সুস্থ্যভাবে বাঁচার জন্য আমরা নিরাপদ খাদ্য চাই । কারন অনিরাপদ খাদ্যে রয়েছে বিভিন্ন ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া, টক্সিন, ভাইরাস, প্যারাসাইটস ও রাসায়নিক পদার্থ। আর এসবের কারনেই ডায়রিয়া থেকে শুরু করে ক্যানসার পর্যন্ত সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তাই নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন এবং সরবরাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের প্রথম সারিতে রয়েছেন আমাদের সকলের পূজনীয় এই দেশের কৃষিকাজের প্রধান কারিগর ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক। যাদের শ্রমে ও ঘামে আমাদের দেশের কৃষি প্রধান অর্থনীতির মেরুদণ্ড গঠিত হয়, তাঁদেরকে বাদ দিয়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের বিষয়টি আমরা কল্পনাও করতে পারবো না। কিন্তু আমরা কি কখনো দেখার চেষ্টা করেছি নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের বিষয়ে আমাদের সেই মূল শক্তি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক ভাই-বোনেরা কি ভাবছেন?
আমরা জানি, আমাদের খাদ্য উৎপাদনের কাজটি আমাদের কৃষকরাই করেন। সহজ–সরল কৃষকদের চাওয়াটাও খুব সাদা-মাটা। তাঁরা চায় তাঁদের সবচেয়ে মুল্যবান সম্পদ তাঁদের চাষের জমিটা ভালো থাকুক, উর্বর থাকুক, উৎপাদনক্ষম থাকুক। তাঁরা চায় সুলভ মুল্যে গুনগতমানের উৎপাদন উপকরন সমূহ তাঁদের জন্য সহজলভ্য হোক। উৎপাদন খরচ কমে আসুক। আধুনিক উৎপাদন কলাকৌশল জানার সুযোগ তৈরী হোক। উৎপাদিত পণ্যের সুস্থ্য সরবরাহ শিকল ব্যবস্থা তৈরী হোক। তাঁদের উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে কিছুটা লাভ হোক। ব্যাস, এইটুকুই তো। কিন্তু এই সহজ-সরল সমীকরণটাই মিলে না আমাদের কৃষকদের।
এক কথায়, কৃষি পন্য উৎপাদনের সাথে জড়িত মানুষগুলোকে তাঁদের জীবিকায়ন টিকিয়ে রাখার জন্য নানাবিধ সমস্যার মধ্য দিয়েই তাঁদের উৎপাদনের কাজটি করে যেতে হয়। এত সমস্যার মধ্যেও ভালো পণ্য উৎপাদনে কৃষকের যত্নের কোন কমতি থাকে না। সন্তানের মত যত্ন করেই উৎপাদন করেন প্রতিটি ফসল। তাঁদের উৎপাদিত ফসল আমাদের জন্য অনিরাপদ হোক কোন কৃষকই তা চান না। কৃষকের উৎপাদিত ফসল নানান স্থানে, নানান প্রক্রিয়ায়, নানান মানুষের হাত বদলের মাধ্যমে অনিরাপদ হয়ে যায়।
উৎপাদন প্রক্রিয়ায় উপকরন ব্যবহার, প্রযুক্তি ব্যবহার, পানি ব্যবহার, কৃষি যন্ত্র ব্যবহার, রোগ-বালাই দমন ব্যবস্থাপনা, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা, ফসল আহরণ, আহরণ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা এবং বাজারজাতকরন ইত্যাদি বিভিন্ন ধাপে কৃষক সঠিক কাজটি করছেন কিনা সেটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । অনেক ক্ষেত্রে না জানা কিংবা অসেচতনতার কারনেও সযত্নে উৎপাদিত কৃষিপণ্য অনিরাপদ হয়ে যেতে পারে।
তবে যে বিষয়টা লক্ষনীয় তা হল কৃষক নিরাপদ খাদ্যই উৎপাদন করতে চায়। কিন্তু খুব স্বাস্থ্য সচেতন ভোক্তা যেমনভাবে চায় ঠিক তেমনভাবে উৎপাদন করাটা অনেক সময়ই কঠিন হয়ে যায়। এক্ষেত্রে কৃষকের সামনে অনেকগুলো প্রশ্ন চলে আসে। উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় গুনগত মানের উপকরণ কি সহজলভ্য? গুনগত মানের উপকরণ মুল্য কি ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে? বাজারে পাওয়া উপকরণ সমূহ কি ভেজালমুক্ত? নিরাপদ খাদ্যের পৃথক বাজার কিংবা বাজার মূল্য আছে কি? ভোক্তা কি নিরাপদ কৃষি পন্য ক্রয়ে বাড়তি মূল্যে দিতে আগ্রহী? নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন কি কৃষকের জন্য লাভজনক? নিরাপদ কৃষি পন্য সরবরাহের শক্তিশালী চেইন কি আছে? স্থানীয়, আঞ্চলিক এবং জাতীয় পর্যায়ে নিরাপদ কৃষি পণ্য বাজারজাত করনের অবকাঠামো এবং প্রতিষ্ঠান কি গড়ে উঠেছে? নিরাপদ কৃষি পণ্য উৎপাদন ও বিপনন বিষয়ে কৃষকদের দক্ষতা উন্নয়নে সরকারী-বেসরকারী সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত সেবা পাওয়া কি সহজ? বানিজ্যকভাবে রফতানীমুখী নিরাপদ কৃষি পণ্য উৎপাদনে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা কি সহজলোভ্য? ঝুঁকি হ্রাসে কোন বীমা সুবিধা পাওয়া যাবে কি? ইত্যাদি আরো অনেক প্রশ্ন।
