শুঁটকি মাছ শুধু স্বাদ বিবেচনাতেই নয় নানান রকম পুষ্টি উপকারিতার দিক দিয়েও বাংলাদেশের মানুষের খুব পছন্দের। কিছু মানুষ শুনেছি কোন বাসায় শুঁটকি মাছ রান্না হলে সেই বাড়িতে বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙ্গে দেন বা সেই বাড়িতে বিয়ের দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করেন! আসলে শুঁটকি মাছের গন্ধটা অনেকের খুব অপছন্দ। খাদ্য হিসাবে পছন্দ হোক বা না হোক শুঁটকি মাছের উপকারিতা কিন্তু অনেক। এসব উপকারিতার কথা কিছুটা প্রথম পর্বে লেখা হয়েছে। আসলে, শুটকি মাছে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ প্রোটিন পাওয়া যায়, ৩০০ ক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়। প্রোটিন ছাড়াও থাকে ক্যালসিয়াম, আয়রন,সোডিয়াম ও অন্যান্য উপাদানও রয়েছে। ফলে শরীরে শক্তি যোগাতে শুঁটকি মাছের জুড়ি নেই। তাইতো শুঁটকি মাছ এত প্রিয় সবার।
এই যে এত প্রিয় এত সম্ভাবনাময় শুঁটকি মাছ, তা আমাদের দেশে এখনো তৈরী করা হয় অতি প্রাচীন সনাতন (Traditional) পদ্ধতিতে। অর্থাৎ খোলা আকাশের নীচে, মাচায়, সুতোয় ঝুলিয়ে কিংবা মাটিতে কিছু বিছিয়ে তার উপর ছড়িয়ে দিয়ে রোদে শুকিয়ে। এই শুকানো মাছ তৈরিতে খুব একটা ভাল স্বাস্থ্যবিধি অনুশীলন করা হয় এমনটা বলা যাবে না। বর্ষাকালে যখন মাছ বেশী ধরা হয় তখন বাতাসে আর্দ্রতার মাত্রাও বেশি থাকে। তখন স্বল্প রোদে অনেক সময় ভালো করে মাছ শুকানো সম্ভব হয়ে উঠে না। পুরোপুরি না শুকানো সেই মাছে পানি থাকার করনে বিভিন্ন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুজীব বেঁচে থাকে এবং মাছকে পঁচতে সহায়তা করে, মাছে ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক বা পোকামাকড়ের আক্রমণ ঘটে, ক্ষতিকর জীবাণু দ্বারাও সংক্রমিত হয়ে যেতে পারে। রোদে শুকানো মাছের মান কিছুটা নিম্ন মানের হওয়ার প্রধান কারণ অসম্পূর্ণ শুকানো, অপর্যাপ্ত প্রক্রিয়াকরণ, অপর্যাপ্ত লবণাক্তকরণ, অনুপযুক্ত শুকানো, প্রক্রিয়াকরণের জন্য নষ্ট মাছ ব্যবহার এবং শুকনো মাছ বায়ু নিরোধক পাত্রে সংরক্ষনের অভাব ইত্যাদি।
বর্ষাকালীন রোদ বৃষ্টি ঝড়ের লুকোচুরির কারনে মাছ শুকানোর সমস্যাতো আছেই ছাড়াও শুটকি মাছ উৎপাদনকারীর কাছ থেকে সংগ্রহকারী বা পাইকারদের অজ্ঞতা, অসচেনতা এবং অবহেলা। অধিকাংশ পাইকার শুকনো মাছের গুণমান নিশ্চিত করার জন্য সুরক্ষামূলক কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করেন না। তাঁরা বিভিন্ন জনের কাছ থেকে সংগ্রহ করা অপর্যাপ্ত শুকানো শুঁটকি মাছ তাঁরা পুনরায় শুকিয়ে সংরক্ষণ করেন। বেশিরভাগ সময়ই পাইকাররা শুঁটকি মাছ সিমেন্টের মেঝেতে কিংবা প্লাস্টিক বা পাটের ব্যাগে সংরক্ষণ করে। কনোরকম বায়ুনিরোধোক পাত্রে সংরক্ষণ না করার ফলে শুঁটকি মাছ বাতাস থেকে আদ্রতা শোষণ করে। ফলে খুব সহজেই এসব অপর্যাপ্ত শুকানো শুঁটকি মাছ সংরক্ষিত শুটকি মাছ ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাক দ্বারা সংক্রমিত হয়ে যায় এবং স্যাঁতসেঁতে গুদামে সংরক্ষণ করার ফলে মাছি দ্বারাও আক্রান্ত হয়। মাছিগুলো ডিম পাড়ে যা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ফুটে ওঠে। তারপর লার্ভা শুঁটকি মাছ খায় এবং শুঁটকি মাছকে অনিরাপদ করে ফেলে।
নিঃসন্দেহে ভালো মানের শুটকি মাছ তৈরী করার জন্য ভালো যত্ন দরকার। শুটকি মাছ শুকানোর আগে মাছের আঁইশ এবং ভিতরের পচনশীল অংশ (বিশেষ করে পেটের ভিতরে অংশ; নাড়ি-ভুঁড়ি ইত্যাদি) মাছের শরীর থেকে বাদ দিতে হয় । কিভাবে মাছ কাটা হবে তার উপর শুঁটকির স্বাদ ও গন্ধ অনেকাংশে নির্ভর করে। তারপর মাছকে ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করতে হয়। এক্ষেত্রে জীবাণুমুক্ত করার উদ্দেশ্যে মাছকে লবণ পানিতে ১০-১২ ঘণ্টা ডুবিয়ে রাখা হয়। লবণ এখানে জীবাণুনাশকের ভূমিকা পালন করে মাছের গুণগত মানকে অক্ষুণ্ণ রাখে। পুনরায় মাছকে ধোয়া হয় এবং সাধারণ পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয় কিছুক্ষণের জন্য । পরবর্তীতে মাছকে পুনরায় রোদে শুকিয়ে পানি ঝরিয়ে নেওয়া হয়। এটা ঠিক যে রোদে শুকানোর সময় নানা ধরনের কীটপতঙ্গ (যেমন- মশা, মাছি, গুবরে পোকা ইত্যাদি) আক্রমণ করতে পারে । অনেক চাষিই মাছ রোদে শুকানোর সময় মাছের উপর বিভিন্ন ধরনের অনোনুমোদিত কীটনাশক বা ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করে থাকে। ফলে আমদের প্রিয় শুঁটকি মাছ আমাদের জন্য অনিরাপদ হয়ে যায়। মাছের মতই শুঁটকি মাছও আড়ত থেকে নানান হাতবদলের মাধ্যমেই শেষ পর্যন্ত ভোক্তার নিকট পৌঁছে।
