হলে চিংড়ির রং অনেকটা সবুজের মত হয়, নরম ভাবটা থাকে না, দেখতে বেশ সতেজ মনে হয়। এই সবুজাভ রঙের শক্ত চিংড়ির চাহিদা বেশী হওয়ার সুযোগটা অসাধু ব্যবসায়ীরা পুরোপুরিই কাজে লাগান। অনেক সময় আবার ক্রেতাদেরকে আরো বেশি আকৃষ্ট করার জন্য চিংড়িতে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কাপড়ের রঙও ব্যবহার করা হয়। অসাধু পাইকাররা চিংড়ির ওজন বাড়ানোর জন্য বড় বালতি বা ড্রামের পানিতে নীল মিশিয়ে চিংড়ি ডুবিয়ে রাখে। তাতে চিংড়ির ওজনও বাড়ে আকর্ষণীয় সবুজাভ রংটাও আসে, চকচকে ভাবটা দেখে ক্রেতারাও বেশ আকৃষ্ট হন, বিক্রিও হয় ভালো।
এমনিতেই পুশের মাধ্যমে ভেজাল মিশ্রিত চিংড়ির দাম ভালো মানের চিংড়ি থেকে কম হয়। আবার ক্রেতাদের চোখকে ফাঁকি দেয়ার জন্য অসাধু পাইকারগণ এক কেজি চিংড়িতে আধা কেজি ভালো চিংড়ি আর বাকি আধা কেজি জেলি মিশ্রিত ভেজাল চিংড়ি রাখেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই দাম স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কমে যায়। খুচরা বিক্রেতাগন কম দামে ভেজাল মিশ্রিত চিংড়ি কিনে তারাও কম দামেই বিক্রি করে। যদি পাইকারী বাজারে পুশ ছাড়া এক কেজি চিংড়ির মুল্য ৫০০ বা ৬০০ টাকা হয় একই গ্রেডের বা সাইজের এই ভেজাল মিশ্রিত চিংড়ি বিক্রি হয় ৩৫০-৪০০ টাকার মধ্যে। কম দামের চিংড়ির চাহিদা নিম্ন শ্রেণির মানুষের কাছে বেশী। এছাড়া ঢাকার হোটেলগুলোতেও জেলি মিশ্রিত ভেজাল চিংড়ির ভালো একটা চাহিদা রয়েছে।
তাই কম দামে চিংড়ি ক্রয়ের আগে ভোক্তাকে অবশ্যই ভালো করে যাচাই করে দেখে নেয়া উচিৎ। চিংড়ি ক্রয়ের আগে একজন ভোক্তা খুব সহজেই চিংড়িতে জেলী বা অন্য ক্ষতিকর পদার্থ দেয়া হয়েছে কিনা তা যাচাই-বাছাই করে নিতে পারেন। চিংড়ির মাথার কানশার দুইপাশে ভেতরে টানলেই জেলি দেখা যায়। ওই স্থানটা অনেকটা বড় ও টানটান থাকে। জেলি চিংড়ির মাথার কাছে ভাঙলে এর উপরিভাগে নরম একটি আলগা আবরণ দেখা যায়। সেটা শক্ত কোনো কিছু দিয়ে খোঁচা দিলে বের হয়ে আসে। ভালো মানের নিরাপদ চিংড়ি ক্রয়ের সময় ক্রেতাকে মনে রাখতে হবেই যে চকচক করলেই যেমন সোনা হয় না তেমন সবুজাভ, শক্ত এবং চকচকে হলেই নিরাপদ চিংড়িও হয় না। আর ভালো ও নিরাপদ চিংড়ির দামটা একটু বেশী তো হবেই।
নিরাপদ চিংড়ি পাওয়া অনেকটাই ডিপো বা অকশন সেন্টারের উদ্যোক্তাদের সততা এবং সচেতনতার উপর নির্ভর করে। তাই এসব সেন্টারে কর্মরত জনবল প্রশিক্ষনের আওতায় এনে তাদেরকে অনিরাপদ হবার বিষয়গুলো যেমন- চিংড়ি আহরণের জন্য ব্যবহৃত সরঞ্জামগুলি, পরিবহনের জন্য সমস্ত বাস্কেটসমূহ ডিটারজেন্ট দিয়ে এবং পরিষ্কার পানি দিয়ে পরিষ্কার করা, প্রয়োজনে ২০০ পিপিএম ক্লোরিন দিয়ে স্যানিটাইজ করা বিষয়ে সচেতনতা তৈরী করা। এটাও সত্য যে, ডিপো কর্মীদের স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ে জ্ঞান এবং সচেতনতার অভাব রয়েছে। চিংড়ি ডিপোতে কাজ করা শ্রমিকরা আলাদা কাজের পোশাক বা এপ্রোন, বুট এবং গ্লাভস খুব কমই ব্যবহার করে। তাই সেই ১৯৯৭ সাল থেকেই চিংড়ি আমদানীকারক দেশগুলো আমাদের চিংড়িতে প্যাথোজেনিক ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, পরজীবীর উপস্থিতি, ভারীদ্রব্য, ময়লা, চুল, প্রাণীর পশম, কীটনাশক ইত্যাদি বিষয়ে সতর্কতা জারী করছে।
চিংড়িতে ভেজাল বন্ধের জন্য আইন আছে, আছে মৎস্য পরিদর্শন এবং মান নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তর (Fish Inspection and Quality Control-FIQC), এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষন প্রতিষ্ঠানও আছে। কিন্তু পুশ বা অপদ্রব্য মেশানো পুরোপুরি বন্ধ করা যাচ্ছে না। কাজটা নিঃসন্দেহে সহজ না, কিন্তু অসম্ভবও না। আইন প্রয়োগে কড়াকড়ি ছাড়াও এ সেক্টরে কর্মরত জনবলের দক্ষতা উন্নয়ন এবং সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সরকারী, বেসরকারী প্রতিষ্ঠান এবং মিডিয়া্গুলোর নানান মুখি কর্মকাণ্ড গ্রহন করা খুবই জরুরী। পাশাপাশি এটাও সত্য যদি রফতানী কারক এবং প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্রগুলো নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চিংড়ি উৎপাদন করে এবং রফতানী লক্ষ্যের একটা অংশ যদি নিজেরা অথবা চুক্তিবদ্ধ চাষি দিয়ে চাষ করান তাহলে মধ্যস্ত্বতাভোগীদের দ্বারা ভেজাল মিশ্রিত অনিরাপদ চিংড়ি সরবরাহ কমে আসবে, চিংড়ি রফতানীর পরিমাণও বাড়বে, আমরাও পাবো ভেজাল মুক্ত নিরাপদ চিংড়ি।
কেবল টাটকা মাছেই ভেজাল না, শুটকি মাছেও হয় নানানভাবে ভেজাল। যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য মহা বিপদ সংকেত। শুটকি মাছের ভেজালের বিষয়গুলোই থাকবে পরবর্তী পর্বে।
মোঃ মাকসুদুর রহমান
কৃষি উৎপাদন, সরবরাহ শিকল ও নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ।
ই-মেইলঃ maksudurrahman1363@gmail.com