বেঁচে থাকা ও কর্মক্ষম থাকার জন্য আমাদের যেমনটি নিয়মিত খাবার খেতে হয়, তেমনি সারা বছর উৎপাদনশীল রাখতে জমিকেও খাবার দিতে হয়। জমিকে খাবার না দিলে জমিও আমাদের জন্য খাবার উৎপাদন করবে না। উপযুক্ত খাবার এবং পুষ্টির অভাবে জমির স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাবে, উর্বরতা এবং উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাবে। মাটিতে উপযুক্ত খাবারের অভাবে মাটির উৎপাদন ক্ষমতা যদি কমে যায় তাহলে ১৬ কোটি মানুষের জন্য খাদ্য চাহিদা পূরণ করা নিঃসন্দেহে কঠিন হবে। এদিকে দিনে দিনে আমাদের খাদ্য চাহিদাও বাড়ছে। বাড়তি চাহিদার কারণে জমি থেকে বেশি উৎপাদনে মনোযোগী কৃষককে তাই জমিতে বাড়তি খাবার দেয়ার বিষয়েও সচেতন হতে হয়।
বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (SRDI)’র গবেষণার তথ্যও বলছে ইতিমধ্যে দেশের আবাদযোগ্য জমির প্রায় ৮৫ শতাংশ ভূমির উর্বরাশক্তি কমে গেছে। এ ছাড়া জৈব পদার্থের অভাব রয়েছে, এমন জমির পরিমাণও ৩৮ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। জমির নিবিড়তা বেড়েছে, এক ফসলি জমি এখন দু-তিন এমনকি এলাকা ভেদে চার ফসলিও হয়েছে। অর্থাৎ উৎপাদনের চাহিদা বাড়ায় জমির উপর চাপ বেড়েছে। খুব স্বভাবিকভাবেই জমিতে বিদ্যমান পুষ্টি এবং অনুপুষ্টির ঘাটতি তৈরী হয়েছে। ঘাটতি পূরনের জন্য প্রয়োজনীয় সারের মূল্য বেড়েছে। কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। ফলে কৃষকরা জমি থেকে বেশি উৎপাদনে মনোযোগী হয়েছেন কিন্তু বাড়তি উৎপাদনের জন্য জমিকে যে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান দিতে হবে, তার সব গুলো তাঁরা দিতে পারছেন না।
সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে উত্তম কাজটি হচ্ছে বিভিন্ন ফসলের জন্য মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে সুপারিশকৃত মাত্রায় সার প্রয়োগ করা। কিন্তু এই মাটি পরীক্ষা করতে চাইলেই কি সবাই করতে পারে? মাটি পরীক্ষার সুযোগতো সবার নাগালের মধ্যে থাকে না। এই মাটি পরীক্ষার মূখ্য দায়ীত্ব পালনকারী মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষেও তাঁদের নানান সীমাবদ্ধতার কারনে সকল কৃষকের নিকট পৌঁছানো সম্ভব হয়ে উঠে না। ফলে কৃষকরা তাঁদের অনুমান ভিত্তিক এবং অনিয়ন্ত্রিত সনাতন পদ্ধতিতেই সার ব্যবহার করছেন। ফলে প্রয়োজনের চেয়ে জমিতে কিছুটা বেশীই সার ব্যবহার করা হচ্ছে। এই অতিমাত্রায় সার ব্যবহার করার ফলে দিনে দিনে জমি তার উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা হারাচ্ছে। বাড়তি উৎপাদনের জন্য কৃষকরা অতিমাত্রায় যে সার তাঁরা প্রয়োগ করছেন সেগুলো মূলতঃ ইউরিয়া, ট্রিপল সুপার ফসফেট এবং মিউরেট অফ পটাশ। গাছের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ১৭ টি উপাদেনের মধ্যে এগুলো মাটিতে কেবল নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং পটাশ যোগ করে। ফলে মাটিতে আরো ১১টি অনুপুষ্টির ঘাটতি রয়েই যায়।
তারপরও এটা সত্য যে, মাটির পুষ্টি উপাদানগুলোর প্রয়োজন সম্পর্কে কৃষকরা আগের যেকোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশী সচেতন এখন এবং মাটি পরীক্ষা করে সুনির্দিষ্ট ফসলের জন্য সুপারিশকৃত মাত্রায় সার ব্যবহার করার বিষয়ে তাঁদের আগ্রহেরও কোন কমতি নেই। এখন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, প্রাইভেট কোম্পানি, দাতা সংস্থা, এনজিও সবাইকে সহযোগী মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। কৃষক সহায়তা চায়, এটি বাস্তবায়নে সব ধরনের সহায়তা নিয়ে সবাইকে তাঁদের পাশে দাঁড়ানো খুবই জরুরী। মাটি পরীক্ষার সুযোগ না থাকলে কৃষি পরিবেশ অঞ্চল বা উপজেলা অনুযায়ী সার ব্যবহার নির্দেশিকা ব্যবহারে কৃষকদের সহায়তা করা দরকার।
