আমরা মাছে-ভাতেই বাঙালি। মাছ পছন্দ করেন না এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়াই ভার। হবেই বা না কেন? নদীমাতৃক আমাদের এই দেশে আছে অসংখ্য জলাশয়, পুকুর-নদী, হাওড়-বাওড়, খাল, বিল, ঝিল, দিঘী, প্লাবনভূমি। এক সময় জলাশয় ভরা পানিও ছিলো এবং মাছেরও ছিলো প্রাচুর্য। ছোট, বড়, নানান রকম মাছ, কতই না সুস্বাদু ছিলো সেইসব প্রাকৃতিক মাছ। এখন সেই জলাশয়গুলোতে আগেরমত পানিও নেই তাই আগের মত প্রাকৃতিক মাছও নেই। তাই বলে আমরা কিন্তু মৎস্য শূন্য হয়ে যাইনি, বরং এখনকার দিনে বাজারে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। অবশ্য এর বেশীর ভাগই চাষের মাছ। এদেশে মাছ চাষে নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে, আভ্যন্তরীণ জলাশয়ে মাছ চাষে এখন আমরা বিশ্বে চতুর্থ।
মাছ সে চাষের হোক বা প্রাকৃতিক হোক, মাছ আমরা খাবোই, মাছ আমদের খেতেই হবে, আমিষের উৎস্য হিসেবে মাছ আমাদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে। মাছের উচ্চ পুষ্টিগুণ, সহজ পাচ্য এবং নিরাপদ আমিষ হিসেবে স্বীকৃত হওয়ায় প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় মাছ আমাদের রাখতেই হয়। বিশেষজ্ঞরাও বেশী বেশী মাছ খাওয়ার কথা বলেন। কারন, মাছে আছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। মানব দেহের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, জিঙ্ক, পটাশিয়াম ও আয়োডিনের অন্যতম উৎস্য হলো মাছ। ছোট মাছে আছে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন-এ যা রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে, মাছে ভিটামিন বি-২ আছে যা মানব দেহের অভ্যন্তরের খাদ্যকে ভেঙ্গে এটিপি (ATP) (Adenosine triphosphate) তৈরি করে এবং আমাদের কর্মস্পৃহাকে বাড়িয়ে দেয়। ভিটামিন ডি এর অন্যতম উৎস হলো মাছ যা আমাদের মানসিক অবসাদ দূর করে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে মাছে একদমই কার্বোহাইড্রেড নেই, তাই প্রচুর মাছ খেতেও কোন বাঁধা নেই।
কিন্তু বাজার থেকে মাছ কিনতে বা খেতে গিয়ে বাঁধা একটা পাই, সেটা মনের বাঁধা। মাছটা ভালো হবে তো, তাজা আছে তো, ফরমালিন দেয়া নাই তো? চাষকালীন মাছকে হেভি মেটালযুক্ত খাবার দেয়নি তো, মাছের রোগ বালাই চিকিৎসায় ক্ষতিকর এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করেনি তো? এ রকম আরো নানান প্রশ্ন আমাদের প্রিয় মাছ খাওয়ার ক্ষেত্রে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। বাজারে গিয়ে সবাই তাজা মাছটাই খুঁজি, টিপে-টুপে দেখি, চোখের রংটা দেখে বুঝার চেষ্টা করি, মাছওয়ালাকে বারবার জিজ্ঞাসা করি, মাছটা ভালো হবে তো? তারপর মাছ বিক্রেতার চওড়া হাসির উপর ভরসা করে মাছ কিনে নিয়ে হাসিমুখে বাড়ী ফিরি। তারপর যথারীতি কাটা-বাছা- রান্নার আয়োজন করা হয়। সব শেষে তৃপ্তি সহকারে খাওয়া, খাওয়ার পর লম্বা ঢেঁকুর তুলে আহা কি সুস্বাদু মাছ! না, এমনটি সবসময়ই যে বলা সম্ভব হবে তা নিশ্চিত নয়, অনেক সময় স্বাদের তারতম্যের কারনে পাতের মাছটা আর খাওয়াই যায় না।
এতো এতো সমস্যা বিবেচনা করতে হলেও কিন্তু মাছ আমরা খেতেই চাই এবং অবশ্যই তা যেনো হয় নিরাপদ মাছ। চাওয়াটা সহজ কিন্তু পাওয়াটা কঠিন। একসময় হয়তো পাওয়াটাও সহজ ছিলো, যখন প্রাকৃতিকভাবেই আমাদের হাওড়-বাওড়, নদী আর বিলে পাওয়া যেতো নানান রকম মাছ। পাবদা, টেঙরা, পুঁটি, শোল, বোয়াল, গজার, শিং, মাগুর, চিংড়ি আরো কত না মাছ! বর্ষাকালের নতুন পানিতে ধরা পড়তো কতো না রুপালী মাছ। এখন আমাদের প্রধান আমিষের চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজনের বেশীরভাগ মাছই চাষ করতে হয়। আর তা করতে গিয়ে নিরাপদ মাছ উৎপাদনের কাজটি সহজে করা যায় না। কত কিছুই না বিবেচনার প্রয়োজন হয়! সঠিকভাবে পুকুরটা প্রস্তুত করে নেয়া, তলানীতে জমা কাদা পরিষ্কার করা, পুকুর শুকিয়ে জীবানুমুক্ত করে নেয়া, সঠিক মানের পানি ব্যবহার করা, গুনগতমানের পোনা ছাড়া এবং সঠিক মাত্রায় গুনগত মানের খাবার ব্যবহার করা ইত্যাদি আরো অসংখ্য কাজ করা। মাছ চাষে সঠিক উপকরণ ব্যবহার করা ছাড়াও দরকার সঠিক প্রযুক্তি গ্রহন এবং কার্যকরী ব্যবস্থাপনা।