শুটকি মাছের দীর্ঘ বিপণন শৃঙ্খলটিও জেলে, ক্রয় কমিশন এজেন্ট, প্রসেসর, ক্রয় কমিশন এজেন্ট, পাইকারী বিক্রেতা, খুচরা বিক্রেতার হাত ঘুরে অবশেষে আসে ভোক্তার টেবিলে। ফলে আমদের প্রিয় শুঁটকি মাছ আমাদের জন্য অনিরাপদ হয়ে যায়। এ সব অনিরাপদ শুঁটকি মাছ খেতে আমাদের দেশের মানুষ যেমন ভয় করে তেমনি দেশের বাইরের ভোক্তাদের নিকট এর চাহিদাও কমে যায়। শুঁটকিকে নিরাপদ করতে ইদানীং আধুনিক Fish Dryer, Sun Dryer বা মাছি প্রতিরোধী নেটের জাল ব্যবহার করা হয় কোথাও কোথাও। যদিও শীর্ষ শুঁটকি উৎপাদন মৌসুমে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিরাপদতা বজায় রাখা সম্ভবপর হয় না, এছাড়া প্রত্যন্ত চর এলাকাগুলোয় মনিটরিং এর সুযোগও সীমিত।
শুঁটকি মাছ রপ্তানি করেও বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। মধ্যপ্রাচ্য, মালেশিয়া, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, হংকং, ব্রিটেন, আমেরিকা, চিন, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশে আমাদের দেশের শুঁটকি মাছের ভীষণ চাহিদা রয়েছে। কারন এসব দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশের মানুষের কাছে যেমন শুঁটকি প্রিয় খাবার হিসেবে সমাদৃত তেমনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছেও শুঁটকি মাছের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। ফলে রফতানীও বাড়ছে। কক্সবাজার, টেকনাফ, কুতুবদিয়া, রাঙ্গাদিয়া, মহেশখালী, সোনাদিয়া, চকরিয়া, সেন্ট মার্টিন এর পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলের পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নিফামারী, ঠাকুরগাঁ ইত্যাদি জেলা, দক্ষিন-পশ্চিঞ্চলের খুলনা, বাগেরহাট এবং সাতক্ষিরা জেলা থেকেও শুঁটকি রফতানী হচ্ছে। The Dhaka Tribune এর এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উল্ল্যেখ করা করা হয়েছে - বছরে শুঁটকি রপ্তানি থেকে ২৫ লাখ মার্কিন ডলার দেশের অর্থনীতিতে যোগ হয়, যদিও তা চাহিদা এবং সম্ভাবনার তুলনায় অনেক কম।
বিদেশে শুঁটকি রপ্তানির ব্যাপারে কোনো সরকারি নীতিমালা না থাকায় এসব শুঁটকি রপ্তানি হচ্ছে সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে। ফলে আমাদের দেশের শুঁটকি মাছের চাহিদা থাকা সত্বেও বিদেশের বাজারে শুঁটকি রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে না। সরকারী সহায়তা বাড়িয়ে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমাদের দেশ থেকে শুঁটকি মাছ রফতানী করে আরও বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। পাশাপাশি দেশের শুঁটকি শিল্পে বিপুলসংখ্যক লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাও সম্ভব।
সম্প্রতি এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, কীটনাশক ব্যবহার করে শুঁটকি উৎপাদনে নিয়োজিত মানুষ এবং ভোক্তাদের মধ্যে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন চর্মরোগ উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় শুঁটকি উৎপাদন প্রক্রিয়াটি নিবিড় মনিটরিং এর আওতায় বাজারজাত করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সরকারী সংস্থার তদারকি বৃদ্ধির পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া এখন ভীষণভাবে প্রয়োজন।
মোঃ মাকসুদুর রহমান
কৃষি উৎপাদন, সরবরাহ শিকল ও নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ।
ই-মেইলঃ maksudurrahman1363@gmail.com