কৃষি কাজের পূর্ব শর্তই হল প্রয়োজনীয় সকল প্রকার উপকরনের নিশ্চয়তা। উপকরন সমূহ অবশ্যই হতে হবে গুনগতমানের কৃষি উপকরণ। মাঠফসল, মৎস্য এবং প্রাণী সম্পদ উৎপাদনের জন্য মোটাদাগে পানি, পূঁজি, প্রযুক্তি ছাড়াও প্রয়োজন হয় বীজ, সার, কীটনাশক, পোনা, প্রোবায়োটিক, মাছের খাবার, গাভীর বীজ, দানাদার খাবার, ভিটামিন, মিনামিক্স, লবন, ঔষধ ইত্যাদিসহ আরো অনেক উপকরণ। এসব উপকরণ যদি গুনগতমানের না হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই ভালো ফলনও হয় না। ভেজাল উপকরনের কারনেই প্রয়োজনের চেয়ে অধিক উপকরনও ব্যবহার করতে হয়। ফলে অনাকাংখিতভাবেই কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়, ফলন কম হয়, কৃষক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আধুনিক চাষাবাদে বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক অবাধে ব্যবহার করা হয়। আমাদের কৃষকদের অনেকেই জানেন না কোন ফসলে, কোন কীটনাশক, কখন, কি পরিমান এবং কিভাবে ব্যবহার করতে হয়। এমনকি ব্যবহারের সময় স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমাতে কি ধরনের পোশাক পরতে হয়, মাস্ক পড়তে হয়, বাতাসের অনুকূলে যে স্প্রে করতে হয় তাও তাঁরা জানেন না বা জানলেও খুব একটা মানেন না। কীটনাশক ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালাও নেই আমাদের। বিভিন্ন দাতা সংস্থার অর্থায়নে বাস্তবায়িত প্রকল্পের কৃষকরা কীটপতঙ্গ দমনের জন্য নিম তেল, মেহগনি বীজের তেল, ফেরোমন ফাঁদ, নানান রঙের বোর্ড ব্যবহার করেন। এই সব প্রকল্পাধীন কৃষকের সংখ্যা খুবই কম। তাছাড়া এ ক্ষেত্রে কোন ব্লক ভিত্তিক না হয়ে একক কৃষক ভিত্তিক হওয়ায় পার্শ্ববর্তী কৃষক প্রকল্পাধীন কৃষক না হলে সে এসব ব্যবহার করেন না। ফলে এসব উপকরণ ব্যবহারে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যায় না। নানান রকম জৈব বালাইনাশক এবং অন্যান্য উপকরণ এর ব্যবহার বিষয়ে সচেতনতা তৈরী করার কাজটি কৃষি সম্প্রসারণ আরো জোরালোভাবে করতে পারে। বিভিন্ন বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা জৈব বালাইনাশক তৈরী এবং বিপণনের জন্য উদ্যোক্তা তৈরী করছেন, সে সংখ্যাও খুবই কম। তাই কীটনাশকের অবাধ ব্যবহার কমানোর জন্য সরকারীভাবে নীতিমালা প্রনয়নের পাশাপাশি উদ্যোক্তা তৈরিতে আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং কৃষকদের সচেতনতা তৈরী ও দক্ষতা উন্নয়ন বিষয়ক প্রশিক্ষনের আয়োজন করা নিঃসন্দেহে অতি মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার কমিয়ে আনবে।
(কৃষকের অবাধ রাসায়নিক সার ব্যবহার, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে কৃষকের আগ্রহ-অনাগ্রহ, সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে লেখাটি চলমান থাকবে)
মোঃ মাকসুদুর রহমান
কৃষি উৎপাদন, সরবরাহ শিকল ও নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ।
ই-মেইলঃ maksudurrahman1363@gmail.com
কৃষি উৎপাদনের মুল কথা, কৃষকের প্রাণের কথা বলেছেন ভাই
প্রকৃতভাবে নিরাপদ খাবারের জন্য আমাদের দেশে এখন পর্যপ্ত ভোক্তা যেমন তৈরি হয়নি, তেমনি নিরাপদ খাদ্যের জন্য আলাদা সরবরাহ চেইনও তৈরি হয়নি। যে কারণে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের প্রচেষ্টাকারী কৃষক।