আমাদের দেশের মৎস্য খাতের প্রধান রপ্তানিযোগ্য পণ্য সাদা সোনা খ্যাত চিংড়ি নিয়ে কথার যেন শেষ নেই। রফতানী পণ্য তালিকার অন্যতম এই পণ্যটি রফতানির মাধ্যমে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আসে এদেশে। গত বছরের চেয়ে কিছুটা কম হলেও ২০২২-২৩ অর্থ বছরে চিংড়ি থেকে রফতানি আয় ছাড়িয়েছিল প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা যা আমাদের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভুমিকা রাখছে। গ্রামীন জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশের জীবিকায়নের ক্ষেত্র, অগণিত বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র, অসংখ্য উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্র এদেশের চিংড়ি শিল্প।
বিগত কয়েক বছরে মিঠা পানি, উম্মুক্ত জলাশয়, আবদ্ধ এবং সামুদ্রিক মাছের সাথে চিংড়ির উৎপাদনও অনেক বেড়েছে। সামগ্রিকভাবে বিগত ১৫-১৬ বছরের ব্যবধানে মাছের উৎপাদন দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এরই মধ্যে আমাদের দেশের বাগদা চিংড়ি ভৌগলিক নির্দেশক (জি আই) পণ্য হিসেবে সংযুক্ত হয়ে বিশ্বপরিমণ্ডলে বাগদা এখন বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে পরিচিত হয়েছে এবং বিশ্বপরিমন্ডলে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করেছে। পৃথিবীর প্রায় ৫২ টি দেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদের দেশে উৎপাদিত চিংড়ির চাহিদা রয়েছে।
চিংড়ি উৎপাদন ও রফতানির ক্ষেত্রে এই যে সফলতা তা কিন্তু খুব সহজে ঘটেনি। আমাদের প্রধান রপ্তানিযোগ্য অধিকাংশ বাগদা চিংড়ি চাষিরা এখনো সনাতন চাষ পদ্ধতিতেই (traditional farming) চাষ করেন । এই চাষ পদ্ধতিতে অপর্যাপ্ত পানিতে অপরিকল্পিতভাবে পোনা মজুদ করা হয়, কোন খাবার ব্যবহার করা হয় না, জোয়ার-ভাটায় খাল বা নদী হতে পানি পরিশোধন ব্যবস্থা ছাড়াই প্রবেশ বা নির্গমন করা হয়। ফলে প্রতি বছরই ভাইরাসের কবলে পড়ে বাগদা চিংড়ির ব্যাপক মড়ক দেখা যায়। গলদা চিংড়ির ক্ষেত্রে গত কয়েক বছর আগেও সনাতন পদ্ধতিতে নিম্ন মানের খাবারসহ সব ধরনের অনিরাপদ উপকরণ ব্যবহার করা হতো। চিংড়ির রোগবালাই নিয়ন্ত্রণে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা, নিম্ন মানের পোনা সহ নানান রকম ক্ষতিকর উপকরণ ব্যবহার করার মাধ্যমে অনিরাপদ চিংড়ি উৎপাদন করতো। সনাতন পদ্ধতিতে চিংড়ির উৎপাদনও ছিলো অনেক কম।
আশার কথা বিগত কয়েক বছরে সময় এবং চাহিদার প্রেক্ষিতে, সরকারী এবং বেসরকারী নানান রকম পদক্ষেপ এবং সহায়তার কারনে গলদা ও বাগদা চিংড়ি চাষের পুরো প্রক্রিয়াতে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে অনেক চাষি, বড় বড় কোম্পানী, বড় বড় খামারী উন্নত সনাতন (Extensive Farming) এবং আধা নিবিড় ( Semi- Intensive) পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করছেন। আলাদা ইনলেট এবং আউটলেট সহ একটি সঠিক জৈব-নিরাপত্তা (Biosecurity) বেস্টনী তৈরী এবং সঠিক পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে, নির্দিষ্ট ০৯ টি জীবাণুমুক্ত পোনা (Specific Pathogen Free-SPF) সঠিক ঘনত্বে মজুদ করার কারনে, এন্টিবায়োটিকের পরিবর্তে প্রোবায়োটিক ব্যবহার করার ফলে মজুদকৃত পোনার মৃত্যুহার কমে উৎপাদনের হার বেড়ে গেছে।
