সূচনা পর্বঃ
আমাদের গ্রামে শীত মৌসুমে ধানের জমি খাল বিল নালা ও রাস্তার পাশের মৌসুমী জলাধারগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় সেগুলো সেচে সম্পূর্ণ পানি শুকিয়ে ফেলে জলাশয়ে থাকা সব মাছ ধরে ফেলার প্রচলন ছিলো। এসবই ছিলো প্রাকৃতিক ও দেশি প্রজাতির বিভিন্ন প্রকার মাছ, একবারে জলাধার সেচে মাছ আহরণের কারনে একসাথে প্রচুর মাছ পাওয়া যেতো। সে আমলে ঘরে ঘরে মাছ সংরক্ষণের জন্য রেফ্রিজারেটর ছিলো না তাই শোল টাকি পুটি ইত্যাদি মাছগুলো কেটে বেছে ধুয়ে লবন ও হলুদ মাখিয়ে রোদে শুকানো হতো। এরপর যথেষ্ট পরিমান শুকালে মাটির হাড়িতে সংরক্ষণ করে অনায়াসে দুই তিন মাস পরিবারের আমিষের প্রয়োজন মেটানো যেতো। তবে শুঁটকিতে একটি বিশেষ গন্ধ থাকায় পরিবারের দুই একজন অপছন্দ করতো, তবে অধিকাংশের কাছে তা ছিলো পছন্দের খাবার মেন্যু। আমাদের সেই গ্রাম্য শুঁটকি উৎপাদন, সংরক্ষণ ও ভোজন সবই ছিলো পারিবারিক আয়োজন, এসবের সাথে কোন ব্যবসার সম্পৃক্ততা ছিলো না। শুধুমাত্র অতিরিক্ত আহরিত মাছকে দীর্ঘদিন ধরে খাবার উপযোগী রাখতে শুকানোর উদ্যোগ নেয়া হতো, সেটা ছিলো একান্তই স্থানীয় প্রযুক্তির সনাতন পদ্ধতির প্রয়োগ। লবন, হলুদ ছাড়া আর কোন উপাদান ব্যবহার করার প্রয়োজন আমরা বোধ করিনি, ঠিকমত শুঁকাতে পারলেই অনায়াসে তিন চার মাস সংরক্ষণ করা সম্ভব ছিলো।
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে শুঁটকি উৎপাদন ও সংরক্ষণের চিত্রটা পুরোপুরিই ভিন্ন। গত এপ্রিল মাসে দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন হতে জানা যায় যে, সুন্দরবনের দুবলার চরে শুঁটকির উৎপাদন পূর্বের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে । ২০২১-২২ অর্থ বছরে দুবলার ৪টি চরে ৬ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদন হয়েছে। ইতিপূর্বে দুবলার চর হতে ৪ হাজার মেট্রিক টনের বেশি শুঁটকি উৎপাদন হয়নি। এছাড়া শুঁটকি উৎপাদন এলাকা হিসেবে পরিচিত স্থান সমূহ হলো সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, রাঙাবালি, সোনাদিয়া দ্বীপ, মহেশখালী, কক্সবাজার, সুনামগঞ্জের ইব্রাহিমপুর ও জামালগঞ্জের যশোমন্তপুর। এসকল অঞ্চল হতে গত বছর দেশের চাহিদা মিটিয়ে প্রায় ৪ হাজার মেট্রিক টন শুঁটকি মাছ দেশের বাইরে রপ্তানি করা হয়। তাই কিছু মানুষ বিশেষ গন্ধের কারনে শুঁটকি মাছ পছন্দ না করলেও দেশের একটি বড় অংশের মানুষ শুঁটকির নিয়মিত ভোক্তা। বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার মানুষদের কাছে এটি ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় খাদ্য হিসেবে সমাদৃত।
শুঁটকিতে তাজা মাছের তুলনায় আমিষ বা প্রোটিন ও খনিজ লবণের পরিমাণ অনেক বেশি। ক্যালসিয়াম ও লৌহের পরিমাণও অনেক। ছোট চিংড়ির শুঁটকিতে লৌহের পরিমাণ বেশি। রক্ত স্বল্পতা ও গর্ভবতী নারীরা এটি খেলে উপকার পাবেন। যারা দুধ খেতে পারেন না বা ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স আছে, তারা প্রোটিনের বিকল্প উৎস হিসেবে মাঝে মাঝে শুঁটকি খেতে পারেন। প্রতি ১০০ গ্রাম ছোট চিংড়ির শুঁটকিতে থাকে-৬২ দশমিক ৪ গ্রাম প্রোটিন, ৩৫৩৯ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ৩৫৪ মিলিগ্রাম ফসফরাস, ২৮ গ্রাম লৌহ ও ২৯২ ক্যালরি। ছুরি শুঁটকিতে-৭৬ দশমিক ১ গ্রাম প্রোটিন, ৭৩৯ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ৭০০ মিলিগ্রাম ফসফরাস, ৪ দশমিক ২ মিলিগ্রাম লৌহ, ৩৮৩ ক্যালরি। টেংরার শুঁটকিতে-৫৪ দশমিক ৯ গ্রাম প্রোটিন, ৮৪৩ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ৪০০ মিলিগ্রাম ফসফরাস, ৫ মিলিগ্রাম লৌহ ও ২৫৫ ক্যালরি। লইট্টার শুঁটকিতে-৬১ দশমিক ৭ গ্রাম প্রোটিন, ১৭৮১ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ২৪০ মিলিগ্রাম ফসফরাস, ২০ মিলিগ্রাম লৌহ ও ২৯৫ ক্যালরি। ফাইস্যা মাছের শুঁটকিতে-১১ গ্রাম প্রোটিন, ১১৭৬ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ৪৭৮ মিলিগ্রাম ফসফরাস, ১৮ মিলিগ্রাম লৌহ ও ৩৩৬ ক্যালরি। এই রকম পুষ্টি সমৃদ্ধ আমিষ জাতীয় খাদ্য উৎপাদন, সরবরাহ ও বাজারজাতকরণের সাথে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের একটি বড় অংশের জনবল নিয়োজিত রয়েছে।
