বিভিন্ন জলাশয়ে চাষকৃত বিভিন্ন ধরণের মাছ বাজারজাত করার উপযুক্ত হবার পর চাষের পুকুর, ঘের বা খামার থেকে মাছের গন্তব্য ভোক্তার রান্নাঘর হয়ে খাবার টেবিল। আমাদের দেশে এখনো খামার থেকে মাছ ভোক্তার টেবিলে পৌঁছানোর পথটা দীর্ঘই রয়ে গেছে। মাছকে সতেজ রাখার কৌশল হিসেবে নানান প্রচলিত ও অপ্রচলিত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, নানান উপকরণ ও উপাদান ব্যবহার এর মাধ্যমে এবং একাধিক মানুষের হাত বদলের পর অবশেষে খুঁজে পায় ভোক্তার টেবিল।
চাষের জলাশয় হতে মাছ আহরণের পর ফড়িয়া, পাইকার, আড়ৎদার, খুচরা বিক্রেতা ইত্যাদি আরো অনেকগুলো হাত বদলের সময় প্রতিটি হাত বদলেই মাছ অনিরাপদ হয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে।
তাই মাছ আহরণ পরবর্তী চূড়ান্ত সরবরাহ পর্যন্ত সময়টা যত লম্বা হয় মাছের গুনগত মান ততই কমতে থাকে। মাছ আহরণের পরপরই নিরাপদ পানি দিয়ে ধুয়ে দ্রুত পরিষ্কার করে নিরাপদ বরফ সঠিক অনুপাতে ব্যবহার করে মাছকে দ্রুত ঠান্ডা করা বা আইসিং করার মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি কমিয়ে মাছের সতেজতা বজায় রাখা যায়। তাজা মাছের জন্য মাছ ধরার পর 0°C থেকে 4°C এর মধ্যে তাপমাত্রা বজায় রাখতে হয়। এবং দ্রুত নিরাপদ বরফ দিয়ে মাছকে সম্পূর্ণরূপে ঢেকে দিতে হয় । মাছে যে বরফ ব্যবহার করা হয় সেগুলো অবশ্যই আর্সেনিক বা অত্যধিক আয়রন বা অন্যান্য বিপজ্জনক পদার্থ মুক্ত এবং নিরাপদ পানি দিয়ে তৈরী হতে হয়। কিন্তু মাছের বাজারে বরফের খবর কে রাখে? সাধারণত বিশাল আকারের বরফ খন্ড মাটিতে বা অপরিষ্কার মেঝেতে রেখে মরিচাযুক্ত লোহার রড দিয়ে অথবা অপরিষ্কার বরফ ভাঙ্গানো মেশিনে ঢুকিয়ে বরফকে টুকরো টুকরো বা গুড়ো করে মাছ সংরক্ষণে ব্যবহার করতে দেখা যায়। যা মাছকে পচন থেকে রক্ষা করলেও নিঃসন্দেহে ক্ষতিকারক বিভিন্ন জীবাণু থেকে রক্ষা করে না। তাই মাছ ব্যবসায়ীগনের উচিৎ উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের দ্বারা লাইসেন্সপ্রাপ্ত কারখানা থেকে বরফ সংগ্রহ করা, সেগুলো জীবানুমুক্ত যানবহনে পরিবহন করা ও পরিষ্কার স্থানে মজুদ করা। মৎস্য অধিদপ্তরের মৎস্য পরিদর্শণ ও মান নিয়ন্ত্রন বিভাগ (Fish Inspection and Quality Control-FIQC) থেকে নিয়মিত তদারকির মাধ্যমে নিম্নমানের দুষিত পানি দিয়ে বরফ তৈরীর কারখানাগুলোতে তাঁদের পর্যবেক্ষণ আরো জোরদার করে মাছ সংরক্ষণে নিরাপদ বরফ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারেন।
মাছ আহরনের পর নিরাপদ পানি ব্যবহার করে পরিষ্কার করা, ক্যারেটে সাজিয়ে বরফ দেয়ার কাজগুলো যারা করেন তাঁরা তাঁদের ব্যাক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি মেনে করেন কিনা সেটাও দেখার বিষয়। কোন অসুস্থ্ ব্যক্তি, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি, শরীরে ঘা বা ক্ষত রয়েছে এমন ব্যক্তিদেরকে মাছ আহরণ পরবর্তী কাজ সমুহে নিযুক্ত করা, মাছ ধরার আগে এবং পরে টয়লেট ব্যবহারের পরপরই সাবান ব্যবহার নিশ্চিত না করা, ধূমপান, থুতু ফেলা, মাছের উপর চিবানো খাবার ফেলা, ঘন ঘন হাঁচি বা কাশি দেয়ার ফলেও মাছ জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হয়ে যেতে পারে। এমনকি শরীরের অলঙ্কার, যেমন গয়না, হাতে পরা ঘড়িতেও জীবাণু থাকতে পারে। তাই নিরাপদ মাছ সরবরাহের কাজগুলো যারা দেখাশুনা করেন তাঁরা এটাও নিশ্চয়ই দেখবেন যেন আহরনোত্তর মাছের কাজ যারা করেন তাঁরা যেন ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কাজগুলো করেন।