নিবিড় চাষ পদ্ধতিতে (Intensive Farming) এবং আধা নিবির (Semi-Intensive) পদ্ধতি এবং চিংড়ি চাষে উত্তম চাষ পদ্ধতি (Best Aquaculture Practices-BAP) অনুসরনের ফলে চিংড়ি চাষের হিসাবটাই বদলে গেছে। জীবাণুমুক্ত পোনা ব্যবহারের ফলে রোগ-বালাই কমে গেছে, প্রোবায়োটিক ব্যবহারের ফলে পানির গুনগত মান উন্নত হয়েছে, চিংড়ি ঘেরে/খামারে উদ্ভিদ কণা (Phytoplankton), প্রাণীকণা (Zooplankton) তৈরী হচ্ছে, ভারসাম্যপূর্ণ প্রতিবেশ (Ecosystem) বজায় থাকছে। জৈব-নিরাপত্তা (Biosecurity) বেস্টনী তৈরীর ফলে ঘেরগুলো সুরক্ষিত থাকায় এক ঘেরের রোগাক্রান্ত চিংড়ির জীবাণু অন্য ঘেরে সংক্রমণ ছড়িয়ে পরার সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে। চিংড়ি চাষে এসব ইতিবাচক পরিবর্তনের মাধ্যমেই কাঙ্ক্ষিত মানের চিংড়ির উৎপাদন বেড়েছে।
উৎপাদন বাড়লেও চাষের ক্ষেত্রে আমরা পুরোপুরি স্বস্তির জায়গায় আছি এমনটা বলা যাবেনা এখনই। এখনও অনেক ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চিংড়ি চাষি তাঁদের ঘেরগুলো জৈব বেস্টনী দ্বারা সুরক্ষিত করছে না, বেশী উৎপাদনের আশায় স্বল্প পানিতে নিম্ন মানের অনেক বেশী ঘনত্বে পোনা মজুদ করছে, নিম্ন মানের খাবার ব্যবহার করছে, চাহিদামাফিক প্রোবায়োটিক ব্যবহার করছে না, ফলে রোগ সংক্রমণ এর সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। ফলে ক্ষুদ্র চাষিদের উৎপাদিত নিম্নমানের চিংড়ির কারনে আমাদের ব্রান্ড, জি আই সনদপ্রাপ্ত বাগদা সহ অন্যান্য চিংড়ি আন্তর্জাতিক বাজারে বিশেষ করে ইউরোপিয়ান দেশসহ আমদের দেশ থেকে চিংড়ি আমদানী করে এমন ৫২টি দেশে প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে।
চাষি যদি চান তিনি নিরাপদ চিংড়ি উৎপাদন করবেন তবে চাষের শুরুতেই তাঁকে গতানুগতিক চিন্তা-ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ঘের প্রস্তুত, পানি পরিশোধন ব্যবস্থাপনা, পোনা সংগ্রহ, খাদ্য ব্যবস্থাপনা, রোগবালাই ব্যবস্থাপনা সবই হবে সনাতন ধ্যান-ধারনার বাইরে আধুনিক প্রযুক্তি অনুসরণ করে।
বদলে যাওয়া আধুনিক চিংড়ি চাষ আমাদের সম্ভাবনার দ্বার যেমন খুলে দিয়েছে, নিরাপদ চিংড়ি নিয়ে ভাবনার দ্বারটিও খোলাই রয়ে গেছে। তাই চিংড়ির অনিরাপদ হবার কারনসমূহ আমাদের জানতেই হবে। অন্যতম রপ্তানি পণ্য বিধায় সবাইকেই নিরাপদ চিংড়ি উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ বিষয়ে বিস্তারিতভাবেই জানতে হবে। এক্ষেত্রে উৎপাদনকারী, আড়ৎদার, পাইকার, ডিপো মালিক সর্বপোরী ভোক্তা সকলের নিরাপদ চিংড়ি বিষয়ক সচেতনতা ও সার্বিক বাজার ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত অংশগ্রহণ একান্তভাবে অপরিহার্য্য।
তাই চিংড়ি অনিরাপদ হবার কারন এবং নিরাপদ করার কৌশল গুলো নিয়ে পরবর্তী পর্বে বিস্তারিত আলোচনা করা দরকার।
মোঃ মাকসুদুর রহমান
কৃষি উৎপাদন, সরবরাহ শিকল ও নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ।
ই-মেইলঃ maksudurrahman1363@gmail.com
Excellent Maksud Bhai