ভালো মানের মাছ উৎপাদনের জন্য ভালো মানের পোনা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। পোনা খারাপ হলে মাছতো খারাপ হবেই। কিন্তু গুনগতমানের পোনা সংগ্রহ করাটাও কঠিন, সঠিক জ্ঞানের অভাবে মানসম্মত পোনা সংগ্রহে বেশ কিছুটা হিমসিম খেতে হয় চাষিদের। কারন ব্যাঙের ছাতার মত হ্যাচারি গড়ে উঠেছে সারা দেশে। অধিকাংশেরই প্রয়োজনীয় রেজিস্ট্রেশন নেই, তাঁরা হ্যাচারি আইন-২০১০ যথাযথ অনুসরণও করে না। বেশী লাভের আশায় হ্যাচারী মালিকগণ ছোট আকারের ও কম পরিপক্ক মাছ থেকে ডিম সংগ্রহ করায় এবং আন্তঃপ্রজনন জনিত সমস্যার ফলে চাষিরা পোনা ক্রয়ের সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করে ফেলে। চাষিরা রেজিস্টার্ড হ্যাচারি গুলো থেকে গুনগত মানসম্পন্ন পোনা পেলে সেটাই হবে নিরাপদ মাছ চাষে সহায়ক। আর গুনগতমানের পোনা মজুদ করার জন্য লাগে সঠিক পদ্ধতিতে পুকুর বা জলাশয় প্রস্তুতি ও নিরাপদ উপকরণ ব্যবহারে সংশোধিত পানি।
ভালো মানের মাছের জন্য নিরাপদ উপকরণ ও গুনগতমানের পানিতো লাগবেই। সঠিকভাবে তৈরি করা মাছ চাষের উপযুক্ত পানিতেই ছাড়তে হবে সঠিক হারে গুনগতমানের পোনা। পানির গুনগতমান সঠিক রাখার জন্য পানিতে ক্ষতিকর বা নিষিদ্ধ উপকরণের পরিবর্তে ব্যবহার করতে হয় নিরাপদ মৎস্য চাষের উপকরণ সমূহ। যেমন, ক্যালসিয়াম কার্বোনেট, পরিমানমতো রাসায়নিক বা জৈব সার, নিয়মিত প্রোবায়োটিক বা উপকারী ব্যাক্টেরিয়া ব্যবহার যা রোগবালাই প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে এবং মাছ চাষে নিষিদ্ধ এন্টিবায়োটিক ব্যবহার থেকে সুরক্ষা দিতে পারে। প্রোবায়োটিক বা উপকারী ব্যাক্টেরিয়া একই সাথে অনেকগুলো ভূমিকা পালন করায় পানির গুনগতমান ঠিক থাকে, পুকুর কিংবা ঘেরের তলানীর জৈব বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় খুবই কার্যকরী হয়। মাছ চাষে সঠিক পদ্ধতিতে নিয়মিত প্রোবায়োটিক ব্যবহার করলে পানিতে আ্যামোনিয়া এবং অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাস নিয়ন্ত্রণ করা যায়, পর্যাপ্ত উদ্ভিদ এবং জীব কণা (Phytoplankton and Zooplankton) উৎপাদন হয় এবং মাটি ও পানির পিএইচ নিয়ন্ত্রন করতে পারে। প্রোবায়োটিক পানিতে উপকারী ব্যাকটেরিয়ার আধিক্য সৃষ্টি করার মাধ্যমে ক্ষতিকর জীবাণু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে যা মাছের দৈহিক বৃদ্ধিতে সহায়ক হিসবে কাজ করে থাকে। প্রবায়োটিক দিয়ে মাছ চাষ করলে নদী, হাওড়, বাওড়, বিলের মাছের মতোই সুস্বাদু ও নিরাপদ মাছ উৎপাদিত হয়।
সুস্বাদু, দূর্গন্ধমুক্ত, নিরাপদ মাছ চাইবো অথচ চাষের মাছকে খাবার হিসেবে দেবো পচা গম, পচা ভুট্টা, পচা বিস্কুট, পচা ভাত, গোবর, মুরগীর বিষ্ঠা ইত্যাদি অখাদ্য, তাহলে আমরা নিরাপদ মাছ পাবো কিভাবে?
(চলবে)
(নিরাপদ মাছ পর্ব -০২-এ নিরাপদ মাছের জন্য সম্পূরক খাদ্য (ফিড), মাছ অনিরাপদ হওয়ার কারন এবং নিরাপদ মাছ পাওয়ার উপায় নিয়ে আলোচনা করা হবে।)
মোঃ মাকসুদুর রহমান
কৃষি উৎপাদন, সরবরাহ শিকল ও নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ।
ই-মেইলঃ maksudurrahman1363@gmail.com