মাছকে শুঁটকি হিসেবে প্রক্রিয়াজাত করার আদি পদ্ধতিতে খুব বড় ধরনের পরিবর্তন আসেনি। মাছকে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে রোদে রাখা হয় মাছের দেহ থেকে অতিরিক্ত পানি অপসারণের জন্য। কারণ পানির কারণেই মাছের শরীরে বিভিন্ন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীব বেঁচে থাকে এবং মাছকে পচতে সহায়তা করে। খোলা জায়গায় বাতাস এবং রোদ ব্যবহার করে মাছকে শুকানোর প্রথা অনেক প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে আমাদের দেশে। এমন প্রাচীন পদ্ধতি অবলম্বন করায় শুঁটকি উৎপাদন কখনোই ঝুঁকিমুক্ত করা সম্ভব নয় বরং খোলা স্থান হতে মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক জীবানু ও দূষণ সৃষ্টিকারী উপাদান যুক্ত হবার সম্ভাবনা থেকেই যায়। কিন্তু শুঁটকি উৎপাদনের সবথেকে ভয়ঙ্কর ঘটনাটি আমাদের আতঙ্কিত করে সবসময়, তাহলো শুঁটকিকে পচন থেকে রক্ষার জন্য অনুমোদনহীন বিভিন্ন ধরণের বিষাক্ত উপাদান, কীটনাশক ইত্যাদি ব্যবহার করা। একসময় ব্যপকহারে স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ডিডিটি ব্যবহার করা হতো শুঁটকি উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে। কিন্তু সরকারিভাবে ডিডিটি নিষিদ্ধ করা ও বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে শুঁটকিতে ডিডিটির মত বিষ না ব্যবহার করার বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতা তৈরির ফলে শুঁটকি এখন অনেকটাই নিরাপদ খাদ্য হিসেবে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছে।
বিষ ব্যবহারে উৎপাদিত শুঁটকি আমাদের জন্য ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে থাকে। আসুন দেখি কি কারনে শুঁটকি উৎপাদনের সময় বিষ ব্যবহৃত হয়? মাছ রোদে শুকিয়ে শুঁটকি করার সময় এক ধরনের মাছির লার্ভা বা শুককীট শুঁটকি মাছের মারাত্মক ক্ষতি করে। এই ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য শুঁটকি মাছ উৎপাদনকারীরা মাছ শুকানোর আগে কাঁচা মাছে বিষাক্ত কীটনাশক প্রয়োগ করে। এতে উৎপাদিত শুঁটকি মাছ বিষাক্ত হয়। যা খাওয়া অস্বাস্থ্যকর ও অনিরাপদ। শুঁটকি মাছ উৎপাদনকারীরা যখন কীটনাশক প্রয়োগ করে তখনই শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে তাদের শরীরে কীটনাশক ঢুকে যায়। শুঁটকিভোজী মানুষেরা এই কীটনাশকযুক্ত শুঁটকি মাছ খাওয়ার ফলে মানবদেহে বিভিন্ন ধরনের খারাপ প্রভাব পরে যেমন- মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, লিভার, ফুসফুস এবং কিডনি সহজেই রোগাক্রান্ত হয়, হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে, প্রজনন ক্ষমতার উপর প্রভাব পড়ে, মহিলাদের অধিক পরিমাণ গর্ভপাত এবং মৃত অথবা বিকলাঙ্গ সন্তান জন্ম হতে পারে। কাজেই বর্তমানে যুগের দাবি হচ্ছে কীটনাশকমুক্ত শুঁটকি মাছ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ নিশ্চিত করা।
এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, মাছির আক্রমণে প্রায় ৩০% শুঁটকি মাছ নষ্ট হয়ে যায়। এতে প্রতি বছর ২-৩ শত কোটি টাকার শুঁটকি মাছ নষ্ট হয়। এই মাছির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য মাছে ক্ষতিকারক বিষ ও অতিরিক্ত লবণ প্রয়োগ করছে শুঁটকি উৎপাদকরা। এতে ভোক্তা ও উৎপাদক উভয়েরই স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। এ কারণে শুঁটকির গুণগত মান কমে যাচ্ছে এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে একদিকে শুঁটকির বাজারমূল্য কমে যাচ্ছে এবং অন্যদিকে শুঁটকি মাছ বিদেশে রপ্তানি করা যাচ্ছে না। এসব বিবেচনা করে বিষমুক্ত, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত শুঁটকি মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যে মাছি বন্ধ্যাকরণ প্রযুক্তির মাধ্যমে শুঁটকির ক্ষতিকারক আপদ দমনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের বিজ্ঞানীরা। আশা করি এই প্রযুক্তিটি শুঁটকি উৎপাদন এলাকায় উপযুক্তভাবে সম্প্রসারণ করা গেলে আমরা বিষমুক্ত ও নিরাপদ শুঁটকি নিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারবো।
চলবে.....................
(আগামী পর্বে থাকবে শুঁটকির সরবরাহ শিকল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা)
পল্লব খন্দকার, ২৯ আগষ্ট ২০২৩
mazhabkh93@gmail.com