কৃষকরা বুঝতে পারছেন, শুধু রাসায়নিক সার দিয়ে সাময়িক ফলন কিছুটা বাড়লেও জমির জন্য জৈব পদার্থ খুব দরকার। জমিতে বায়োমাস (Biomass) তৈরী, অতিক্ষুদ্র জীবাণু (Microorganism) উৎপাদন, উর্বরতা, উৎপাদন ক্ষমতা ও পানি ধারন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য জমিতে জৈবসার প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরী। জৈবসারে ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যকীয় ১৭ টি উপাদানের অনেকগুলোই কম-বেশী থাকে। অধিকন্তু মাটিতে পর্যাপ্ত জৈব যোগ করার মাধ্যমে আমাদের মাটিতে যে জৈব পদার্থের ঘটতি রয়েছে তাও পূরণ করে। মাটিতে জৈব পদার্থ না থাকলে রাসায়নিক সার গাছের জন্য গ্রহনোপযোগী হতে পারে না ফলে গাছ তা গ্রহনও করতে পারে না। তাই জমিকে ভবিষ্যতে আবাদযোগ্য রাখার জন্য মাটিতে জৈব সার ব্যবহার বাড়ানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মাটিতে জৈব পদার্থ যোগ করার জন্য কৃষক জৈবসার, কেঁচো সার, ট্রাইকোডার্মা ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকেন। কৃষকরা জানেন অধিক মাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহার করে জমির যে ক্ষতি হয় তা পূরণের জন্য জমিতে জৈবসার দিতে হয়। কিন্তু তাঁরা তাঁদের চাষের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ জৈবসার না পাওয়ার জন্য এবং জৈব সারের অত্যাধিক মূল্যের জন্য যতখানি প্রয়োজন সে পরিমান তাঁরা ব্যবহার করতে পারেন না। পাশাপাশি কিছু অসাধু জৈব সার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ভেজাল জৈব সার বাজারজাত করার কারনে কৃষকরা কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পাওয়ায় জমিতে জৈব সার ব্যবহারে আগ্রহও হারিয়ে ফেলেন। যাদের সুযোগ আছে তাঁরা বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রশিক্ষন গ্রহণ করে অনেক কৃষক নিজেরাই জৈবসার, কেঁচো সার, ট্রাইকোডার্মা ইত্যাদি উৎপাদন করে তাঁদের জমিতে প্রয়োগ করছেন। তাও চাহিদার তুলনায় খুবই কম।
বাংলাদেশ সরকার ২০২২-২৩ অর্থবছরের কৃষি বাজেটে জৈব সার ব্যবহারে আগ্রহী করে তোলার জন্য কৃষকদের রাসায়নিক সারের মতো জৈব সার ব্যবহারেও বিশেষ ভর্তুকির ব্যবস্থা করে দিয়েছে, যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। সরকারী সহায়তার পাশাপাশি বেসরকারী সেবাদানকারী সংস্থার সহযোগিতা পেলে বানিজ্যিকভাবে জৈব সার উৎপাদনের জন্য আগ্রহী অনেক উদ্যোক্তাও তৈরী হবে। মাটিতে বেশী বেশী জৈব সার প্রয়োগ করা গেলে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমে যাবে, জমির স্বাস্থ্য ভালো হবে, উৎপাদন বাড়বে, উৎপাদন খরচ কমে যাবে, টেকসই কৃষি চর্চার মাধ্যমে কৃষকের জীবিকায়নও স্থায়ীত্বশীল হবে।
(পরবর্তী পর্বে কৃষিতে পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে থাকবে ধারাবাহিক রচনা)
মোঃ মাকসুদুর রহমান
কৃষি উৎপাদন, সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ও নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ।
ই-মেইলঃ maksudurrahman1363@gmail.com
Thanks for ones marvelous posting! I definitely enjoyed reading it, you happen to be a great author.I will ensure that I bookmark your blog and will eventually come back sometime soon. I want to encourage that you continue your great writing, have a nice afternoon!