মাছ সরবরাহ শিকলের আরেকটি বড় কাজ হল মাছ পরিবহন। বরফ দেয়ার পর মাছ পরিবহন এর চিত্রটা খুব সুখকর না। প্ল্যাস্টিকের ক্যারেটে, সঠিকভাবে বরফ আচ্ছাদিত হয়ে আসার পরিবর্তে ড্রাম, প্ল্যাস্টিকের বস্তা এবং আরো নানানভাবে মাছ আড়তে আসে। বরফ আচ্ছাদিত মাছ সঠিকভাবে প্যাকেজিং বা ক্যারেটের মাধ্যমে পরিবহন করা না হলে পরিবহনের সময়ই মাছ নানান রকম ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত হয়ে যেতে পারে।
আড়তে মাছ আসার পর দেখা যায় অব্যবস্থাপনার আরেক চিত্র। মাছগুলো অপরিচ্ছন্ন অস্বাস্থ্যকর খোলা মেঝেতে ফেলে পাইকার ডাক/নিলাম হাকেন। ড্রাম বা পাত্রে রাখা হলেও সেগুলোও ভালোভাবে সাবান কিংবা ডিটারজেন্ট দিয়ে খুব কমই পরিষ্কার করা হয়। অনেক আড়তে মাছ পরিষ্কার করার জন্য ড্রামে যে পানি রাখা হয় সেই পানিতে আগে থেকে ফরমালিনও দেয়া থাকে। ফলে মাছ পরিষ্কার হওয়ার সাথে ক্ষতিকারক রাসায়নিক প্রিজারভেটিভও যুক্ত হয়ে ভোক্তার জন্য অনিরাপদ যায়। নিরাপদ মাছ সরবরাহ করতে হলে সংশ্লিষ্ট সরকারী অধিদপ্তর, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ সংস্থা এবং বাজার কমিটিকে স্বাস্থ্যসম্মত আড়ত ব্যবস্থাপনাও নিশ্চিত করতে হবে। আড়তের পাশে কোনভাবেই গন শৌচাগার কিংবা ময়লা-আবর্জনার স্তুপ রাখা যাবে না। এগুলো সঠিকভাবে নজরদারিতে এনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করতে পারলে মাছের ভিতরে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া E. coli, Salmonella ইত্যাদির সংক্রমণ ঘটতে পারে।
ঘের-খামার, হাট-বাজারে মাছ নিরাপদ রাখার বিষয়ে অনেক কথাই হল, এখন মাছ বাড়ীতে আনার পর কি হয়? বাড়ীতে এনে এখন আর প্রক্রিয়াজাত করতে কুটা-বাছা খুব একটা হয় না বললেই চলে। বাজারেই মাছ কাটার জন্য লোক রয়েছে। টাকা দিলে তারাই কেটে বেছে দিবে। কিন্তু যে স্থানে যেভাবে মাছ কাটা হয় সেটা খুব স্বাস্থ্যকর হয় না। রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় মাছ কাটার দৃশ্য খুব সাধারণ। অনেকে আবার মাছ বাড়ীতে এনে আস্ত মাছটাই ডীপ ফ্রীজে রেখে দেন। এটাও স্বাস্থ্যসম্মত না। মাছের অন্ত্র এবং ফুলকাগুলি সরিয়ে মাছ ফ্রীজিং করা উচিৎ কারন এই অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলি ব্যাকটেরিয়া দূষণের প্রবণতা এবং মাছের গুণমান দ্রুত হ্রাসে অবদান রাখে।
উত্তম মাছ চাষ (Good Aquaculture Practice) পদ্ধতিতে মাছ চাষ, মৎস্য অধিদপ্তরের মৎস্য পরিদর্শণ ও মান নিয়ন্ত্রন বিভাগের জোরদার তদারকি, যথাযথ আইন প্রয়োগের পাশাপাশি মাছ চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বিক্রির সাথে সম্পৃক্ত সবাই এবং ভোক্তা পর্যায়ে আরো বেশি সচেতনতা বাড়ালেই শতভাগ নিরাপদ মাছ পাওয়া নিয়ে আমাদের ভাবনা অনেকাংশেই কমে যেতে পারে।
মোঃ মাকসুদুর রহমান
কৃষি উৎপাদন, সরবরাহ শিকল ও নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ।
ই-মেইলঃ maksudurrahman1363@gmail.com
খুব চমৎকার গঠনমূলক লেখা। অনেক তথ্যসমৃদ্ধ। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও সরবারহের ক্ষেত্রে খুব ভালো দিক নির্দেশনা রয়েছে। এরকম লেখা থেকে উপকৃত হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। লেখককে ধন্যবাদ। আগামীতে আরো দিকনির্দেশনামূলক লেখা আপনার কাছে প্রত্যাশা করি।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। সকলের সহযোগিতায় আমরা মানুষের প্রকৃত কল্যাণে এরকম লেখা সবসময় প্রকাশ করবো।
Excellent 👌
Excellent information about Fish production, supply chain, healthy fish & safty food processing in Bangladesh.