চিংড়ি নিয়ে বলতে গেলে একটি ভুল ধারনা থেকে প্রথমেই বের হয়ে আসা প্রয়োজন, সেটি হল চিংড়ি কি মাছ? মৎস্য বিষয়ক লেখাপড়া বা ভালোভাবে জানা না থাকলে আমরা প্রায়ই যে কথাটি বলে থাকি “চিংড়ি মাছ”, আসলে এটি মাছ নয়! চিংড়ি আর্থ্রপোডা গোত্রের অন্তর্ভূক্ত একটি জলজ প্রাণী, অর্থাৎ বাংলায় বলা যায় সন্ধিপদী প্রাণী। Arthropoda হলো প্রাণী জগতের সবথেকে বৃহৎ গোত্র, এদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ-
দেহ সন্ধিযুক্ত উপাঙ্গ বিশিষ্ট, দ্বিপার্শ্বীয় প্রতিসম খন্ডকায়িত এবং ট্যাগমাটা (tagmata)-য় (বিভিন্ন অংশ যেমন মস্তক ও উদর) বিভক্ত। মস্তকে এক জোড়া বা দুই জোড়া অ্যান্টেনা (antena) ও সাধারণত এক জোড়া পুঞ্জাক্ষি (compound eyes) থাকে। আর্থ্রপোডা গোত্রের অন্তর্ভূক্ত প্রাণীর বহিঃকঙ্কাল কাইটিন (chitin) নির্মিত এবং নিয়মিত পরিবর্তিত হয়। এরা স্থলচর, জলচর, মুক্তজীবী, নিশ্চল, সহবাসী বা পরজীবী হিসেবে বাস করে। চিংড়ি নিয়মিত খোলস পরিবর্তনের মাধ্যমে আকারে বৃদ্ধি পায়, এদের মেরুদন্ড থাকে না, শক্ত কাইটিন নির্মিত খোলস দিয়ে দেহ আবৃত থাকে। এরা পানির তলার স্তরে বাস করে এবং নিশাচর, চিংড়ি সর্বভূক প্রাণী তাই ভক্ষণযোগ্য সব খাবারই খেতে পারে এমনকি কোন চিংড়ি মারা গেলে জীবিত চিংড়ি মৃত চিংড়িকে খেয়ে ফেলে।
মেরুদন্ড বা মাছের মতো কাঁটা না থাকায় সারা পৃথিবীর খাদ্যপ্রেমী মানুষের চাহিদার শীর্ষে আছে বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি। বাংলাদেশেই স্বাদুপানি ও লোনাপানিতে ছাপ্পান্ন প্রজাতির চিংড়ি পাওয়া যায়, এদের মধ্যে গলদা, বাগদা, হরিণা, চাকা এই চার প্রজাতির চিংড়ির প্রাপ্যতা, আকার ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদার কারনে রপ্তানি পণ্য হিসেবে প্রতি বছর প্রচুর বৈদেশিক মূদ্রা অর্জন করে থাকে। একসময় পাটের পরে মাছকে বলা হতো দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানি আয়কারী পণ্য হিসেবে। যদিও রপ্তানি আয়ে মাছ এখন তৈরি পোষাক, চামড়াজাত পণ্য, পাট এসব থেকে পিছিয়ে পড়েছে নানাবিধ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলাফল হিসেবে। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে ৫১৯২ কোটি টাকা বৈদেশিক মূদ্রা অর্জিত হয়েছে। এছাড়া ২০২১-২২ অর্থ বছরে দেশে ২.৬১ লক্ষ মেট্রিক টন চিংড়ি উৎপাদিত হয়েছে যার একটি বড় অংশ রপ্তানি পণ্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। রপ্তানিকৃত মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্যের মধ্যে চিংড়িই প্রায় ৮০-৮৫ শতাংশ, চিংড়ির মধ্যে আবার বাগদা প্রজাতির চিংড়ি প্রায় ৮০ শতাংশ। এই সাধারণ তথ্যগুলো অনেকেই জানেন না, তাঁরা মনে করেন সবই বুঝি চিংড়ি রপ্তানি হয় এদেশ থেকে।
চিংড়ি যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি পণ্য, তাই এটি একটি শিল্প হিসেবে স্বীকৃত, এই শিল্পকে কেন্দ্র করে দেশের দক্ষিন ও দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলে মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণসহ বিভিন্ন ধরণের শিল্প কলকারখানা গড়ে উঠেছে। এসব মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার প্রধান কাঁচামাল চাষীর ঘেরে উৎপাদিত চিংড়ি, ইতিপূর্বে মাছের পর্ব তিনটির আলোচনায় সরবরাহ শিকল যেভাবে বর্ণিত হয়েছে চিংড়ির ক্ষেত্রেও অনুরূপ। অর্থাৎ চাষের জলাশয় হতে চিংড়ি আহরণের পর ফড়িয়া, পাইকার, আড়ৎদার, খুচরা বিক্রেতা ইত্যাদি আরো অনেকগুলো হাত বদলের মাধ্যমে কারখানায় পৌঁছায়। মাছের ক্ষেত্রেও নিরাপদ হবার যেসকল পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত চিংড়ির ক্ষত্রেও তাই এবং মাছের ক্ষেত্রে অনিরাপদ হবার যে সকল কারন বর্তমান সরবরাহ শিকলে বিদ্যমান চিংড়ির ক্ষেত্রেও তাই। বরং চিংড়ি রপ্তানি পণ্য হওয়ায় অসাধু ব্যবসায়ীগণ ওজন বৃদ্ধির জন্য যতো প্রকার অনিরাপদ কর্মকান্ড করে থাকেন তার ফিরিস্তি অন্য একটি পর্বে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা যাবে। শুধু এটুকু বলা যায় যে, অসাধু ব্যবসায়ীদের ঘৃণ্য অপতৎপরতার কারনে আমাদের চিংড়িতে নিষিদ্ধ ধাতব, রাসায়নিক বা এন্টিবায়োটিকের মতো দ্রব্য, স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া E. coli, Salmonella ইত্যাদি পাওয়া যায়।
মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশের মৎস্য পরিদর্শণ ও মান নিয়ন্ত্রন বিভাগ (Fish Inspection and Quality Control-FIQC) থেকে নিয়মিত তদারকির মাধ্যমে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয় যাতে রপ্তানি পণ্য হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির সুনাম অক্ষুন্ন থাকে এবং মানের অবমূল্যায়নের কারনে কোনভাবেই যেন রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার স্বীকার না হতে হয়। এই উদ্দেশ্যে মৎস্য পরিদর্শণ ও মান নিয়ন্ত্রন বিভাগ আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষাগার স্থাপন করেছে, সেখানে পরীক্ষা নিরীক্ষার পর নিরপদ চিংড়ি রপ্তানির সকল আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন মেনে মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানাগুলোকে সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়।
আশাবাদী হবার মতো বিষয় হলো সরকার ও সচেতন চিংড়ি চাষীদের উদ্যোগে গত ৮-১০ বছর যাবত দেশে নিরাপদ চিংড়ি চাষের উদ্দেশ্যে আধুনিক সেমিইনটেন্সিভ পদ্ধতির চিংড়ি চাষ প্রচলন ঘটেছে। এই পদ্ধতি অবলম্বন করে চিংড়ি খামার বা ঘের পুরোপুরি নেটের মাধ্যমে ঘিরে ফেলে জৈব নিরাপত্তা বলয় (Biosecurity) তৈরি করা হয়। ফলে চিংড়ি চাষকালীন কোন ধরনের বহিঃপরজীবি, ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হবার ঝুঁকি কমে যায়। এছাড়া সহজেই ট্রেসিবিলিটি (Traceability) সংক্রান্ত তথ্যাদি সংরক্ষণ ও খামার ব্যবস্থাপনা সহজ হয়, এসপিএফ পিএল ব্যবহার করে চিংড়ির উৎপাদনও বহুগুণে বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়। মৎস্য প্রক্রিয়া শিল্পের সাথে যুক্ত মানুষ সহজেই সরাসরি খামার থেকে বেশি পরিমান চিংড়ি সংগ্রহ করতে পারেন। এভাবে সরবরাহ শিকল ছোট হয়ে আসে এবং অনিরাপদ হবার সুযোগ কমে গিয়ে উৎপাদিত চিংড়ি খামার থেকে প্রক্রিয়াজাত কারখানা হয়ে সহজে পৌঁছাতে পারে আন্তর্জাতিক বাজারে। কিন্তু আমাদের সাধারণ প্রান্তিক চিংড়ি চাষিদের পক্ষে বড় বিনিয়োগ করে সেমিইনটেন্সিভ পদ্ধতির চিংড়ি চাষ করা সম্ভবপর নয়, ফলে আমাদের সেই প্রচলিত অনিরাপদ সরবরাহ শিকলের উপরই নির্ভরশীল হতে হয় অধিকাংশ চিংড়ি পাবার জন্য। তাই সরকার ও প্রাইভেট সেকটরের যৌথ প্রচেষ্টায় সরবরাহ শিকলের উন্নয়নে জোরদার উদ্যোগ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরী।
কথায় আছে “চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী”, এতো সতর্কতার পরও চিংড়ির ওজন বৃদ্ধির ঘৃণ্য কৌশল প্রতিনিয়তই অবলম্বন করে চলেছে দুষ্টু চক্রের দল। আমাদের নিজেদের ভিতর থেকেই যদি নিরাপদ মাছ বা চিংড়ি বাজারজাতকরণের বিষয়ে সততাপূর্ণ বিবেকবোধ সৃষ্টি না হয় তাহলে বাজারের ভেজাল দ্রব্যযুক্ত চিংড়ি কিনে নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে সবাইকে। কারন রপ্তানির জন্যও যে সরবরাহ শিকলের মাধ্যমে চিংড়ি বাজারজাত করা হয় আমাদের আভ্যন্তরীণ বাজারেও সেই একই পন্থায় চিংড়ি দেশীয় ভোক্তার টেবিলে পৌঁছায়। ফলে আপনি চিংড়ির আসল স্বাদ থেকে বঞ্চিত হন এবং একই সাথে বিভিন্ন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে পারেন।
পল্লব খন্দকার, ৯ আগস্ট ২০২৩
mazhabkh93@gmail.com
Excellent write up.
ধন্যবাদ ইফতি ভাই। আপনিও লেখা দিন।